নানা কারণে মানুষের মধ্যে করোনাভাইরাস প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হওয়ার পর স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই মুহূর্তে দেশে গণ-সংক্রমণ (কমিউনিটি ট্রান্সমিশন) থেকে গুচ্ছ-সংক্রমণে (ক্লাস্টার ট্রান্সমিশন) নেমে গেছে। তারপরও বৈশ্বিক মহামারির প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ করোনামুক্ত- তা বলার সময় আসেনি। কিছুটা শঙ্কা থেকেই যায়।
তারা বলছেন, শনাক্তের হার পাঁচ শতাংশ কিংবা এর নিচে থাকলে এবং চার সপ্তাহ সেই হার অব্যাহত থাকলে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে ধরে নেয়া যাবে। বাংলাদেশে গত চার সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে সংক্রমণের হার পাঁচ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে।
দেশে করোনাভাইরাস শনাক্তের দীর্ঘ প্রায় ১০ মাস পর আক্রান্ত শনাক্তের হার গত ১৪ জানুয়ারি পাঁচ শতাংশের নিচে নেমে আসে। শতাংশের হিসাবে সবশেষ এই হার ছিল গত বছরের এপ্রিল মাসে। তারপর কয়েকদিন তা কিছুটা বেশি হলেও ১৯শে জানুয়ারি থেকে সংক্রমণের হার টানা পাঁচ শতাংশের নিচে রয়েছে। এমনকি গত ১২ দিন ধরে এই হার তিন শতাংশের এদিক-ওদিক ওঠানামা করছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, দেশে গত বছরের ৮ মার্চ প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। শুরুর দিকে করোনা সংক্রমণ রাজধানীকেন্দ্রিক ছিল। রোগী শনাক্তের হারও কম ছিল। ওই বছরের মে মাসের মাঝামাঝি থেকে সংক্রমণ বাড়তে শুরু করে। আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত সেটি ২০ শতাংশের ওপরে ছিল। তারপর থেকে নতুন রোগীর পাশাপাশি শনাক্তের হার কমে যায়। কিন্তু মাস দুয়েক সংক্রমণ নিম্নমুখী থাকার পর গত নভেম্বরের শুরুর দিক থেকে নতুন রোগী ও শনাক্তের হারে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা শুরু হয়।
নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে দৈনিক নতুন রোগী শনাক্তের গড় দুই হাজার ছাড়ায়। গত ১০ ডিসেম্বর থেকে নতুন রোগী শনাক্ত এবং শনাক্তের হার কম। তিন সপ্তাহ ধরে পরীক্ষার তুলনায় রোগী শনাক্তের হার ১০ শতাংশের নিচে। চলতি বছরের অধিকাংশ দিন এক হাজারের কম রোগী শনাক্ত হয়েছে।
করোনাভাইরাস সংক্রমণের এই নিম্নমুখী ধারার মধ্যেই গত ৭ই ফেব্রুয়ারি থেকে সারাদেশে শুরু হয়েছে কোভিড-১৯ এর গণ টিকাদান কার্যক্রম।
এমন অবস্থায় দেশে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি কি স্বস্তির পর্যায়ে এসেছে? নাকি এখনও আশঙ্কা আছে? চ্যানেল আই অনলাইন এই প্রশ্নের উত্তর জানতে কথা বলেছে কয়েকজন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের সাথে।
গুচ্ছ-সংক্রমণ
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মোশতাক হোসেন চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, দেশে করোনা সংক্রমণ কমিউনিটি ট্রান্সমিশন থেকে নেমে ক্লাস্টার ট্রান্সমিশনে নেমে গেছে। সারা পৃথিবী থেকে করোনা চলে না যাওয়ার আগে আমরা করোনা মুক্ত হতে পারছি না। যে সমস্ত দেশে একেবারে শূন্য হয়েছিল সে সমস্ত দেশে আবারও হয়েছে।
‘‘আমরা গণ-সংক্রমণ (কমিউনিটি ট্রান্সমিশন) থেকে গুচ্ছ-সংক্রমণে (ক্লাস্টার ট্রান্সমিশন) নেমেছি। যদি পর পর দুই সপ্তাহ শনাক্তের হার পাঁচ-এর নীচে থাকে তাহলে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় খুলে ফেলা যায়, অর্থাৎ তখন গণ-সংক্রমণ থাকে না। এটা যদি আরও কমে শতকরা এক-এর নীচে নেমে যায় তাহলে গুচ্ছ-সংক্রমণ থেকে আমরা নেমে বিক্ষিপ্ত সংক্রমণ। এরপর যদি পর পর চার সপ্তাহ শনাক্তের হার শূন্য থাকে তাহলে সেটা বাংলাদেশের জন্য করোনা মুক্ত। তবে মহামারি যেহেতু সারা পৃথিবীতে আছে বাংলাদেশ মুক্ত থাকলেও শঙ্কা থেকে যাবে।’’
