বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। গতানুগতিক তেরো পার্বণের পর রয়েছে ফুটবল-ক্রিকেট, রাজনীতি। আর সর্বশেষ পার্বণ হচ্ছে বইমেলা। এর মধ্যে সবচেয়ে সৃজনশীল পার্বণ হিসেবে যোগ হয়েছে এই ‘বই-পার্বণ’ বা বইমেলা। ১ ফেব্রুয়ারি যে পার্বণ শুরু হয়, চলে পুরো মাস জুড়ে।
মানুষের জীবনের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বস্তু বই হলেও বই পড়ার অভ্যাস কমছে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে। টেলিভিশন, সোশ্যাল মিডিয়া, ইউটিউব, কমিক স্ট্রিপ ও অ্যানিমেশন বই পড়ার চেয়ে অনেক বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। ইন্টারনেট, অ্যান্ড্রয়েডের যুগে বইয়ের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে নতুন প্রজন্ম-যে কোনও আলোচনাতেই কান পাতলে শোনা যায় এ কথা। তারপরও বইমেলায় প্রতি দিন অসংখ্য কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীদের উপস্থিত হচ্ছে। এ দোকান থেকে ও দোকানে বই খোঁজা জানান দিচ্ছে তাঁরা বইপ্রেমী। লক্ষ্মী ঘরে আসছে প্রকাশকদেরও।
এখন অনেকেই লিখে থাকেন। সমাজে এখন অসংখ্য লেখক, অনেক প্রকাশকও। কিন্তু প্রশ্ন রয়েছে এসব বইয়ের বা লেখার মান নিয়ে।একটা নির্দিষ্ট মানে যদি লেখা না পৌঁছোয়, তাহলে তা কি ছাপা হওয়া উচিত? কিন্তু এই প্রশ্নের স্পষ্ট কোন জবাব নেই।
বেশির ভাগ প্রকাশনা সংস্থার কোন নির্দিষ্ট সম্পাদক নেই। লেখক কী লিখলেন, তথ্য ও যুক্তি কতদূর ঠিক থাকল সেটি দেখে দেওয়ার কেউ নেই। তারই ভূরি পরিমাণ ফসল ছড়িয়ে থাকে বাংলা বইয়ের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায়। আর অধিকাংশত সে সব নিয়েই বছরে এই মেলায় আসে প্রায় আড়াই থেকে তিন হাজার নতুন বই। আর ছোটবড় মিলিয়ে প্রায় ৪০০ প্রকাশক আছেন। পরিমাণটা উচ্ছ্বসিত হওয়ার মত হলেও মানের দিক থেকে বেশিরভাগ বই-ই হতাশাব্যঞ্জক। এর কারণ হিসেবে প্রকাশকরা বলেন, বাজারের কথা। তাদের মতে, বাংলা বইয়ের বাজার অত্যন্ত সীমিত। খুব কম লেখকের বই-দুইশোর বেশি চলে। ফলে প্রোডাকশন তুলনায় খারাপ হবেই।
