ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য নির্বাচন ঠেকাতে একদিকে সরকারপন্থী নীল দলের শিক্ষকদের একটি অংশের বিরোধিতা; অন্যদিকে বিএনপি-জামায়াতপন্থী সাদা দলের শিক্ষকদের বর্জন। এরমধ্যেই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে পরবর্তী উপাচার্য নির্বাচনের জন্য সিনেটের বিশেষ অধিবেশন।
১৫ জন রেজিস্টার্ড গ্রাজুয়েটের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৪ জুলাই উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন করতে ঢাবি সিনেটের বিশেষ অধিবেশন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে হাইকোর্ট যে স্থগিতাদেশ দিয়েছিলেন; ২৬ জুলাই তা স্থগিত করে দেন আপিল বিভাগ।
আপিল বিভাগের এ আদেশের পর অধিবেশন অনুষ্ঠানের পক্ষের আইনজীবীদের দাবি: এর ফলে আগামী ২৯ জুলাই অধিবেশন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে আর কোন আইনি বাধা নেই। নির্ধারিত সময়েই হবে সিনেটের বিশেষ অধিবেশন।
ওই অধিবেশনেই উপাচার্য হবেন এমন তিনজনের একটি প্যানেল নির্বাচন করবেন সিনেট সদস্যরা। সেই প্যানেল থেকে একজনকে পরবর্তী চার বছরের জন্য উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেবেন রাষ্ট্রপতি।
তবে ১০৫ সদস্য বিশিষ্ট সিনেটের ২৫ জন রেজিস্টার্ড গ্রাজুয়েট প্রতিনিধিসহ ৫০ জন সদস্য না থাকায় উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের বিশেষ অধিবেশন নিয়ে যে প্রশ্ন উঠেছে, সে প্রশ্ন চার বছর আগেও উঠেছিল। সেই বিতর্কের মধ্যেই সেবার দ্বিতীয় মেয়াদে উপাচার্য নির্বাচিত হন অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক।
২০১৩ সালের ২৪ আগস্ট অনুষ্ঠিত ওই বিশেষ অধিবেশনের আগেও মেয়াদ না থাকায় ৫৫ জন সিনেট সদস্য ছিলেন না। মেয়াদ থাকা ৫০ জন সিনেট সদস্যের মধ্যে ৩৬ জনের উপস্থিতিতে সে সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেখান থেকে অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, অধ্যাপক ড. সহিদ আখতার হুসাইন এবং অধ্যাপক ড. নাসরীন আহমেদের সমন্বয়ে তিন সদস্যের প্যানেল নির্বাচন করেন সিনেটররা। তিন সদস্যের ওই প্যানেল থেকে অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিককে পরবর্তী চার বছরের জন্য নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ। তার মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী ২৪ আগস্ট।
উপাচার্য নির্বাচন নিয়ে ৫০ জন সিনেট সদস্য না থাকায় বর্তমানে যে দৃশ্যপট সৃষ্টি হয়েছে তা প্রায় হুবহু মিলে যায় চার বছর আগের দৃশ্যপটের সঙ্গে। কিন্তু পার্থক্য হচ্ছে সিনেটে ৮ জন প্রতিনিধি নিয়ে বিএনপি-জামায়াতপন্থী সাদা দল সে অধিবেশনের বিরোধিতা করলেও এককাট্টা ছিল আওয়ামী-বাম সমর্থিত নীল দল। কিন্তু এবার সাদা দলের সঙ্গে এ অধিবেশনের বিরোধিতা করছে নীল দলের একটি অংশও। তাই এবারের প্রেক্ষাপট গতবারের চেয়ে আলাদা।
নির্বাচন ঠেকাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা ‘নীল বিদ্রোহীদের’
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে জানা যায়, আসন্ন উপাচার্য নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এতদিন আরেফিন সিদ্দিকের কাছের মানুষ হিসেবে পরিচিতি শিক্ষকদের একটি গ্রুপ তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। সিনেট নির্বাচনে পাল্টা প্যানেল দেওয়াসহ উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন বন্ধ করতে সব চেষ্টাই করে যাচ্ছেন আওয়ামীপন্থী নীল দলের এই গ্রুপটি। এমনকি পাল্টা প্যানেল দিলেও নির্বাচন কমিশনে তা বাতিল হয়ে যাওয়া এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপে সে বিরোধের আপাত সমাধান হয়েছে। তবে সিনেটে বিদ্রোহী গ্রুপের কোন প্রতিনিধি না থাকায় তাদের বিরোধিতা করার সুযোগও সঙ্কুচিত হয়। শেষ পর্যন্ত তারা আদালতের দ্বারস্থ হন। হাইকোর্ট তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষ ওই অধিবেশনে স্থগিতাদেশ দিলেও আপিল বিভাগ তা স্থগিত করে দেন। এই গ্রুপের নেতৃত্বে আছেন অধ্যাপক সামাদ, অধ্যাপক সাদেকা হালিম অধ্যাপক এমরান কবীর চৌধুরী প্রমুখ।
