বাঙালির মুক্তি সংগ্রামে বিচক্ষণতার সঙ্গে নেতৃত্ব দানকারী মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক এবং দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের জন্মদিন আজ (২৩ জু্লাই)। “মুছে যাক আমার নাম, তবু বেঁচে থাক বাংলাদেশ”, এরকম আদর্শে আর দৃঢ়চিত্তে দেশকে ভালোবাসতেন তিনি। নানা ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের কাণ্ডারি হয়ে ওঠা তাজউদ্দীন আহমদ ১৯২৫ সালের ২৩ জু্লাই জন্মগ্রহণ করেছিলেন ঢাকার অদূরে কাপাসিয়ার দরদরিয়া গ্রামে।
মানব সভ্যতায় জন্মদিন পালনের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, খ্রিস্টপূর্ব ৩,০০০ বছর পূর্বে প্রাচীন মিশরে ফ্যারও (Pharaoh)-রা সিংহাসনে ও ক্ষমতায় থাকার সময় থেকে জন্মদিন পালন হয়ে আসছে। পরে প্রাচীন রোমানরা সাধারণ জনগণের মধ্যে জন্মদিন প্রচলনে সাহায্য করে।
বর্তমান সময়ে সামাজিক, রাজনৈতিক ও বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে জন্মদিন পালনের প্রথা বেশ শক্তিশালী হয়েছে। দেশের সাধারণ জনগণ থেকে শুরু করে জীবিত-মৃত সেলেব্রেটি ও রাজনৈতিক নেতাদের জন্মদিনের নানা আয়োজন আমরা দেখতে পাই। তবে বেঁচে থাকতেও তাজউদ্দীন আহমদের জন্মদিনে যেমন ছিল না কোন বিশেষ আয়োজন, তেমনি বর্তমানেও অনেকটা নিভৃতে পালিত হচ্ছে তার ৯২তম জন্মদিন।
তাজউদ্দীন আহমদের কন্যা ও সংসদ সদস্য সিমিন হোসেন রিমি বাবার জন্মদিন সর্ম্পকে চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, বাবা হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদের জন্মদিন পালন বা উদযাপন করার মতো কোন সময় ও সুযোগ আমরা পাইনি। আমার বয়স যখন ১৪ তখন তাকে মেরে ফেলা হয়। আর বাবাকে আমরা নিরবিচ্ছিন্নভাবে পেয়েছি খুব অল্প সময়। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ এই সাড়ে ৩ বছর তাকে পেয়েছি কাছাকাছি।এই কাছাকাছি পাওয়ার সিংহভাগ সময় ছিল অনুভবে। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের ওই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তিনি প্রচণ্ড ব্যস্ততার মধ্যে দিয়ে সময় কাটিয়েছেন। তাজউদ্দিনের আহমদের বিভিন্ন তথ্যসূত্র দেখলে বুঝতে পারবেন, ওইসময় তিনি হয়তো কোন রাষ্ট্রীয় দায়িত্বপালনে দেশে, নয়তো বিদেশে পরিবার থেকে অনেক দূরে।
তাজউদ্দীন আহমেদ সর্ম্পকে বিভিন্ন বই থেকে জানা যায়, কিশোরবেলাতে তিনি দেশপ্রেম আর রাজনীতির দর্শন পেয়েছিলেন ব্রিটিশ রাজবন্দীদের কাছ থেকে। নিজের উন্নত জীবনযাপনের স্বপ্নপূরণের জন্য লেখাপড়া নয়, তার লেখাপড়া ও স্বপ্ন সবই ছিল দেশের মানুষের জন্য। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এমন রাজনীতি করে গেছেন, যে রাজনীতি শুধুই মানুষের জন্য। অসাধারণ মেধায় কৃতিত্বের সঙ্গে পেরিয়েছিলেন শিক্ষাজীবনের প্রতিটি ধাপ। রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে প্রচারবিমুখ মানুষটি নিজগুণে হয়ে উঠেছিলেন তৎকালীন আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ সংগঠক, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একান্ত সহযোগী। যার কার্যকর প্রমাণ ও ফলস্বরুপ নানা প্রতিকূলতার মধ্যে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারকে নেতৃত্ব দিয়ে তাজউদ্দীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে রয়েছেন।
১৯৭০ সালের কোন একদিন তাজউদ্দীন আহমদের স্ত্রী জোহরা তাজউদ্দীনকে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘ও (তাজউদ্দীন) যেন কোন কিছুতে বিরক্ত না হয়, এ ব্যাপারে কিন্তু খুব খেয়াল রাখবে। তাজউদ্দিন হলো আমাদের সম্পদ। কারণ আমাদের সব থেকে কাজের মানুষ সে।’ আর বঙ্গবন্ধু সর্ম্পকে তাজউদ্দীন বলতেন, ‘জীবনে যা অর্জন করেছি, সব মুজিব ভাইয়ের খাতায় জমা দিয়েছি’। ক্ষমতালোভীদের বিশ্বাসঘাতকতা ও ষড়যন্ত্রের ফলে শেষ জীবনে বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীনের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হওয়া ছাড়া তাদের দু’জনের মধ্যে ছিল দারুণ বোঝাপড়া। একে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধা, বিশ্বাস আর আস্থার উদাহরণ পাওয়া যায় তাদের জীবনের অসংখ্য ঘটনায়।
তাজউদ্দীন আহমেদের রাজনৈতিক ও জীবন দর্শনের কোন প্রভাব বর্তমান প্রজন্মের ওপর দেখতে পাচ্ছেন কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে সিমিন হোসেন বলেন, এই প্রশ্নের সূত্র ধরে বাবার ২২ বছর বয়সের একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করতে চাই। সেইসময়ে বাবা একটি এলাকার একটি ছেলের সঙ্গে দেড় ঘন্টা কথা বলার ঘটনা উল্লেখ করে তার ডায়েরিতে লিখে গেছেন, “বর্তমান ছাত্রসমাজ কোন না কোন নেতার পকেটে, ছাত্রদের চিন্তা ও কাজে অবশ্যই স্বাধীন হতে হবে।” (৪ আগষ্ট, ১৯৪৭, তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরি, প্রথমখণ্ড) তিনি ৪৭ সালে যে বিষয়টি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, সেই প্রেক্ষাপটে বুঝতে হবে, আমরা কী সেই পরিস্থিতি থেকে অগ্রগামী হয়েছি? নাকি উদার হয়েছি?’
