বলা হয়ে থাকে, সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ব্যাপারটি দুইভাবে ঘটতে পারে। প্রথমত: রাষ্ট্র যেভাবে চলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার প্রতিফলন দেখা যায়। দ্বিতীয়ত: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেভাবে চলে, দেশের জাতীয় চরিত্রে তার প্রতিফলন দেখা যায়।
তবে প্রথম ব্যাপারটিই বেশি প্রতিনিধিত্বশীল বলে মনে হয়। কারণ বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে রাষ্ট্রীয় সম্পদ। তাই রাষ্ট্র যেভাবে চাইবে বিশ্ববিদ্যালয় সেভাবেই চলতে অনেকটা বাধ্য। তার চরিত্রও সেভাবেই নির্ধারিত হয়।
প্রতিবছরই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো না কোনো ইস্যু জাতীয় ইস্যুতে পরিণত হয়। আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে গণমাধ্যমসহ দেশের প্রতিটি ফোরামে। তবে কয়েক বছর ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে আলোচনার চেয়ে সমালোচনাই যে বেশি হচ্ছে, এ কথা বলাই বাহুল্য।
সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয় ‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস।পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগেই যে কিছু কিছু পরীক্ষার্থীর হাতে প্রশ্নপত্র চলে গিয়েছিল সে বিষয়টি এখন প্রমাণিত। কর্তৃপক্ষ প্রথমে অস্বীকার, পরে আংশিক স্বীকার করে তদন্ত কমিটি করে ফল প্রকাশ করলেও সংবাদমাধ্যমের ধারাবাহিক প্রতিবেদন, বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীদের আন্দোলন এবং সব মহলে সমালোচনার মুখে বিশ্ববিদ্যালয় তারা শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়েছে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের পুনরায় পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে।
এ কথা অনস্বীকার্য যে প্রতিবছরই দেশের সব বিভাগের শীর্ষ মেধাবীরা এখানে ভর্তি হয়। নানা সীমাবদ্ধতার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় হয়তো তাদের পর্যাপ্ত পরিচর্যা করতে পারে না। কিন্তু শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগই নিজ উদ্যোগে নিজেদের আপডেট রাখে সর্বশেষ জ্ঞানের সঙ্গে। অতীত ঐতিহ্য থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে তারা সাহস সঞ্চয় করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে কোনো অন্যায়, অনিয়ম দেখলে সর্বপ্রথমে প্রতিবাদ আসে তাদের ভেতর থেকেই। সবার আগে তারাই উচ্চকন্ঠ হয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে অন্যদের। তাই স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় কোনো অন্যায়-অনিয়ম করে বসলেও সেটা বাস্তবায়ন করতে পারে না শিক্ষার্থীদের জন্যই।
হ্যাঁ, একথাও অস্বীকার করা যায় না যে, শিক্ষাব্যবস্থার গলদেই হোক বা ভর্তিব্যবস্থার ত্রুটির কারণেই হোক প্রতিবছর কিছু কথিত মেধাবী এখানে ভর্তি হয়। যারা এ বিশ্ববিদ্যালয়কে ধারণ না করে ‘গর্বিত ঢাবিয়ান’ পরিচয় দিতেই বেশি আগ্রহী। কিন্তু সংখ্যায় এরা সামান্যই।
এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থীই নিজের মায়ের মতো ভালোবাসে এ বিশ্ববিদ্যালয়কে। তাই শুধু ছাত্রাবস্থায়ই নয়, সাবেক হয়ে যাওয়ার পরেও এ বিদ্যাপীঠ নিয়ে তাদের আবেগ-আগ্রহে একটুও ভাটা পড়ে না। এর ভালো-মন্দ নিয়ে তারা থাকেন সদা উদ্বিগ্ন। তাই প্রশাসনের গাফিলতিতে বিশ্ববিদ্যালয়টি উচ্ছন্নে যেতে চাইলেও তা সম্ভবপর হয় না বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়।
এ বিদ্যাপীঠের অন্যায় অনিয়মগুলো সামনে নিয়ে আসে আর কেউ নন, এখানকারই কিছু শিক্ষার্থী; যারা বিভিন্ন গণমাধ্যমে নামমাত্র বেতনে প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে। দিনরাত খেটে তারা খুঁজে বেড়ায় অন্যায় অনিয়ম। সামগ্রিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি কাজে এরা পালন করে ওয়াচডগের ভুমিকা। তাই কোনো অনিয়ম করে সহজে পার পেতে পারে না প্রশাসন।
‘ঘ’ ইউনিটের প্রশ্ন যে ফাঁস হয়েছে একথা প্রমাণসহ জনসম্মুখে তারাই প্রথমে তুলে ধরেছে। নামমাত্র বেতনের বিপরীতে কঠোর পরিশ্রম এবং নানা হুমকি-ধামকির পরেও এরা নিরলস কাজ করে যায় কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি এদের অকৃত্রিম ভালোবাসার কারণেই।
যে কোনো অন্যায়, অসাধুতার বিরুদ্ধে ভেতর থেকেই যে সম্মিলিত প্রতিবাদ, তার কারণেই এ বিশ্ববিদ্যালয় কোনোদিন মরবে না। যত অনিয়মই হোক, সেখানে একটি ‘চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স’ সবসময়ই বজায় থাকে। সুতরাং শত হতাশার পরেও একথা বলাই যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কখনও মরবে না। তবে রাষ্ট্র বা প্রশাসন যদি আরেকটু যত্নশীল হয়; তবে এ বিদ্যাপীঠ আবারও মাথা তুলে দাঁড়াবে; দেশকে এগিয়ে নেবে আরও গতিতে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)