‘প্রোডাকশন’ মানে কী? প্রচ্ছদ, বাঁধাই, কাগজ, ছাপা সাধারণ ভাবে ‘প্রোডাকশন’ বলতে এটাই বোঝেন বেশির ভাগ বাঙালি প্রকাশক। কিন্তু পাণ্ডুলিপি থেকে বই হয়ে ওঠার পুরো প্রক্রিয়াটিকেই ‘প্রোডাকশন’ বলা উচিত। সে প্রক্রিয়ায় প্রথম কাজ হওয়া উচিত পাণ্ডুলিপি ছাপতে দেওয়ার জন্য ‘তৈরি’ করা এবং বার বার প্রুফ দেখে বইয়ের টেক্সট বা মূল পাঠ্যকে বিশ্বাসযোগ্য ও নির্ভরযোগ্য করা আর সে কাজে যে কী বিপুল পরিমাণ অবহেলা দু’একটি চাল টিপে দেখলেই তা স্পষ্ট হয়। রবীন্দ্রনাথ থেকে জীবনানন্দ, শওকত ওসমান থেকে হুমায়ূন আহমেদ বাংলা সাহিত্যে এমন কেউ নেই যাঁর লেখায় প্রকাশকের কল্যাণে কমবেশি পাঠবিকৃতি না ঢুকেছে।
বাংলা বই নামক ‘প্রোডাক্ট’টির গুণমানের হাল মোটের উপর এই। আর, অনেক প্রকাশকের মতে বাণিজ্যের সঙ্গেই নাকি জড়িয়ে আছে বইয়ের গুণমান। বাংলা বইয়ের ব্যবসাটা যেহেতু সামগ্রিক ভাবে মার খাচ্ছে নানা কারণে, তাই অর্থাভাবে গুণমানের ক্ষেত্রেও বাংলা বই অনেক পিছিয়ে। হাতে গোনা দু’একটি প্রকাশক ছাড়া বাংলা বইপাড়ায় গ্রন্থ সম্পাদক বলে কেউ নেই। তারও কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে, প্রকাশকদের বক্তব্য, ‘অর্থাভাব’।
এর পাশাপাশি আছে বাংলা বইয়ের অলংকরণ। অলংকরণও এখন যেনতেন ভাবে করানো হয়। ভালো শিল্পীদের পারিশ্রমিক বেশি। তাইতো নামকা-ওয়াস্তে মানে-মতলব ছাড়া কিছু একটা অলংকরণ দাঁড় করানো হচ্ছে। বিষয়বস্তুর সঙ্গে যার মিল খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। প্রচ্ছদেরও একই হাল। পণ্যটি সুনির্মিত কিনা সেই প্রশ্ন তার বিপণনের সময় ওঠে। আর এই সুনির্মাণে অলংকরণ থেকে সম্পাদনা বই তৈরির সব দিকই জড়িত। সেখানে খামতি থেকেই যায় বইপাড়ায়।
সে কারণেই কি বইপাড়ার অধিকাংশ প্রকাশক তাকিয়ে থাকেন বইমেলার দিকে? বইমেলা তো অবশ্যই বাংলা বইয়ের ব্যবসার জন্য দরকার। বইমেলায় বই বিক্রি হওয়ার আশা যতটা না থাকে তার চেয়েও বেশি থাকে অনেক পাঠককে বই দেখানোর আশা। বেশিরভাগ প্রকাশকের সে ভাবে কোনও শোরুম নেই, ইন্টারনেটের মাধ্যমে বই বিক্রিটাও আয়ত্ত হয়নি অনেকের, ফলে বইয়ের বিপণনে এখনও বইমেলাই ভরসা।
বইয়ের পাঠক নেই বলে ভাল বই বের হয় না, ভাল বই নেই বলে পাঠকরা পড়ে না, দুর্বল বিপণনের জন্য বাণিজ্য হয় না, বাণিজ্যে মন্দা বলেই বই-পণ্যের মান নিচু, আবার নিচু মানের পণ্য বলেই বাণিজ্যও দুর্বল ডিম-মুরগি ধাঁচের এই ধাঁধাবৃত্তের প্যাঁচেই আপাতত ফেঁসে আছে বাংলা বই।
তবুও মেলা হয়, নতুন বাংলা বই, কেশর ফোলানো আরবি ঘোড়ার মতো সদ্যপ্রকাশ লিটল ম্যাগাজিনের নতুন সংখ্যার দিকে হাত বাড়ায় বাঙালি পাঠক। বইমেলায় নতুন বইয়ের পাশাপাশি পুরনো দুষ্প্রাপ্য বইয়ের পুনর্মুদ্রণও চোখে পড়ার মতো।
