মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কিছুদিন আগে ‘চ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ’ পুরস্কার জিতেছেন। অত্যন্ত সম্মানজনক এই পুরস্কার জেতার জন্য সবার পক্ষ থেকে তাঁকে আন্তরিক অভিবাদন জানাচ্ছি। আমাদের আজকের সভার বিষয়বস্তু ‘চ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ’ নয়। আসলে গত মাসের ‘বার্থ কনফারেন্স’ এর ধারাবাহিকতায় আমরা এখন শুরু করতে যাচ্ছি ‘ডেথ কনফারেন্স’। আমি এই কনফারেন্সের সভাপতি হিসেবে নিজের নাম ঘোষনা করছি। প্রসঙ্গত বলে রাখি আজ এখানে প্রাপ্তবয়স্ক বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা হবে। যদি অপ্রাপ্তবয়স্ক কেউ থেকে থাকেন, তাহলে দয়া করে বেরিয়ে যাবেন।
মানববাদীঃ আমার সাথে আসা পোষা কুকুরটির বয়স দুই বছর সাত মাস। প্রাণীর জাতিগত বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী তাকে কি প্রাপ্তবয়স্ক বলা যাবে?
বার্থ কন্ট্রোলারঃ অসাধারণ বয়স তার। দ্রুত বিয়ে করিয়ে দিন। তবে অবশ্যই বার্থ কন্ট্রোলের বিষয়টি জানিয়ে দিবেন। বলবেন, দুই সন্তানের বেশি নয়, একটি হলে ভালো হয়।
সভাপতিঃ বাই দ্য ওয়ে, আজকের সভার বিষয়বস্তু কিন্তু বার্থ কন্ট্রোল নয়। বরং ডেথ প্রমোশন নিয়ে সবাইকে মূল্যবান মন্তব্য, বক্তব্য ও সুপারিশ আলোকপাত করতে হবে।
আইন রক্ষকঃ ডেথ প্রমোশনের জন্য দেশে পর্যাপ্ত আইন আছে। এদিক দিয়ে আমরা অনেক এগিয়ে। বিশেষত আইসিটি আইনের ৫৭ ধারার কথা না বললেই নয়। আইনের এই ধারার মাধ্যমে সুকৌশলে অস্বাভাবিক মৃত্যুর প্রমোশন চালিয়ে যাচ্ছি। অনেকে টেরই পাচ্ছে না!
শৃঙ্খলা রক্ষকঃ কিন্তু টের না পেলে কিভাবে কী হবে? আমাদের সবাইকে বুঝতে হবে বাংলাদেশে উন্নয়নের প্রধান অন্তরায় হচ্ছে জনসংখ্যা। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে আসলে কোন উন্নয়নই হবে না। এখানে আমাদের সবার প্রিয় মিস্টার বার্থ কন্ট্রোলার উপস্থিত আছেন। তিনি খুব ভালো বলতে পারবেন। শুধু বার্থ কন্ট্রোল করে কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। এ জন্য ডেথ ফিগার বাড়াতে হবে। এখন আপনারা ডেথ প্রমোশন চালাচ্ছেন, ইটস ওকে! কিন্তু সেই প্রমোশনটা সবাইকে জানাতে হবে। না হয় এই প্রমোশন কোন কাজ করবে না।
বার্থ কন্ট্রোলারঃ শৃঙ্খলা রক্ষক এর সাথে সম্পূর্ণ একমত পোষন করছি। আমি মনে করি ডেথ প্রমোশনটা আসলে সেভাবে হচ্ছে না। এর কারণগুলো খুঁজে বের করা জরুরী।
সভাপতিঃ আমাদের তথ্য সংরক্ষক আজ আসতে পারেননি, তিনি হাসপাতালে। ভদ্রলোক সম্ভবত চতুর্থ সন্তানের বাবা হতে যাচ্ছেন। কনফারেন্স শেষে আমরা সবাই উনাকে অভিনন্দন জানাতে যাবো। তো, তিনি কিছু পরিসংখ্যান পাঠিয়েছেন, যেটা পড়ে শোনালে আলোচনা করতে সুবিধা হবে। আমি আমাদের হেড অব পাবলিসিটিকে অনুরোধ করছি পড়ে শোনাতে।