‘করোনা প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়েছে’
জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম) করোনা ল্যাবের ভাইরোলজিস্ট ডা. মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ‘‘যেহেতু করোনা শ্বাসতন্ত্রের একটি ভাইরাস, তাই হার্ড ইমিউনিটি, ক্রস ইমিউনিটি বা যে কোনো উপায়েই হোক আমরা প্রতিরোধ করার ক্ষমতা তৈরি করেছি।’’
‘শনাক্তের হার তিন-এর নীচে নামাটা আসলে বাংলাদেশ বা ঢাকার চিত্র। বাইরের ইনস্টিটিউটে তিন-এর খানিকটা উপরে। তবে সব জায়গাতেই পাঁচ-এর নীচে।’
তিনি বলেন, গত দুই তিন সপ্তাহে রাজধানীর গুলশানের একটা ল্যাবে গত দুই-তিন সপ্তাহে করোনা পজেটিভ রোগী শনাক্ত হয় নি। পজেটিভ রোগীর সংখ্যাও কমে আসছে।
নিয়ন্ত্রণের পথে করোনা
স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, শনাক্তের হার তিন শতাংশের নীচে থাকলে আমরা ধরে নিতে পারি করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে কিংবা নিয়ন্ত্রণের পথে রয়েছে।বর্তমানে আমাদের দেশে সেরকম অবস্থা বিরাজ করছে।
‘সংক্রমণ ৩ শতাংশে এলে ভাইরাস আপনা-আপনি চলে যায়’
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, করোনাভাইরাসে সংক্রমণের হার ৩-৪ শতাংশে ওঠানামা করছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বরাত দিয়ে তিনি বলেন, সংক্রমণের হার ৩ শতাংশের নিচে নামলে ভাইরাস আপনা-আপনি চলে যায়।
তাই সংক্রমণের বর্তমান হার ধরে রাখতে সবাইকে মাস্ক পরা অব্যাহত রাখার পরামর্শ দেন মন্ত্রী।
নিয়ন্ত্রণে কিন্তু শঙ্কা কাটেনি
স্বাস্থ্য বিধিগুলো বজায় না রাখলে যেকোনো মুহূর্তে পরিস্থিতি খারাপের দিকে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ডা. মোশতাক হোসেন বলেন, ‘‘সংক্রমণের হার যদি নিম্নমুখী রাখতে হয় তাহলে সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে, করোনাভাইরাসের রোগী শনাক্ত হওয়ার সাথে সাথে তাকে আইসোলেশনে রেখে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। তার যোগাযোগে আসা মানুষদের কোয়ারেন্টিন করা, এসব বিষয়ে সর্বোচ্চ মনোযোগ দিতে হবে, যেন সংক্রমণ পুনরায় ছড়াতে না পারে।’’
এ বিষয়ে নিপসম করোনা ল্যাবের ভাইরোলজিস্ট ডা. মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন বলেন, ‘‘স্বাস্থ্যবিধি আমরা কখনোই মানিনি। করোনা বোধহয় কিছুটা হলেও আমাদের স্বাস্থ্যবিধি মানতে সাহায্য করেছে। তারপরও আমরা মাস্ক পড়ি না, রাস্তায় থু-থু ফেলি। যেহেতু আমরা ঘনবসতি, বাতাসে প্রচুর ধুলাবালু তৈরি করে। তাই আমরা যদি মাস্ক ব্যবহার করি তাহলে শুধু কোভিড নয় মৌসুমী যে কোন ফ্লু থেকেও আমরা রক্ষা পাবো।’’
স্বাচিপ মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ বলেন, ‘‘আমরা যদি স্বাস্থ্যবিধি আর মাস্ক ব্যবহার করতে পারি, ভ্যাকসিন গ্রহণ করি; তাহলে দেশ থেকে কোভিড নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি নির্মূল সম্ভব।’’
দেশে গত বছর ৮ মার্চ প্রথমবারের মতো করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। তার ১০ দিন পর ১৮ মার্চ প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগীর মৃত্যু হয়।
সেই থেকে আজ পর্যন্ত করোনায় মোট মৃত্যু হয়েছে আট হাজার ২৯৮ জনের। যাদের মধ্যে পুরুষ ৬ হাজার ২৮১ জন ও ২ হাজার ১৭ জন নারী। আর সুস্থ হয়েছেন ৪ লাখ ৮৮ হাজার ৬২১ জন। চিকিৎসাধীন রয়েছেন ৪৪ হাজার ৫১৫ জন।
এখন পর্যন্ত দেশে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৫ লাখ ৪১ হাজার ৪৩৪ জন। কোয়ারেন্টাইন ও আইসোলেশনে রয়েছেন যথাক্রমে ৬ লাখ ২৪ হাজার ১৫৭ জন ও ৯৯ হাজার ৯৬৩ জন।
ছবি: তানভীর আশিক