বইমেলায় এমন বহু মানুষ আসেন, যারা কিছু কিনতে আসেন না, আসেন বইমেলায় ফূর্তির মৌতাত নিয়ে ঘুরে বেড়াতে। অনেকে আসেন প্রিয়জনের সঙ্গে বেড়াতে। ফি বছর বইমেলায় দর্শনার্থী বাড়লেও বই বিক্রি বাড়ছে না। একুশের বইমেলায় বই বিক্রির অঙ্ক অবশ্য কখনই মেলে না। কত লোকের পায়ের ধুলো পড়ল, সেই ‘ফুটফল’-এর হিসেবে দুনিয়ার বৃহত্তম বইমেলা, অবশ্যই। কিন্তু পদধূলি দেওয়া সেই দর্শকের অধিকাংশ বই কেনার থেকে চটপটি আর তেলেভাজা খেতে বেশি আগ্রহী, এটি সর্বজনবিদিত সত্য।
কথা হলো বইমেলাকে আরও আকর্ষণীয় করতে হবে, বইপড়ায় নতুন প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। কিন্তু কীভাবে? অনেকে বলেন, এ ক্ষেত্রেও ট্রাডিশানাল মার্কেটিং অ্যাপ্রোচ ব্যবহার করা যেতে পারে। বিভিন্ন শপিংমলে দেখা যায়, দুটো জামা কিনলে তৃতীয়টা ফ্রি। ফ্ল্যাট বুক করলে ভাগ্যবানেরা অনেক সময় লটারিতে গাড়ির মালিক হন বলেও বিজ্ঞাপনে দেখা যায়। বইমেলায় ৫০০ টাকার বই কিনলে একটি লক্ষ টাকার পুরস্কার কী ঘোষণা করা যায় না? ব্যবসা বাড়াতে এ ধরনের লটারির আয়োজন করা যেতেই পারে। রোজই ৫০০ ও তার চেয়ে বেশি টাকার ক্রেতাদের নিয়ে লটারি। আর শেষ দিনে সেই বিজেতাদের নিয়ে মোটরগাড়ি জেতার মেগা-লটারি, মহা ধামাকা! বইমেলাকে এ ধরনের বিজনেস মডেলে নিতে পারলে ক্ষতি কি?
বইয়ের ক্ষেত্রেও টাইমিং একটি ফ্যাক্টর। মানুষ কিন্তু এখনও খুব বেশি ঘটমান দুনিয়ার বাসিন্দা। তাই এ হল ব্রেকিং নিউজের যুগ। ফলে সংবাদপত্রে বা সংবাদমাধ্যমের যে ঘটনা এখন দেশে-বিদেশে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে মানুষ বই পড়ার সময় সেই ‘টপিক্যালিটি’-কে বিশেষ ভাবে মাথায় রেখে চলেছে। ফলে প্যারিসের সন্ত্রাস নিয়েই এখন মানুষ চাইছে, এ ব্যাপারে বই প্রকাশিত হোক। আইএসআইএস নামক সংগঠনটি ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। আইএসআই-এর সঙ্গে এই সংস্থার সম্পর্ক কতটা ঘনিষ্ঠ এ সবই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ ব্যাপারে বই লিখলেই সেটা হয়ে যাবে বেস্ট সেলার। খবরের মতো বইকেও এখন ভাবতে হয় টাইমিং। সবাই তো কিশোর কুমারের মতো অলটাইম ফেভারিট হয় না।
আরেকটি কথা, সেটা হলো বইয়ের দাম। ইংরেজিতে জনপ্রিয় বইয়ের মাস-প্রোডাকশনে বিভিন্ন প্রকরণ (ফর্ম্যাট) আছে। প্রথমে হার্ড কভার, পরে পেপারব্যাক ইত্যাদি। কিন্তু বাংলায় সেই ফর্ম্যাট, বহুলসংখ্যক মাস-প্রোডাকশন নেই। অল্প দামের বই বলে এখন আর তেমন কিছু পাওয়া যায় না। অথচ এখনও কিছু পাঠক তো আছেই, যারা একটু সস্তায় বই খোঁজে।
