‘তারা এখনো জঙ্গিবাদ সংগঠন হিসেবে কালো তালিকাভুক্ত না হলেও তাদের বিভিন্ন প্রকাশনা, বক্তব্য এবং মুরীদ-অনুসারিদের প্রতি তাদের নির্দেশনার ফলে ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গিবাদ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।’
রাজারবাগ দরবার শরীফ বিষয়ে হাইকোর্টে দেয়া পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের তদন্ত প্রতিবেদনে এমন মতামত এসেছে।
তদন্তের স্বার্থে সিআইডি, কাউন্টার টেররিজম ও দুদক চাইলে রাজারবাগ দরবার শরীফের পীরের বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দিতে পারবে এবং এর আগে সিআইডি’র দেয়া প্রতিবেদনের আলোকে ভুক্তভোগী কেউ চাইলে রাজারবাগ দরবার শরীফ সংশ্লিষ্ট কারো বিরুদ্ধে মামলা করতে পারবেন বলে আদেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
এছাড়াও রাজারবাগ দরবার শরীফ ও পীরের সম্পদের তথ্য অনুসন্ধান করে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলে সময় দিয়ে পরবর্তী আদেশের জন্য আগামী ১৩ ফেব্রুয়ারী দিন ধার্য করেছেন আদালত। তবে পীরের ‘অনুসারীদের করা’ মানবপাচারসহ বিভিন্ন ফৌজদারী ভুক্তোভোগী আট জনের মামলার তদন্ত প্রতিবেদন আগামী ১৪ ডিসেম্বরের মধ্যে দিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
আজ রোববার হাইকোর্টে দেয়া পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রতিবেদনের মতামতে বলা হয়েছে, ‘‘রাজারবাগ দরবারের নিয়ন্ত্রণাধীন দৈনিক আল ইহসান’ ও ‘মাসিক আল বাইয়্যিনাত’ পত্রিকার বিভিন্ন সংখ্যা, তাদের তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত বিভিন্ন বই, ইতোপূর্বে তাদের কার্যক্রম এবং বিভিন্ন জেলায় তাদের অনুসারিদের কার্যক্রমের কারণে রুজুকৃত মামলা ও মামলাসমূহের তদন্তের ফলাফল পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তারা ইসলাম ধর্মের নামে এবং অনেক ক্ষেত্রে পবিত্র কোরআন ও হাদিসের খন্ডিত ব্যাখ্যার মাধ্যমে এদেশের ধর্মভীরু মানুষকে ভুলপথে পরিচালিত করে ধর্মের নামে মানুষ হত্যা ও তথাকথিত জিহাদকে উস্কে দিচ্ছে।
এদেশের নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠনগুলো যে উদ্দেশ্য নিয়ে তাদের মতবাদ প্রচার করছে ও কার্যক্রম চালাচ্ছে রাজারবাগ দরবার শরীফ এর পীর, তার সহযোগি ও অনুসারিদের কার্যক্রম জঙ্গিদের কার্যক্রমের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। ভিন্ন মতাবলম্বী ও ভিন্ন ধর্মের মানুষকে, তাদের ভাষায় মালউনদেরকে হত্যা করা ঈমানী দায়িত্ব উল্লেখ করে ফতোয়া এবং এক্ষেত্রে কৃতল করার আদেশ দিয়েছে, যা মূলত বাংলাদেশের নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠন নব্য জেএমবি ও নসার আল ইসলামের মানুষকে হত্যা করার ফতোয়ার অনুরূপ। এটি ইসলামের নামে নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন সমূহের মত একই প্রক্রিয়ায় বিরোধীদের অর্থাৎ ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের হত্যা করার ও ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করার কৌশল। তাদের এ ধরনের বক্তব্য মানুষকে জঙ্গীবাদের দিকে ধাবিত করবে, অসহিষ্ণু করবে, অসম্প্রদায়িক চেতনা নষ্ট করতে ভূমিকা রাখবে।
তাদের প্রচারণা ও অন্যান্য কার্যক্রমের মাধ্যমে মূলত তারা এদেশের হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা,অসম্প্রদায়িক চেতনা এবং গণতন্ত্র বিরোধী একটি শ্রেণি বা গোষ্ঠি তৈরি করতে চাচ্ছে। তাছাড়া, তারা ছোঁয়াচে রোগ বিরোধী ও বাল্য বিবাহের পক্ষে বিভিন্ন বক্তব্য ও ফতোয়া দিয়ে ধর্মভীরু ও সহজ সরল সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করছে।’’
পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রতিবেদনের আরো বলা হয়েছে যে, ‘‘সার্বিক পর্যালোচনায় সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়, তারা এখনও জঙ্গী সংগঠন হিসেবে কালো তালিকা ভুক্ত না হলেও তাদের বিভিন্ন প্রকাশনা, বক্তব্য, মুরীদ ও অনুসারিদের প্রতি তাদের নির্দেশনার ফলে ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গীবাদ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। একই সাথে তাদের এসকল বক্তব্য ও প্রচার প্রচারণা জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়া ব্যক্তিদের ‘লোন উলফ’ হামলায় উদ্বুদ্ধ করতে পারে।’’
আজ আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির ও এমাদুল হক বশির। আর রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিপুল বাগমার।
একপর্যায়ে আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির তার নিজের ও স্ত্রী-সন্তানদের নিরাপত্তাহীনতার কথা হাইকোর্টে তুলে ধরেন।
এই আইনজীবী আদালতকে বলেন, ‘গত ২০ বছরে মধ্যে এমন নিরাপত্তাহীনতা কখনো বোধ করিনি। আমার স্ত্রীকে গভীর রাতে ফোন দিয়ে এই মামলা বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়। আমার সন্তানদের স্কুলে যাওয়া আসার সময় ফলো করা হয়। আমার শশুরের নাম্বারে ফোন দিয়ে বিভিন্ন কথা বলা হয়। এমন বাস্তবতায় আমি থানায় জিডি করি। মক্কেলের পক্ষে মামলা লড়তে গিয়ে এরকম হয়রানি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি।’
এসব শুনে আদালত রাষ্ট্রপক্ষে আইনজীবী ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিপুল বাগমারকে শিশির মনিরের নিরাপত্তার বিষয়টি দেখতে বলেন।
এর আগে একরামুল আহসান কাঞ্চন নামের এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন জেলায় ৪৯টি মামলার নেপথ্যে রাজারবাগ দরবার শরীফের পীর ও তার অনুসারীদের জড়িত থাকার তথ্যপ্রমাণ সম্বলিত প্রতিবেদন হাইকোর্টে দাখিল করে সিআইডি।
সেই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘একরামুল আহসান কাঞ্চনের তিন ভাই এবং এক বোন। ১৯৯৫ সালে তার বাবা ডা. আনোয়ারুল্লাহ মারা যান। রাজারবাগ দরবার শরিফের পিছনে ৩ শতাংশ জমির ওপর ৩ তলা পৈতৃক বাড়ি তাদের। বাবার মৃত্যুর পর কাঞ্চনের বড় ভাই আক্তর-ই-কামাল, মা কোমরের নেহার ও বোন ফাতেমা আক্তার পীর দিল্লুর রহমানের মুরিদ হন। কিন্তু রিট আবেদনকারী ও তার অপর ভাই ডা. কামরুল আহসান বাদলকে বিভিন্নভাবে প্ররোচিত করেও ওই পীরের মুরিদ করা যায়নি। এরমধ্যেই একরামুল আহসান কাঞ্চনের মা, ভাই ও বোনের কাছ থেকে তাদের পৈতৃক জমির অধিকাংশই পীরের দরবার শরিফের নামে হস্তান্তর করা হয়। আর একরামুল আহসান কাঞ্চন ও তার ভাইয়ের অংশটুকু পীর এবং তার দরবার শরিফের নামে হস্তান্তর করার জন্য পীর দিল্লুর এবং তার অনুসারীরা বিভিন্নভাবে চাপ দেয়। কিন্তু সম্পত্তি হস্তান্তর না করায় পীর দিল্লুর রহমান ও তার অনুসারীদের সঙ্গে একরামুল আহসান কাঞ্চনের শত্রুতা সৃষ্টি হয়। সে শত্রুতার কারণেই একরামুল আহসান কাঞ্চনের বিরুদ্ধে ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায় হয়রানিমূলক মামলা দায়ের করা হয়।’
সিআইডি’র প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘একরামুল আহসান কাঞ্চনের বিরুদ্ধে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায় সর্বমোট ৪৯টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এরমধ্যে জিআর মামলা ২৩টি এবং সিআর মামলা ২৬টি। ইতোমধ্যে জিআর ১৫টি মামলা এবং সিআর ২০টি মামলায় আবেদনকারী আদালত থেকে খালাস পেয়েছেন। বর্তমানে ১৪টি মামলা আদালতে বিচারাধীন। যার মধ্যে ৮টি জিআর এবং ৬টি সিআর মামলা রয়েছে।
অধিকাংশ মামলার নথিপত্র সংগ্রহের পর পর্যালোচনা করে দেখা যায়, আবেদনকারীর বিরুদ্ধে একাধিক মানবপাচার, নারী নির্যাতন, বিস্ফোরক দ্রব্য আইন, হত্যার চেষ্টা মামলাসহ প্রতারণা, জাল-জালিয়াতি, ডাকাতির প্রস্তুতিসহ বিভিন্ন ধর্তব্য ও অধর্তব্য ধারায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলাগুলো সম্পর্কে প্রকাশ্য ও গোপনে অনুসন্ধান করে জানা যায়, অধিকাংশ মামলার বাদী, সাক্ষী, ভুক্তভোগীরা কোনও না কোনোভাবে রাজারবাগ দরবার শরিফ এবং ওই দরবার শরীফের পীরের সঙ্গে সম্পৃক্ত।’