‘১৯৭৩ সাল থেকে তার প্রতিটি জন্মদিনে আমি উপস্থিত থেকেছি। উনি বাসায় পার্টি করতেন। পারিবারিক সে পার্টিতে আমি থাকতাম। ৯০ অব্দি কখনও মিস করিনি। তারপর রাজ্জাক ভাইয়ের জন্মদিনের সঙ্গে আমার চিরস্থায়ী বেদনা জুড়ে গিয়েছে। একইদিনে আমার মায়ের মৃত্যু হয়। ফলে এরপর থেকে পার্টিতে অ্যাটেন্ড করা হতোনা। তবে সকালে শুভেচ্ছা জানাতে কোনদিন ভুল করিনি। ফোনে বা সরাসরি বাসায় গিয়ে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা। এবার তাকে আর সকালবেলায় ফোনে শুভেচ্ছা জানাতে পারবোনা বা বাসায় গিয়ে সরাসরি ফুল দিয়ে আসতে পারবোনা, ভাবতে কষ্ট হচ্ছে।’
নায়করাজ রাজ্জাকের ৭৭তম জন্মদিন প্রসঙ্গে অভিনেতা-প্রযোজক পরিচালক আলমগীরের কথা শুরু হয় এভাবে। সম্প্রতি এফডিসির পরিচালক সমিতির অফিসে মুখোমুখি হন চ্যানেল আই অনলাইনের। যদিও কথা ছিল তার বারিধারার অফিসে কথা হবে। কিন্তু অনিবার্য কারণে কথা বলার জায়গার বদল ঘটে। তবে যা ঘটে তা হয়ত ভালোর জন্যই ঘটে। নায়করাজকে নিয়ে বলার জন্য এফডিসির চাইতে যথার্থ জায়গা আর কি হতে পারে।
স্মৃতি রোমন্থন শুরু হয় ‘মরণের পরে’ অভিনেতার। বলে চলেন, ‘৭২ সালে রাজ্জাক ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয়। উনি আমার প্রথম অভিনীত ছবি আলমগীর কুমকুমের পরিচালনায় ‘আমার জন্মভূমি’তে ছিলেন। আমার সৌভাগ্য হল উনার সঙ্গে কাজ করার। সেই থেকে পরিচয়। প্রথম থেকেই উনি কেন যেন আমাকে একটু স্নেহ করতেন। তারপরতো আমরা বন্ধু হয়ে গেলাম। তার মানে এই নয় যে উনার কাঁধ হাত দিয়ে চলতাম। তা নয়। উনাকে সম্মান দিয়ে চলতাম। উনি তো রাজার রাজা। নায়করাজ টাইটেল পেয়েছেন। উনার অভিনয় নিয়ে আলোচনা করার ধৃষ্টতা নেই আমার। তবে মানুষ রাজ্জাক দোষে-গুণে একজন মানুষ। তবে তার গুণের পরিমান ছিল অনেক বেশি। স্পেশালি চলচ্চিত্রের মানুষের জন্য তার দারুন ভালোবাসা ছিল।’
‘জিঞ্জির’ চলচ্চিত্র অভিনেতার চোখ ছলছল করছিল। নিজেকে সামলে নিয়ে তিন বলেন, ‘আমি যখন নতুন তখন তিনি একচ্ছত্র নায়ক এ দেশের। স্নেহের পাত্র, বন্ধু-আড্ডাবাজি সবই হতো তার সঙ্গে। অনেকের অনেক স্বপ্ন ছিল তখন। কারও দিলীপ কুমার হওয়া বা কারও উত্তম কুমার হওয়ার। হ্যা আমি নায়ক হয়েছি উত্তম কুমারকে দেখে। তবে উত্তম কুমার বা দিলীপ কুমার হওয়ার শখ কোনদিনই ছিলনা। আমি বুঝতে পেরেছিলাম বাংলাদেশে টপে যেতে হলে রাজ্জাক হওয়ার স্বপ্ন দেখতে হবে। আমি সে স্বপ্ন দেখতাম। মজার বিষয় হল, এ কথাটা আমি রাজ্জাক ভাইকে সরাসরি বলতামও। বলতাম, রাজ্জাক ভাই আপনি একটু সাবধান হবেন, আপনার জায়গাটা নইলে কিন্তু আমি নিয়ে নেব। তিনি হাসতেন। আর বলতেন, আমিও দোয়া করি তুমি আমার জায়গাটা নাও। তাহলে সঠিক পাত্রে জায়গাটি যাবে।’
স্মৃতি থেকে মাণিক্য তুলে আনার ঢঙে বলে চলেন ‘গর্জন’ এর আলমগীর। বলেন, অনেকগুলো ছবি তার সঙ্গে করেছি। তারপরে দীর্ঘ বিরতিতে ছবি করিনি একসঙ্গে আমরা। আমার ব্যস্ততা এবং তার ব্যস্ততা মিলিয়ে করা হয়ে ওঠেনি। ১০/১৫ বছরের বিরতিতে তার সঙ্গে একটি ছবির প্রস্তাব আসল। ছবির নাম ‘অন্ধবিশ্বাস’। মতিন রহমানের পরিচালনা। আমি এবং রাজ্জাক ভাই দুজনেই দুজনের চরিত্র শুনে পছন্দ করলাম। ছবিটি শাবানার প্রযোজনা ছিল। ছবির প্রথম দিনেরশুটিংয়ে বলেছিলাম, রাজ্জাক ভাই অনেক দিন তো আপনার সঙ্গে কাজ করিনি। এবার কিন্তু আপনাকে ধরার জন্য আমি কাজটি করছি। উনি হেসেছিলেন। তারপর বলেছিলেন, এই সাহসটি থাকা ভালো। তুমি কাজ করে যাও। শুধু আমাকে ধরা কেন তুমি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ আর্টিস্ট হয়ে ওঠো সেই দোয়া আমি করি।’ তার সে কণ্ঠস্বর আজও শুনতে পাই আমি। আলমগীর তারপর অজানা তথ্য উন্মোচনের স্বরে বলেন, সেই চলচ্চিত্রে কাজ করার জন্য আমি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিলাম। হি ওয়াজ সাচ এ নাইস ম্যান।
বন্ধুসমতুল্য অগ্রজ নায়করাজকে নিয়ে আলমগীর এর স্মৃতিচারণে জীবন্ত হয়ে ওঠেন অনবদ্য-অনণুকরণীয়-চিরঅনুসরণীয় নায়করাজ। যিনি তার অনুজদের কাছে ছিলেন চিরভালোবাসার এবং শ্রদ্ধার।