হেড অব পাবলিসিটিঃ ২০১৫ সালের জানুয়ারী থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কিছু ডেথ স্ট্যাটিসটিকস বলছি। এই সময়ে রাজনৈতিক সংঘাতে মারা গেছেন ১৪৩ জন। এর মধ্যে আওয়ামীলীগের ৩৩ জন, বিএনপির ১২ জন, সাধারণ জনগণ ৯০ জন। বাকিরা পুলিশ ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের কর্মী সমর্থক। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ১৪৮ জন মারা গেছেন। এর মধ্যে কোনরকম গ্রেফতার ছাড়াই ৬৪ জনকে ক্রসফায়ারে ডিসমিস করার কৃতিত্ব দেখিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষকরা। পুলিশ হেফাজতে/জেল হাজতে মারা গেছেন ৫২ জন, সীমান্তে বিএসএফ এর গুলিতে ৩৫ জন। আর সারাদেশে ১৫৭ জন স্ত্রীকে তাদের স্বামীরা মেরে ফেলেছে। (সূত্র: আইন ও সালিশ কেন্দ্র) সড়ক দুর্ঘটনায়, লঞ্চডুবিতে, অগ্নিকান্ডে নিহতদের হিসাবে বারবার যোগে ভুল হচ্ছে, অবিশ্বাস্য সব ফিগার দেখাচ্ছে। তাই এই পরিসংখ্যান আমাদের হাতে নেই।
শৃঙ্খলা রক্ষকঃ মোটামুটি সব প্রয়োজনীয় পরিসংখ্যান উঠে এসেছে। আমি যতদূর জানি অক্টোবর পর্যন্ত সময়ে প্রচুর সাম্প্রদায়িক সহিংসতা হলেও হতাহতের ঘটনা তেমনটা ঘটেনি। ২৮ অক্টোবর রাতে ফেনীতে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর স্থানীয় যুবলীগ নেতাকর্মীদের হামলায় এক প্রসূতির গর্ভপাত ঘটে। তার গর্ভের শিশুটিকে লাথি মেরে পেট থেকে বের করে আনা হয়। শিশুটি মারা যায়।
সভাপতিঃ আহারে, একটা ডাকাত মারা গেলো!
মানববাদীঃ দেখুন সভাপতি সাহেব, এভাবে বলবেন না। ওই শিশুটি বিজ্ঞানীও হতে পারতো।
সভাপতিঃ যে শিশু মারা গেছে, তাকে ভবিষ্যত বিজ্ঞানী ভাবলে দেশের ক্ষতি হবে। জাতি একজন উদীয়মান বিজ্ঞানী হারাবে। তারচেয়ে ধরে নিই নিহত শিশুটি একজন হবু ডাকাত সর্দার। সেক্ষেত্রে জাতি যদি একজন ডাকাত সর্দার হারায়, তাহলে একটুও ক্ষতি হবে না।
শৃঙ্খলা রক্ষকঃ অসাধারণ! আপনার এই ব্যাখ্যাটা আমার খুবই ভালো লেগেছে। সত্যি অসাধারণ! কিন্তু সভাপতি সাহেব, হেড অব পাবলিসিটির বলে যাওয়া এইসব পরিসংখ্যানে কি আপনি সন্তুষ্ট? আমি জানতে চাচ্ছি এখানে কেউ কি সন্তুষ্ট হতে পেরেছেন? আমরা যারা শৃঙ্খলা রক্ষা করার দায়িত্বে আছি, সবাই কিন্তু ডেথ প্রমোশনে নিরলসভাবে কাজ করি। খুন করে চোখের সামনে দিয়ে চলে গেলেও ধরি না। হালকা গন্ডগোল হয়েছে ভেবে চুপ থাকি, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ডিম পরোটা খাই। আসলে আমি বলতে চাইছি ডেথ প্রমোশনে শৃঙ্খলা রক্ষকরা যে প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখছে, এটা স্বীকার করতে হবে।
আইন রক্ষকঃ এটা স্বীকার করতে আমাদের কারোরই কোন আপত্তি নেই।
শৃঙ্খলা রক্ষকঃ আপনি আপত্তি জানালেও আমরা সেটা মানবো না। যাইহোক, আমাদেরও সীমাবদ্ধতা আছে। এসব সীমাবদ্ধতা কিছুটা কমিয়ে আনতে পারলে মৃত্যুহার আরো বেড়ে যাবে। এখন যেটা হচ্ছে, মানুষ মানুষকে খুন করছে, আমরা নীরবতা পালন করছি। তেমন কোন বাধা দিই না। সভাপতি সাহেব আপনি দেখুন, আট মাসে মাত্র ১৪৮ জন মানুষকে আমরা সরাসরি মারতে পেরেছি। এখানে আইনের ঘাটতি আছে। শৃঙ্খলা রক্ষক বাহিনী যদি মাসে একবার ‘ডেথ প্রমোশন ডে’ পালন করতে পারে, তাহলে এই ফিগারটা আরো হৃষ্টপুষ্ট হতো।