বইপড়ার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সারাদেশে আবার প্রচার চালাতে হবে। শিক্ষক-অভিভাবকদের এ ব্যাপারে উদ্যোগী হতে হবে। গণমাধ্যমকে দিনে অন্তত দশবার বিষয়টি মনে করিয়ে দিতে হবে। এমনিতেই মানুষ হলো আমোদপ্রিয়। বই পড়ে মাথা ঘামিয়ে কেউ ‘সময় নষ্ট’ করতে চায় না। আর তার দরকারই বা কি? কত হাতছানি আছে! টিভিতে সিরিয়াল, খেলা, বিতর্কসভা। হাতে স্মার্টফোনে সমস্ত দুনিয়ার ফান। গরমাগরম ফিলিম তো আছেই। সবই যদি বাদ দিই তো শপিংমল আছে। আছে ফুডকোর্ট। শুধুশুধু গোমড়া মুখ করে বই পড়া আর দীর্ঘশ্বাস ফেলার কোনও মানে হয়?
বই পড়লে চেতনার প্রসার হয়, কল্পনাশক্তি জোরদার হয়, বিশ্লেষণী ক্ষমতা বাড়ে, তোমার চেনা জীবনের বাইরেকার জীবনের সন্ধান পাওয়া যায়। ও দিকে বাজারের উদ্দেশ্য হল জনমানসের চিন্তার পঙ্গুত্ব। জিনিস, জিনিস বস্তুর সাগরে ডুবিয়ে মারো চিন্তনক্ষমতাহীন মানুষ ইঁদুর। এই ব্যবস্থা প্রাচীনকাল থেকেই চলছে। অবশ্য মহাভারতের কালেও দেখা গেছে কতিপয় লোক পড়া-টরা করেছে, বাকি সব ভোগে ডুবে আছে, নয় যুদ্ধ শাণাচ্ছে।
তবু বই টিকে আছে। লেখাপড়ার পেশাগত ক্ষেত্রসীমা ছাপিয়ে কোনও কোনও ব্যক্তির প্রিয় কর্ম। তাঁরাই পুস্তকশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখছেন। কোথা থেকে শুরু এ শিল্পের? একজন ব্যক্তি যখন ভাবনাচিন্তা শুরু করেন, তিনি লিখবেন, সেই থেকে। চিন্তা গ্রাহকের হাতে পৌঁছনো পর্যন্ত পুস্তক এক বিরাট বাণিজ্যক্ষেত্র। লক্ষ্মী আর সরস্বতী। অস্বীকার করে কী লাভ? কিন্তু শিল্পের মর্যাদা কি পাচ্ছে গ্রন্থ নির্মাণ? আমরা কি জানি, কত লোক যুক্ত এই বিরাট কারবারে? লেখক বাদ দেওয়া যাক। সম্পাদক, প্রকাশক, প্রুফ রিডার, বিক্রেতা, হিসাবরক্ষক, কেরানি, অক্ষর রচনাকারী, শিল্পী, বাঁধাইকর্মী, ছাপাইকর্মী, মোটবাহক! কোনও হিসেব নেই। এত লোকের রুটি-রুজির স্বার্থেও তো বইকে, বইমেলাকে টিকিয়ে রাখার জন্য ইতিবাচক উদ্যোগ প্রয়োজন।
বই নিয়ে, বইমেলা নিয়ে, বইপড়া নিয়ে আমাদের অনেক বেশি ভাবনাচিন্তা করা দরকার। যত সমস্যাই থাকুক, বই কিনতে হবে, বই পড়তে হবে। বই কেনা আর বই পড়ার ব্যাপারে আমাদের জাতীয় অঙ্গীকার প্রয়োজন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)