দেশের সফটওয়্যার খাতের সবচেয়ে বড় সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড সার্ভিসেসের (বেসিস) ২০১৬-১৯ মেয়াদে কার্যনির্বাহী কমিটির নির্বাচন হবে আগামী ২৫ জুন। এ নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিটি প্যানেল তাদের নিজেদের পক্ষে ভোটারদের টানতে দিচ্ছেন নানা প্রতিশ্রুতি ও আশ্বাস। শুধু যে প্রচার-প্রচারণা চলছে এমনটা না। সুযোগ মতো নির্বাচনে যেমন ব্যক্তিগত আক্রমণ করা হয় এখানেও তেমনটাই হচ্ছে। অপপ্রচারও চলছে সমানতালে।
এ নির্বাচনে যে দুটি প্যানেল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে তার মধ্যে জাতিসংঘের প্রযুক্তি ব্যাংকের বাংলাদেশ প্রতিনিধি মাইক্রোসফট বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সোনিয়া বশির কবিরের নেতৃত্বে ‘দ্যা চেঞ্জ মেকার্স’ একটি। নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই যেন একজন নারীকে বেসিসের নেতৃত্বে মানাবে না বা তিনি নেতৃত্ব দিতে পারবেন না এমন অদ্ভুত সব অপপ্রচার চলছে অনলাইন জুড়ে। শুধু তাই নয় এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিদেশী কোম্পানির জুজুর ভয়। তিনি যদি নির্বাচিত হন তবে নির্বাসিত হবে দেশীয় প্রযুক্তি খাত এমন ধোঁয়া তোলা হচ্ছে। অনেকেই নিজ ফেসবুক ওয়ালে এবং বিভিন্ন অনলাইন ও পত্রিকায় কলাম লিখে প্রচার চালাচ্ছেন এই রকম। ভোটারদেরকে বিভ্রান্ত করতে সেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মতো অবস্থা হবে দেশীয় সফটওয়্যার কোম্পানির এমন বিভ্রান্তিও ছড়ানো হচ্ছে।
সোনিয়া বশির কবিরের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের যুক্তি খণ্ডনের আগে আমাদের সাধারণ কিছু বিষয় জানা দরকার। যেমন, এ দেশের কর্পোরেট সেক্টর বহুজাতিক কোম্পানিগুলোতে ভারতীয়-পাকিস্তানি সিইও-এমডি দেখে আমরা এতদিন অভ্যস্ত। একজন স্বদেশী নারীকে এ পদে দেখে অনেকেই পরশ্রীকাতরতায় ভুগছেন। আর আজ যখন সেই নারী বেসিসে একটি প্যানেলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন অনেকেরই তখন পুরুষত্বে আঘাত লাগছে। তারা সমস্বরে জাত গেল জাত গেল বলে চেঁচাচ্ছেন।
তার বিপক্ষে যারা ভোট করছেন তারাই কিন্তু মাইক্রোসফটকে বেসিসের সদস্য পদ দিয়েছেন। সেই গোষ্ঠীই ছিল এক্সিকিউটিভ কমিটিতে। যে ভোট দিতে পারে সে ভোটও করতে পারে, এমনই লেখা রয়েছে বেসিসের গঠনতন্ত্রে। এতদিন যখন মাইক্রোসফট প্রতিনিধি ভোট দিয়ে এসেছেন তখন কোনো কথা হয়নি। ভোটে দাঁড়াতে গেলেই সব গেল গেল হৈ হুল্লোড়, মাইক্রোসফটের এমডি নির্বাচন করেন! তাহলে দেশের সফটওয়্যার ফার্মের কি হবে বলে সমস্বরে সবাই চিল্লাতে শুরু করে দিলেন।
বেসিসের নির্বাচনে ব্যক্তি সোনিয়া বশির কবির নির্বাচন করছেন। মাইক্রোসফট নয়। ভোট দেয়া হবে সোনিয়া বশির কবিরকে। তার প্রতিষ্ঠানকে নয়। ব্যালটে সোনিয়া বশির কবিরের নাম থাকবে, তার কোম্পানির নাম নয়। যারা তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়ে ভাবছেন, এই বেনিফিট নিয়ে জিতবেন। তারা আসলে মস্ত বড় ভুল করছেন। ভোটাররা ভোট দেয়ার সময় দেখেন প্রার্থীর ব্যাকগ্রাউন্ড, তার ক্যাপাসিটি, তিনি যে কথা বলে নির্বাচন করছেন এটা বাস্তবায়ন করার ক্ষমতা বা যোগ্যতা আছে কি না এ সব দেখেন। তিনি কোন কোম্পানির সেটা নয়।
সফটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রি একটা গ্লোবাল ইন্ডাস্ট্রি। লোকাল ইন্ডাস্ট্রি আর লোকাল মার্কেট বলে গেলে দিনদিন পিছিয়েই পড়তে হবে। সব কিছু দেখে শুনে মনে হচ্ছে এতই দেউলিয়া হয়ে পড়েছে আমাদের কর্পোরেট দুনিয়া যে একজন সফল ব্যক্তিকে আটকানোর জন্য নারীর সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ।
দেশের আইটি সেক্টরে সোনিয়া বশির কবিরতো নতুন কোনো নাম নয়। নিজ নামেই তিনি খ্যাত। বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা ক্রিকেট দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন। চাকরি করছেন সিলিকন ভ্যালিতে। দেশে ফিরে নিজের স্টার্টআপ শুরু করেছেন। বিশেষ মহলের লোকগুলোর সোনিয়া বশিরের সাথে পরিচয় কিন্তু সেই কোম্পানির সূত্র ধরেই। অথচ সেই তথ্য ভুলে যাওয়ার ভান করে মাইক্রোসফটের নামে জুজুর ভয় দেখাচ্ছেন বেসিসের ভোটারদের।
আবারো মূল প্রসঙ্গে দেখা যাক। সোনিয়া বশির কবিরকে যারা ‘মাইক্রোসফটের এমডি’র নামে নেগেটিভ ব্র্যান্ডিং করছেন তারা কীভাবে তিনি আসার পরে এই বহুজাতিক কোম্পানিটির সামাজিক কার্যক্রমের কথা অস্বীকার করছেন! সোনিয়া বশির কবির একজন বাংলাদেশী নারী হয়ে বাংলাদেশকে সব সময় অগ্রাধিকার দিয়ে আসছেন। তিনি এই দায়িত্বে আসার পর থেকে সামাজিক উন্নয়নে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন। তিনি নারীদের শিক্ষা বিস্তারে যেমন ভূমিকা রেখে আসছেন সেই সঙ্গে বর্তমান সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচী বাস্তবায়নেও বড় ভূমিকা রাখছেন। তিনি ইয়াং বাংলা নামে একটি প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে যুক্ত থেকে এই দেশের তরুণদেরকে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পে দক্ষ কিছু কর্মী তৈরি করতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।
সোনিয়া বশির কবিরের সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় জানতে পারলাম, তার পরবর্তী কার্যক্রম সম্পর্কে। তিনি মাইক্রোসফট এর পক্ষ থেকে বাংলাদেশের স্কুলগুলোতে কম্পিউটার ল্যাব প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিতে যাচ্ছেন। একটা বিষয়ে না বললেই না, আর তা হলো মূল মাইক্রোসফটই এখন আর তাদের সফটওয়্যার ব্যবসার থেকে বেশি বেশি করে সামাজিক ব্যবসার দিকে ঝুঁকছে। সেখানে বাংলাদেশের মতো ছোট একটি বাজারে ইস্ট ইন্ডিয়ার মতো ব্যবসা করবে এমনটি ভাবার কারণ নেই। সেই সুযোগও নেই হয়তো। তার প্রমাণ হিসেবে বলা যায় গত সপ্তাহেই মাইক্রোসফট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম লিঙ্কইনড কিনে নিয়েছে। সেখান থেকেই বোঝা যায় তাদের মূল ব্যবসার লক্ষ্য বা ঝোঁক এখন কোন দিকে যাচ্ছে।
তিনি বাংলাদেশে আসার আগে কোম্পানিটি শুধু লাইসেন্স বিক্রি করলেও তার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে অনেক কাজই করেছেন। তারই স্বীকৃতি হিসেবে আজ তিনি জাতিসংঘে প্রতিনিধিত্ব করছেন বাংলাদেশের হয়ে, মাইক্রোসফটের হয়ে নয়।
ব্যক্তি সোনিয়া বশির সম্পর্কে যতটুকু জানি বেসিস থেকে তার নেয়ার কিছু নেই। তার অভিজ্ঞতা-প্রজ্ঞা-নেতৃত্ব ভীষণ প্রয়োজন এই শিল্পের জন্যে। বেসিস একটা জায়গায় এসে পৌঁছেছে। এখন এই ট্রেড বডিকে আরো অনেক দূর পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার দরকার। যার জন্য সোনিয়া বশির কবিরের চেয়ে এই মুহূর্তে আর কোনো বিকল্প নেই।
বেসিসের ভোটাররা বিজ্ঞ। শিক্ষিত লোকের সাধারণ গুণাবলীতে সরল মনের। তাদের হয়ত সাময়িকভাবে বিভ্রান্ত করা যাবে। কিন্তু দিন শেষে তারা সঠিক সিদ্ধান্ত নিবেন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)