চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

ঢাকা সিটির দুই মেয়রই পেরেছেন, পারবেন

ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের দুই মেয়রের দু’বছর পূর্ণ হয়েছে সম্প্রতি। ২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল অনুষ্ঠিত মেয়র নির্বাচনে জয়ী হয়ে উত্তরে মেয়র আনিসুল হক এবং দক্ষিণে মোহাম্মদ সাঈদ খোকন নগরবাসীর সেবা করার জন্যে অঙ্গীকারবদ্ধ হন। নির্বাচনের সপ্তাহখানেক পরেই ৭ মে দুই মেয়র প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের শাপলা সম্মেলন কেন্দ্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে শপথ গ্রহণ করেন। শপথ গ্রহণ শেষে দুই মেয়রই সেদিন প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন, যানজট মুক্ত পরিচ্ছন্ন সৌন্দর্যময় নগর তৈরিতে নিবেদিত হয়ে তারা কাজ করবেন। আর এ কাজের জন্য তারা নগরবাসী এবং অন্যান্যদের সহযোগিতা চান। নগরের মানুষের সেবাটা নিশ্চিত করাই তাদের লক্ষ্য।

২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল অনুষ্ঠিত সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন হয়েছিল দলীয় প্রতীকের বাইরে। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে টেবিল ঘড়ি প্রতীক নিয়ে জয়ী হয়েছিলেন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, টেলিভিশনের প্রিয়মুখ আনিসুল হক। বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী তরুণ তাবিথ আওয়ালকে হারিয়েছিলেন তিনি। অন্যদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে ইলিশ প্রতীক নিয়ে জয়ী হন প্রয়াত মেয়র মোহাম্মদ হানিফের ছেলে মোহাম্মদ সাঈদ খোকন। তিনি বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী সাবেক মন্ত্রী মীর্জা আব্বাসকে পরাজিত করেন।

বলতে দ্বিধা নেই, ঢাকার দুই মেয়রই স্মার্ট, চিন্তা-চেতনায় অগ্রগামী এবং আধুনিক মানুষ। ভীষণরকম কর্মমুখরও তাঁরা। দুজনই পরবর্তীতে পূর্ণমন্ত্রীর পদমর্যাদাও লাভ করেন। বিএনপিপন্থী বিভিন্ন সিটি কর্পোরেশনের মেয়রদের জেল খাটতে খাটতে যখন জীবন দুর্বিষহ তখন এ দুজন মেয়র অবশ্য সোনায় সোহাগা। রাজনৈতিক কোনো ঝামেলা বা বাড়তি টেনশন নেই। ক্ষমতা হাতবদলের কোনো ঝুঁকিও নেই। ফলে দু’জনই গত দুটি বছর ভীষণ নির্বিঘ্নে, নির্বিবাদে কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন। এত সুন্দর সুযোগ এর আগে কেউ পেয়েছেন বলে মনে হয় না।

গত দু বছরে ঢাকার দুই মেয়র নগরবাসীর জন্যে আসলে কী করেছেন? এমন প্রশ্ন অবান্তর বা অযৌক্তিক নয়। দুবছর সময়ও কম নয়। মূল্যায়নের প্রশ্নে হয়ত একেকজন একেকরকম বলবেন। তবে বড় দাগে বললে অনেকক্ষেত্রেই তারা সফল হয়েছেন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে চমৎকার কিছু পরিবর্তনও আনতে সক্ষম হয়েছেন। দৃশ্যমান উন্নয়ন তারা কিছুটা হলেও করতে পেরেছেন। বিশেষ করে নগর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার ক্ষেত্রে দুই মেয়রের কার্যকর উদ্যোগসমূহের প্রশংসা করতেই হয়। বলা যায়, কোরবানি ঈদে বর্জ্য অপসারণের পরীক্ষায় পাশ হওয়ার পর সত্যিই এখন আর নগরে যত্রতত্র ময়লার স্তুপ নেই, দুগন্ধ নেই। ময়লা ফেলার জন্যে নগরীর বিভিন্ন পয়েন্টে মিনি ডাস্টবিন আর ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন বা এসটিএস স্থাপন করা হয়েছে। এক্ষেত্রে দক্ষিণের চেয়ে উত্তর সিটি কর্পোরেশন বেশি অগ্রগতি দেখিয়েছে বললে ভুল হবে না। উত্তর সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে পাড়া-মহল্লার পার্কগুলোকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে নতুন করে সাজানোর উদ্যোগও লক্ষণীয়। পাড়া মহল্লার পার্কগুলো এক অর্থে মাদকসেবীদের আস্তানাতে রূপ নিয়েছিল। এখন সেগুলোতে সাধারণ মানুষ কিছুটা হলেও উঠাবসা করতে পারছেন।