উপাচার্যের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়মনের অভিযোগ এনে অধ্যাপক মুহাম্মদ সামাদ এবং অধ্যাপক সাদেকা হালিম চ্যানেল আই অনলাইনকে জানান, কোন ফোরামেই আমাদের কথা বলার সুযোগ না থাকায় আমরা আদালতের দ্বারস্থ হয়েছি। আমরা আমাদের আইনী লড়াই চালিয়ে যাবো।
সাদেকা হালিম চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: সিনেটে শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচনে আমাদের ১৫ জন সদস্যের নাম ছিল। কিন্তু রাতের আধারে সেই ১৫ জনকে বাদ দিয়ে বিএনপি জামায়াতের ১৫ জনকে যুক্ত করা হয়।
“আমাদের প্রার্থিতা বাদ দেওয়ায় আমরা আইনী লড়াইয়ে যেতে পারতাম। কিন্তু আমাদের আশা ছিল রেজিস্টার্ড গ্রাজুয়েট প্রতিনিধি নির্বাচনে তিনি (উপাচার্য) আমাদের যুক্ত করবেন। কিন্তু সেটা না করে (রেজিস্টার্ড গ্রাজুয়েট প্রতিনিধি নির্বাচন না দিয়ে) তিনি উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করলেন। তাই আমরা হাইকোর্টে রিট করি।”
অধ্যাপক মুহাম্মদ সামাদের দাবি, কোন ব্যক্তিগত স্বার্থে নয়। বরং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে যে ‘অনিয়ম’ চলছে তার বিরুদ্ধেই আমাদের লড়াই।
তবে নীল দলে কোন বিভক্তি নেই বলে দাবি করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. মোঃ রহমত উল্লাহ এবং নীল দলের যুগ্ম আহবায়ক এবং সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ভারপ্রাপ্ত ডিন অধ্যাপক ড. এ জে এম শফিউল আলম ভুঁইয়া।
অধ্যাপক রহমত উল্লাহ চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: নীল দলে কোন বিভক্তি নেই। কিছু মুষ্টিমেয় লোক নীল দলের নাম ব্যবহার করে বিরোধিতা করছে কেবল তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য।
বিরোধিতাকারীদের উদ্দেশ্যে এ শিক্ষক নেতা বলেন: শিক্ষক হিসেবে আপনাদের দায়িত্ব শিক্ষাদানের পাশাপাশি প্রশাসনকে সহায়তা করে যাওয়া। আপনাদের কোন দাবি দাওয়া থাকলে সেটা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ফোরামে বলতে পারেন। তা না করে আপনারা প্রশাসনের অভ্যান্তরীণ ব্যাপার পাবলিক করতেই বেশি ব্যস্ত।
‘‘প্রশাসনের ওপর আস্থা না থাকলে আপনাদের উচিত নিজেদের পদ ছেড়ে দিয়ে তার প্রতিবাদ করা।
নিজেরা পদ আঁকড়ে পড়ে আছেন কেন?” প্রশ্ন রাখেন অধ্যাপক রহমত উল্লাহ।
নীল দলে কোন ধরনের বিভক্তি নাকচ করে অধ্যাপক ভূঁইয়া চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: আমাদের দলে আসলে কোন বিভক্তি নাই। যারা পাল্টা প্যানেল দিচ্ছে বা আইন আদালত করছে এটা তাদের ব্যক্তিগত বিষয়।
কেন তারা উপাচার্য বিরোধী শিবিরে
২০১৩ সালের উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের প্রস্তাবকারী এবং সমর্থনকারী দুই শিক্ষকই এবার উপাচার্যবিরোধী শিবিরে। এরা হলেন ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল এবং অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ।
এর মধ্যে অধ্যাপক মাকসুদ কামাল বর্তমানে আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস অনুষদের ডিন, ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট বিভাগের চেয়ারম্যান, মাস্টার দা’ সূর্যসেন হলের প্রভোস্ট, শিক্ষক সমিতির সভাপতি, শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সদস্যসচিব এবং সিন্ডিকেট সদস্যের মত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে রয়েছেন।
সদ্য সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিনের পদ ছাড়া অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিনি আহমেদও একাধিক মেয়াদে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন, শিক্ষক সমিতির সভাপতি, শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সভাপতি, সিনেট সদস্য এবং সিন্ডিকেট সদস্যের মত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন।