তাজউদ্দীন আহমদের কন্যা ও সংসদ সদস্য সিমিন হোসেন রিমি এ প্রসঙ্গে আরও বলেন, ‘মানব সভ্যতার ইতিহাস দেখলে আমরা বুঝতে পারি যে, পৃথিবীটাতো আসলে সাজানো কোন জায়গা নয়। এখানে সব সময়ে, সবকালে প্রচেষ্টা থেকেছে উন্নত এবং আরো উন্নততর হওয়ার। আমাদের সামনে চিন্তা ও কাজে যা আদর্শ, সেই স্বপ্নকে অনুসরণ করার প্রক্রিয়া বর্তমানের প্রচেষ্টা। পৃথিবীতে সক্রেটিস প্লেটো অ্যারিষ্টটল থেকে শুরু করে জর্জ ওয়াশিংটন, জেফারসন আরো কত বরণীয় মানুষ, বর্তমান সময়ের নেলসন ম্যান্ডেলা, বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দীন এবং আরো নানা পেশার উজ্বল অভিজ্ঞতা সম্পন্ন মানুষ যারা, তারা তাদের চিন্তা ও কর্মের স্বচ্ছতা দিয়ে মানুষের মধ্যে অনুপ্রেরণা তৈরি করতে পেরেছেন, আজও পারছেন। আমি ভাবতে চাই তাদের কথা। এমনকি বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংও বাদ যান না। আমি মনে করি, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তাজউদ্দীন আহমদের জীবন-দর্শন অনুপ্রেরণার একটি উৎস। আমরা যে স্বপ্নের কথা বলি, সেখানে অনুপ্রেরণা একটি বড় ভুমিকা রাখছে, আর স্বপ্নইতো আশাবাদ। মানুষ তার স্বপ্ন বাস্তবায়নে সব সময় অনুপ্রেরণা খুঁজে লক্ষ্য পথে এগিয়ে চলে। আমাদেরও স্মরণীয়, বরণীয় সবার আদর্শ থেকে আমাদের অনুপ্রেরণা ও লক্ষ্য খুঁজে নিতে হবে। আমরা আমাদের জাতির পিতাকে স্মরণ করবো, তাজউদ্দীন আহমেদকে স্মরণ করবো। শুধু রাজনীতিকরাই না, যারা যে যে ক্ষেত্রে সফল– তাদের আদর্শ-সততার মধ্যে আমরা আমাদের স্বপ্নের অনুপ্রেরণা খুঁজবো।’
দেশের নানা প্রতিকূলতা মোকাবেলায় নতুন প্রজন্ম সবসময় নিজ তাগিদে আদর্শ ও অনুপ্রেরণা খুঁজে নেবে, এমনটা মনে করেন না তাজউদ্দীন কন্যা। বর্তমান বাস্তবতায় নতুন প্রজন্মকে অনেক সময় কিছু কিছু জিনিস যত্ন করে ধরিয়ে দেওয়াও উচিত বলে মনে করেন তিনি। বর্তমান সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সিমিন হোসেন মনে করেন, আদর্শ ও অনুপ্রেরণা তৈরিতে শুধু রাজনীতিকদের ভুমিকার চেয়ে শিক্ষা, সংস্কৃতি, ক্রিড়া, ব্যবসাসহ স্ব স্ব ক্ষেত্রে চিন্তা ও কর্মে সফল-স্বচ্ছদের বেশি বেশি এগিয়ে আসতে হবে। নেতা ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফল ব্যক্তিদের চিন্তা ও কর্মের মধ্যে স্বচ্ছতা এবং শুদ্ধতা বজায় রাখা একান্ত অপরিহার্য বলে জানান তিনি।
জীবদ্দশায় বঙ্গবন্ধুর সহযোগী ও সরকারের মন্ত্রীদের মধ্যে সবচাইতে যোগ্য, দক্ষ এবং প্রতিভাবান, পরীক্ষিত ব্যক্তি ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। ১৯৭৪ সালের ২৬ অক্টোবর স্বাধীনতা লাভের ২ বছর ১০ মাসের মাথায় নানা ঘটনার কারণে মন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দেন তাজউদ্দীন আহমদ, যাতে ছিল বঙ্গবন্ধুর সম্মতি। ওই ঘটনার মধ্যে দিয়ে বঙ্গবন্ধু-তাজউদ্দীন জুটির ভাঙ্গন ও ধীরে ধীরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নানা ট্র্যাজেডির জন্ম নেয়। বিভক্তির রাজনীতির সুযোগ নিয়ে কূচক্রিরা প্রথমে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার হত্যা করে এবং ৩ নভেম্বর জেলখানার ভেতরে তাজউদ্দীন আহমেদসহ মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করে। এই ভাঙ্গন ও হত্যাকাণ্ডকে বাংলাদেশের জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ধ্বংস করার প্রথম সফল চক্রান্ত বলেও উল্লেখ করে থাকেন অনেক রাজনীতিক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানি।
ছবি: সাকিব উল ইসলাম