মোহাম্মদপুরের মেথর প্যাসেজগুলো যেভাবে পরিস্কার করা হয়েছে এর আগে কেউই বিষয়টিকে এভাবে গুরুত্ব দিয়েছে বলে মনে হয়নি। ঘোষণা দিয়ে এভাবে পরিষ্কারও করা হয়নি। মেথর প্যাসেজগুলো এখন আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। মেথর প্যাসেজগুলো পরিষ্কার রাখার অনুরোধ জানিয়ে প্রতি শুক্রবার জুম্মার নামাজের আগে নির্দেশনাও দেওয়া হচ্ছে। পাবলিক টয়লেটের কথা উল্লেখ না করলেই নয়। পাবলিক টয়লেটের অভাবে নগরীর চলমান হাজার হাজার মানুষের আগে যত্রতত্র মলমূত্র ত্যাগের বিকল্প কোনো পথ ছিল না। ফলে নগরীর জনবহুল এলাকাগুলো (ফার্মগেট, গুলিস্তান, গাবতলি) মলমূত্রে সয়লাব হয়ে যেত। কিন্তু সেখানে রীতিমতো বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা হয়েছে। উত্তর এবং দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন জনবহুল পয়েন্টে আধুনিক টয়লেট স্থাপন করা চলমান নগরবাসীর বহুদিনের চাহিদা পূরণ করা হয়েছে। একই সাথে আধুনিক টয়লেট এবং ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি নগরীর শ্রীবৃদ্ধিও করেছে। টয়লেটগুলো পরিচালনায় স্থানীয় জনগণকেও সম্পৃক্ত হয়েছে। ব্যবস্থাপনা পদ্ধতিতে কমিউনিটি সম্পৃক্ত হওয়ার কারণে বিষয়টি যে টেকসই হবে এতে কোনা সন্দেহ নেই।

দুই সিটি মেয়রই ফুটপথগুলো দখলদার থেকে উদ্ধারে সোচ্চার থেকেছেন। কখনও কখনও অমানবিক হয়েও তাঁরা চেয়েছেন ফুটপাথটা জনগণের কাছে ফেরত দিতে। রাজনৈতিক শক্তির আড়ালে ফুটপাথ বাণিজ্য সম্পর্কে সবারই জানা আছে। হকারদের মানবিক বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে পল্টন, গুলিস্তান, মতিঝিল, দিলকুশাসহ বিভিন্ন ব্যস্ততম এলাকার ফুটপাত দুই মেয়র দখলমুক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন। এর আগে ফুটপাত দখলমুক্ত হলেও কয়েকদিনের মধ্যেই দেখা গেছে তা পুনরায় দখল হতে। সেটা যাতে না হয় সে ব্যাপারে অবশ্যই দুই মেয়রকে নতুন কৌশল অবলম্বন করতে হবে। ফুটপাথ দখল এবং যত্রতত্র পার্কিং বিষয়ে আরো কঠোর হওয়ার বিকল্প নেই।

দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে তুলনায় উত্তরের মেয়র আনিসুল হক অনেকগুলো বিপ্লবী কাজ করেছেন বললে ভুল হবে না। এর মধ্যে অন্যতম একটি হলো নগর বিলবোর্ড অপসারণ। নতুন দুই মেয়র আসার আগে বিলবোর্ড গিলে ফেলেছিল গোটা শহর। অনেক দুর্ঘটনার কারণও ছিল বিলবোর্ড। অবৈধ বিলবোর্ডের বিরাট এক বাজার তৈরি হয়েছিল। সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তা আর স্থানীয় পর্যায়ের কিছু চলমান রাজনীতিক নগরীর মানুষকে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে এই ব্যবসাটি পরিচালনা করে আসছিল। মেয়র আনিসুল হক সত্যিই বিলবোর্ডগুলোকে অপসারণ করে অসাধ্যকেই সাধন করেছেন। একইভাবে তেজগাঁও ট্রাক স্ট্যান্ড উদ্ধার, মোহম্মদপুরের বাসস্ট্যান্ডকে অন্যত্র সরিয়ে দেওয়া মেয়র আনিসুল হকের এসব কাজের দৃশ্যমান ফলাফল মানুষ পাচ্ছে। এরকম আরো অনেক কাজই দুই মেয়র করেছেন।