নিজের অবস্থান পরিবর্তনের কারণ ব্যাখ্যায় অধ্যাপক মাকসুদ কামাল চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: নীল দলের স্বার্থেই আমাকে অবস্থান পরিবর্তন করতে হয়েছে। কারণ সিনেটের শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচনের নীল দলের আহ্বাবায়ক কমিটি মনোনীত প্যানেল থেকে ১৪ জনকে বাদ দেওয়া হয়। এটা আমিসহ অনেকেই মেনে নিতে পারিনি বলেই আমরা তাৎক্ষণিকভাবে পাল্টা প্যানেল দেই।
মাকসুদ কামালের দাবি, তিনি নিজে উপাচার্য হবার জন্য অারেফিন সিদ্দিকের বিরোধিতা করছেন না “ওই রকম কোন ইচ্ছা আমার ছিল না। যারা অভিযোগ করেন তারা অনিয়মকে ঢাকতেই এমন অভিযোগ করছেন।”
অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন: শিক্ষক নিয়োগ এবং নীল দলের প্যানেল নির্বাচন নিয়ে যে খারাপ নজির স্থাপন করা হয়েছে এমনটি আগে কখনও হয়নি।
গত সিনেট নির্বাচনে তিনিই প্যানেলের প্রস্তাবক ছিলেন মনে করিয়ে দিলে তিনি বলেন: তখন আমরা ভেবেছিলাম ভবিষ্যতে হয়তো সবকিছু ঠিক মত চলবে। কিন্তু পরবর্তীতে তেমনটি হয়নি।
অবসরকালীন ছুটিতে যাওয়া অধ্যাপক ফরিদের দাবি, তারও কোন ব্যক্তিগত স্বার্থ নেই।
সাদা দলের বয়কটের সিদ্ধান্ত
২৫ জন রেজিস্টার্ড গ্রাজুয়েট প্রতিনিধিসহ ৫০ জন সিনেট সদস্যের পদ শূন্য রেখে সিনেট অধিবেশন আহ্বান করার বিষয়টি ইস্যু করে সিনেট অধিবেশন বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সাদা দল।
বুধবার রাতে সাদা দলের এক বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে দায়িত্বশীল সূত্রে নিশ্চিত হয়েছে চ্যানেল আই অনলাইন। শুক্রবার সকালে বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন করে সাদা দল তাদের এ সিদ্ধান্ত আনুষ্ঠানিকভাবে জানাবে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
এ ব্যাপারে সাদা দলের অন্যতম নেতা এবং সিনেট সদস্য অধ্যাপক ড. লুৎফর রহমান চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: আমরা আগামী শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে আমাদের সিদ্ধান্ত জানাবো।
সিনেটের সর্বশেষ হাল
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশের ২০(১) ধারার বিভিন্ন উপধারা অনুযায়ী সিনেটের নির্বাচিত এবং মনোনীত মোট সদস্য সংখ্যা ১০৫ জন। বর্তমানে রেজিস্টার্ড গ্রাজুয়েট প্রতিনিধিদের ২৫টি এবং ছাত্রদের ৫ জন প্রতিনিধিসহ মোট ৫০টি পদই শূন্য রয়েছে। অন্যদিকে ৩৫ জন নির্বাচিত শিক্ষক প্রতিনিধি, সরকার মনোনীত পাঁচজন, বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য মনোনীত পাঁচজন, স্পিকার মনোনীত পাঁচজন সংসদ সদস্য প্রতিনিধি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, দুই উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ এবং নিবন্ধকের পাঁচটি পদসহ মোট ৫৫ জন প্রতিনিধি বর্তমানে বহাল রয়েছেন।
নিয়ম অনুযায়ী সিনেটের কোন অধিবেশনের কোরাম পূর্ণ হতে ২৫ জন সদস্যের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক। তাই বর্তমান যে সংখ্যক সদস্য বহাল রয়েছেন উপাচার্য চাইলে যে কোন সময় অধিবেশন আহ্বান করতে পারেন। তাতে নিয়মের ব্যত্যয় বা আইনের লঙ্ঘন হওয়ার সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন এ বিষয়ে অভিজ্ঞ একাধিক সিনিয়র অধ্যাপক।
আর নির্বাচিত ৩৫ জন শিক্ষক প্রতিনিধির মধ্যে ৩৩ জনই নীল দলের। দুই জন প্রতিনিধি আছেন সাদা দলের।
উপাচার্য যা বললেন
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: সিনেট একটি চলমান বডি। কোন একটি অংশের প্রতিনিধি না থাকলে সিনেট কখনও অকার্যকর থাকে না। সিনেট চলবে তার নিজস্ব নিয়মে। রেজিস্টার্ড গ্রাজুয়েট বা অন্য যেকোন অংশের প্রতিনিধি না থাকলেও সিনেট অধিবেশন বসার ক্ষেত্রে আইনী কোন বাধা নেই।