তনুর ইস্যুতে সরগরম পুরো দেশ। কিন্তু কতদিন? একটার পর একটা ঘটে যাওয়া সমস্যার মধ্যে একটি বিষয় চাপা পড়ে যেতে খুব বেশি সময় লাগে না। সেসব কথাই এবার নিজের স্ট্যাটাসে তুলে আনলেন সাংবাদিক আরিফ জেবতিক।
ফেসবুকে তিনি একটি পোস্টে লিখেন, তনুর ছবি চোখে ভাসে। আমাদের পাশের বাড়ির মেয়েটি। আমরা যারা অলিতে গলিতে জড়াজড়ি করে বড় হয়েছি, তাদের পাশের বাড়িতে তনুরা থাকে। এরা বড় মায়া মায়া হয়, ছোটবেলা বাসার ছাদে নয়তো ছোট উঠোনে ইচিংবিচিং খেলে, একটু বড় হলে কলেজে যায়। পাড়ার আশেপাশে দুয়েকটা টিউশনি করে, কলেজে আবৃত্তি করে, কলেজ শেষ করে নাটকের দলে স্ক্রিপ্টটা খানিক পড়ে উসখুস করে, সন্ধ্যা নামে নামে প্রায়, একটা টিউশনি সেরে বাড়ি ফিরে নিজের পড়া পড়তে বসতে হবে। টেবিলটা এলেমেলো, মা বকুনি দেয়, একটা ছোট কি বড় ভাই মমতায় আগলে রাখে, বাড়ির সামনে দিয়ে সাইকেলে একটা তরুণ রোজ সকালে চলে যায়, অকারণে একটা টুং করে বেল বাজায়-
তনু আমাদের পাশের বাড়ির মেয়ে।
তনু আমাদের বোন, তনুর মতো একটা লক্ষ্মী মেয়ে হওয়ার জন্য মা আমাদের ছোটবোনটাকে বকুনি দেয়; তনু একটা হাসিখুশি মেয়ে, পাড়ার বড় ভাইরা তাকে নিয়ে খারাপ কথা বলে না বরং তুই তুকারি করে হেসে হেসে নিজের বোনের মতো আগলে রাখে, তনুর কাছে বাড়ির উঠোন আর আশপাশটা একই রকম নিরাপদ মনে হয়।
এরপর সেই বিভৎস দিনের কথা উল্লেখ করে কথাসাহিত্যিক আরিফ জেবতিক লিখেন, তারপর- একদিন তনুর লাশ পাওয়া যায় সেই নিরাপদ সীমানার মধ্যে। তারপর প্রতিদিন তনুকে বারবার মরতে হয়। তনুর বাবা-মাকে বারবার হয়রানিতে পড়তে হয়, তনু মরে গিয়ে তাদেরকেও মেরে রেখে যায়। তনুর যে ভাইটি প্রথম মিছিল করেছিল, সে গুম হয়ে যায়। তনু মরে গিয়ে তাকেও মেরে রেখে যায়। তনুর লাশ কবর থেকে তুলে এনে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে নবিশ ডাক্তার। একজোড়া বুটের নিচের থেঁতলে যাওয়া ঘাস কে যেন পরিস্কার করে ফেলে সেই ঝোঁপের মধ্যে। মিডিয়া ব্ল্যাক আউট হয়ে যায় ধীরে ধীরে।
এরপরে আরো বেশি পরিবর্তনের কথা উল্লেখ করে এই ব্লগার লিখেন, তারপর নিত্যনতুন ইস্যু আসে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হাজার কোটি টাকার খবরটা ভুলে যাই দ্রুতই। মুশফিক বেয়াদবি করেছে, আমাদের আহত মোড়ালানুভূতি নিয়ে আমরা সেখানে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। ওয়েস্ট ইন্ডিজ চ্যাম্পিয়ন, চার বলে চার ছক্কা। হইচই। বাঁশখালিতে পুলিশের গুলিতে মরে গেছে ৫ জন গ্রামবাসী। এসব নিয়ে আমারও লেখার কথা। তনু এখন ইতিহাস। তনুকে হজম করে ফেলেছে রাষ্ট্র। আমার দরকার নতুন ইস্যুগুলো নিয়ে কিছু লেখা। অথচ, আমি লিখতে পারি না।
তনু আমার বোন ছিল। তনুকে হজম করে ফেলেছে রাষ্ট্র। তনু হত্যার খুনিরা অধরাই রয়ে যাবে। দুয়েকটা রাগী তরুণ প্ল্যাকার্ড উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে রাস্তার মোড়ে। প্রাপ্তি বলতে এর বেশি কিছু নেই। অন্যকিছু নিয়ে লিখতে চাই। নিজের আঙুলগুলোর দিকে তাকাই। আঙুলে জোর নেই। লাথি দিয়ে যদি সব উল্টে পাল্টে দিতে পারতাম-কিন্তু পায়ে সেই জোর কই? শক্তিহীন হাত-পা নিয়ে স্থবির পড়ে থাকি। তনু মরে গিয়ে আমাদেরকেও মেরে রেখে গেছে। আমাদের শক্তিহীনতাকে এভাবেই উলঙ্গ করে দিয়ে গেছে বোনটা আমার।