তবে কিছু বিষয়ে দুই মেয়র এখনও জনগণের কাছে আস্থার জায়গা তৈরি করতে পারেননি। এরমধ্যে অন্যতম হলো- শহররের যানজটকে সহনীয় মাত্রায় নিয়ে আসা, প্রাইভেট-পাবলিক পরিবহনগুলোকে নির্দিষ্ট নিয়মের মধ্যে আনা এবং যত্রতত্র যখন তখন খোঁড়াখুঁড়ি বন্ধ করা। এখন পর্যন্ত মেয়রদ্ধয়ের এখানে কোনো সাফল্য আছে বলে চোখে পড়েনি। ভিআইপি সড়কগুলো ছাড়া কোথায় নেই খোঁড়াখুঁড়ি? সব রাস্তাতেই সুয়ারেজ লাইন স্থাপন বা সংস্কার, নতুন নতুন ড্রেনেজ, ফুটপাথ তৈরি-নগরীরর মানুষগুলোকে রীতিমতো নাকাল করে ছাড়ছে। এসব কাজ চলছে দিনের পর দিন। সরুগলি, বড় গলি, বড় রাস্তা কোথাও বাদ নেই। অনেক পাড়ামহল্লাতে এ ধরনের কাজ রীতিমতো বিভীষিকাময় অবস্থা তৈরি করেছে। খোদ সংসদ ভবনের রাস্তাতেই কয়েক মাস ধরে চলছে রাজ্যের খোঁড়াখুঁড়ি। অনেক জায়গাতে ভালো ফুটপাত ভেঙেও নতুন ফুটপাথ নির্মাণ করতে দেখা গেছে।
এদিকে ঢাকা নগরীর প্রাইভেট-পাবলিক পরিবহনগুলো আগের মতোই সব নিয়মকানুন উপেক্ষা করে চলছে। প্রাইভেট গাড়িগুলো পার্কিং করার ক্ষেত্রে কোনো নিয়মেরই ধার ধারে না। আর পাবলিক পরিবহনগুলোতে রাস্তার রাজা। যেখানে সেখানে ইচ্ছেমতো দাঁড়াবে, যাত্রী তুলবে। গালিগালাজ করবে। নির্দিষ্ট স্টপেজে কেউ বাস থামাতে চায় না। বাস নিজেই যায় যাত্রীর কাছে, যাত্রী বাসের কাছে যায় না। নগরীর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা একেবারেই দুর্বল। জেব্রাক্রসিংগুলো না থাকার কারণে বাসগুলো নিজের ইচ্ছেমতো সিগনালে দাঁড়ায়। ফলে মানুষের রাস্তা পারাপার খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

সন্দেহাতীতভাবে পাবলিক পরিবহনগুলো নিজেরাই যানজটের প্রধান এক উৎস। আবার একই সাথে ট্রাফিক পুলিশও যে খুব চৌকষ দায়িত্ব পালন করছেন তা নয়। পুলিশ মোটিভেশনের বদলে আইনটাকেই মুখ্য করে দেখে থাকে। মনে হয় সারাদিন কেস ফাইল করাই তাদের কাজ এর বাইরে আর কোনো কাজ নেই। কোনো ধরনের মটিভেশনাল অ্যাকটিভিটিস নেই। ফলে জনগণের মধ্যে সেই অর্থে খুব একটা সচেতনতা তৈরি হচ্ছে না। বরং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভীতিই তৈরি করছে। আমি মনে করি দুই মেয়রকেই এ বিষয়ে বেশি করে নজর দিতে হবে।

গত দুবছরে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের দুই মেয়র যেভাবে জনগণের সেবা এবং নিরাপত্তা দেওয়ার জন্যে তৎপর থেকেছেন সেটি প্রশংসাযোগ্য। কথার চেয়ে তারা কাজকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। কিন্তু দুই মেয়রকে আরও অনেক অনেক কাজ করতে হবে। বিভিন্ন পাড়া মহল্লায় যে অপ্রশস্ত রোড রয়েছে সেগুলোকে বড় করার উদ্যোগ নিতে হবে। বিশেষ করে নগরীর তেজগাঁও, মহাখালী, মিরপুর, ধোলাইখাল, মুগদাসহ অসংখ্য জায়গাতে গাড়ি চলাচলের কোনো রাস্তা নেই। ফলে স্কুল টাইমে ভেতরের রাস্তাগুলোতে যানজট লেগেই থাকে। এ ধরনের রাস্তাঘাটগুলো বড় করতেই হবে। পাবলিক পরিবহনে যে বিশৃঙ্খলা চলমান তা থেকে পরিত্রাণের উপায় নতুন বাস নামানো নয়। বরং এখন যে সব বাস বা যত ধরনের বাস চলাচল করে সেগুলোকে সঠিক ব্যবস্থাপনার মধ্যে আনা হলে নতুন করে বাস নামানোর একদমই প্রয়োজন নেই।

দু বছর ধরে দুই মেয়র ঢাকাকে সুন্দরের দিকেই পরিচালিত করছেন। তবে আরও অনেক কাজ করতে হবে। বিশেষ করে বাস টার্মিনালগুলো আরও আধুনিকীকরণ করতে হবে। ময়লা, আবর্জনা আরও পরিষ্কার করতে হবে। মশক নিধনে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। নগরকে সবুজায়নের জন্যে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। গত বছর কোরবানির বর্জ্য অপসারণে দুই মেয়রের দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার পর লিখেছিলাম-‘দুই মেয়র পেরেছেন দুই মেয়রই পারবেন।’ আবারও বলছি দুই মেয়রই পারবেন। একটু নগরবাসীর দিকে তাকান। আর লোভ, দলবাজির, দুর্নীতির বাইরে থাকুন-আপনারাই পারবেন। আর আপনাদের এই পারার মধ্যে দিয়ে যে সৌরভ ছড়াবে, তার সুরভী ফের আপনারাই ভোগ করতে পারবেন।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)