রীতিমতো সফল কর্পোরেট ক্যারিয়ার আর পারিবারিকভাবে রীতিমতো গ্ল্যামারাস একটা জীবন। অথচ সব সংযোগ পেছনে ফেলে স্রেফ অজানা এক গন্তব্যের উদ্দেশ্যে গা ভাসিয়ে দিলে যে অদ্ভুত সব অভিজ্ঞতা এসে জমা হবে আপনার ঝুলিতে, ঠিক তেমন এক গল্প থেকে নির্মিত হয়েছে ওয়েব সিরিজ ‘ঢাকা মেট্রো’।
নয় পর্বের এই ধারাবাহিকটি এতো দারুণভাবে যে কাউকে আকৃষ্ট করবে যে রীতিমতো এক বসাতেই উপভোগ করতে বাধ্য হবেন একের পর এক পর্ব। বাংলা কন্টেন্টের জনপ্রিয় স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম ‘হইচই’ বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো কোন অরিজিনাল সিরিজ নির্মাণ করেছে বলে রীতিমতো আটঘাট বেঁধেই নেমেছিলো দেশি দর্শকদের নতুনত্বের স্বাদ দিতে। চমকের শুরুটাই হয় নির্মাতা নির্বাচন থেকেই।
প্রথমবারের মতো ওয়েব সিরিজ নির্মাণে এই প্ল্যাটফর্মটি বেছে নেয় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারজয়ী নির্মাতা অমিতাভ রেজা চৌধুরীকে। সিরিজের গল্পটা অমিতাভ রেজা আর আদিত্য কবিরের।
‘ঢাকা মেট্রো’ সিরিজের মূল চরিত্র ‘কুদ্দুস’এর ভূমিকায় দেখা গেলো শখের অথচ শক্তিমান অভিনেতা ফেরদৌস হাসান নেভিলকে! সিরিজের আরেক আকর্ষণ দেশের অন্যতম গুণী অভিনয়শিল্পী অপি করিম। তিনটি নামই যথেষ্ট, একটি দারুণ অভিজ্ঞতা নির্মাণে, তবে ‘ঢাকা মেট্রো’ নিয়ে বলবার আছে আরও অনেক কিছুই।
অমিতাভ আগেই জানিয়েছিলেন এ গল্পটা নতুন লেখা কোনো গল্প নয়। বহু আগে একই গল্প নিয়ে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করার ইচ্ছে থেকেই প্রযোজকদের আকৃষ্ট করতে চেয়েও ব্যর্থ হয়েছিলেন। আক্ষেপ চাপা দিয়ে রেখেছিলেন দীর্ঘদিন।
তাই, ‘হইচই’ যখন অমিতাভকে নির্মাণের প্রস্তাব করলেন, দ্বিতীয় কোনো গল্প নিয়ে নাকি ভাবেনইনি অমিতাভ!
সফল কর্পোরেট পেশাজীবী কুদ্দুসের দৈনন্দিন বাস্তবতা থেকে পালিয়ে যাওয়ার বাহন তাঁর ঝরঝরে স্টেশন ওয়াগন গাড়িটার নম্বর প্লেট থেকেই সিরিজের নামকরণ। এমনিতে বেশিরভাগ অংশের শুটিং হয়েছে উত্তরবঙ্গে, তাও শীতের কুয়াশামাখা রহস্যময় আবহে।
এই গল্পটা মূলত সফলতার চাপে নিজেকেই হারিয়ে ফেলা একটি চরিত্রের আত্মপরিচয় খুঁজে পাওয়ার যাত্রাকে উপজীব্য করে লেখা। সিরিজ নির্মাণে মোট নয়টি পর্বে ভাগ করে প্রতিটি পর্বেই সংখ্যার বিচারে সফল এমন নাগরিক জীবনের চাপা থাকা নয়টি চরম বাস্তবতাকে তুলে ধরা হয়েছে।
‘ঢাকা মেট্রো’র গল্পের কাঠামোটা কুদ্দুসের অজানা গন্তব্যের যাত্রাকে ঘিরে। পথে একে একে যুক্ত হয় কিশোর রহমান আর মধ্য তিরিশের রহস্যময় এক চরিত্র জয়গুন কিংবা জবা। এই তিন যাত্রীর এক গাড়িতে একত্রে যাত্রার শুরুটা যতোটা না অদ্ভুত তার থেকেও অদ্ভুত পুরো সময়ে ঘটতে থাকা বিচিত্র অথচ রূপক সব ঘটনাবলীর মাধ্যমে কুদ্দুসের আত্মপরিচয় ফিরে পাওয়ার যাত্রা।
রোড ট্রিপ নির্ভর গল্প হলেও শুধুমাত্র গাড়ির যাত্রা দেখতে দেখতে বিরক্ত হয়ে যাওয়ার জো নেই এই গল্পে। প্রথম পর্বেই কল্পনাকে হার মানানো এক ট্রাফিক জ্যামের ঘটনাই ইঙ্গিত দিচ্ছিলো নতুন কিছুর স্বাদ দিতে যাচ্ছে ‘ঢাকা মেট্রো’। এরপর একে একে সম্ভাব্য একটি খুনের ইঙ্গিত, ট্রাক চালক কবিরের কবিতার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া করতে চাওয়া, কাব্যপ্রেমী পতিতার কন্ঠে জীবনানন্দের কবিতা, মুক্তবাজার অর্থনীতি প্রতিষ্ঠায় চোরদের সমবায় আন্দোলন কিংবা আমেরিকার স্বপ্নাক্রান্ত এক গ্রাম্য বৃদ্ধার বব ডিলান প্রীতি কিংবা থানার অদ্ভুত সেই কথোপকথন!
পুরো সিরিজের কোনো অংশেই একটিবারের জন্যেও আগ্রহের মাত্রার কমতি হয়নি। গল্পের শেষটায় এসে শেষ হয়েও হইলোনা শেষ অনুভূতি থেকে আগেই টের পাওয়া গিয়েছিলো, এখন নিশ্চিত জানা গেছে অপেক্ষায় রয়েছে সিরিজটির দ্বিতীয় সিজন।