মানববাদীঃ আমি এই প্রস্তাবের সাথে সরাসরি দ্বিমত পোষন করছি। এটা অমানবিক। এটা হতে দেয়া যায় না। অন্তত প্রমোশন ডে’র নামটা পরিবর্তন করতে হবে। যেহেতু মৃত্যুর সাথে দেশের উন্নয়নের সম্পর্ক আছে, সেহেতু ‘ডেভেলপমেন্ট প্রমোশন ডে’ নাম রাখা যেতে পারে। যদি এটা না করা হয়, তাহলে আমি মিডিয়ায় খুব কড়া একটা বিবৃতি দিবো।
পলিটিক্যাল বিজনেসম্যানঃ আহা! আপনি ক্ষেপছেন কেন? আমরা মাত্র প্রস্তাব-প্রস্তাবনার পর্যায়ে আছি, এখনোতো প্রস্তাব পাস হয়নি।
মানববাদীঃ না না। ক্ষেপাক্ষেপির কিছু নাই। তাছাড়া আপনি কখন আসলেন দেখতে পাইনি, স্যরি। কিন্তু আপনারা পলিটিক্যাল বিজনেসম্যানরা যা করছেন, তা আসলেই বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে গেছে। আপনারা মারামারি করেন, গোলাগুলি করেন ভালো কথা। কিন্তু প্রশিক্ষণটা পর্যন্ত ঠিকমত নেননি। এটা একদমই ঠিক না। এতে করে মানবাধিকার চরমভাবে লংঘিত হয়। আপনাদের গোলাগুলির মাঝে পড়ে গর্ভের শিশু গুলিবিদ্ধ হয়। এখন মনে করেন যে, আপনারা যদি ভালোভাবে প্রশিক্ষণ নিতে পারতেন, তাহলে শিশুটি গুলিবিদ্ধ হতো না। যাকে উদ্দেশ্য করে গুলি ছুঁড়েছেন, সেই মারা যেতো। আবার আপনারা মদ খেয়ে দামি গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পথে ঘাটে গুলি করেন, টার্গেট মিস করেন। সাধারণ মানুষ গুলি খায়। এখন এসব নিয়ে কথা বললেতো বলবেন ষড়যন্ত্র করি। তবুও আমি বলবো। আমি বলবো আপনাদের উচিত গোলাগুলির প্রশিক্ষণ ঠিকমতো নেয়া। যেন টার্গেট মিস না হয়।
পলিটিক্যাল বিজনেসম্যানঃ আপনার কথার সাথে একমত। আসলেই প্রশিক্ষণের ঘাটতি আছে। নইলে আমরা পলিটিশিয়ান বিজনেসম্যানরা একে অপরের সাথে যে পরিমাণ দাঙ্গা হাঙ্গামা করেছি, তাতে নিহতের সংখ্যা আরো বাড়তে পারতো। তবুও রাজনৈতিক সহিংসতায় ১৪৩ জনকে হত্যা করার মাধ্যমে ডেথ প্রমোশনে আমাদের কন্ট্রিবিউশন অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই। এটা জোর গলায় বলতে পারি।
সভাপতিঃ কিন্তু এত অল্প মৃত্যুতে কি আর জাতির অগ্রযাত্রা হবে? হবে না। ১৯৭১ সালে ৩০ লাখ মানুষের মৃত্যুর পর বাংলাদেশি উন্নয়নের জন্ম হয়। এর আগে তা ছিলো পাকিস্তানী উন্নয়ন। ১৯৭৪ এর ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের পর বাংলাদেশে বাকশালের পতন হয়, দেশটা উন্নয়নে উন্নয়নে পাগলা ঘোড়ার মত দৌড়াতে থাকে। ১৯৯১ সালের ঘূর্নিঝড়ের হাত ধরে দেশে গণতন্ত্র ফিরে আসে, তারপর সে কী উন্নয়ন! গুজরাটে ভূমিকম্পের পর সেখানে অর্থনৈতিক বিপ্লব হয়েছে, সুনামির পর জাপান এগিয়ে গেছে, স্মরণকালের ভয়াবহ ভূমিকম্প শেষে নেপালে সেক্যুলারিজম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রত্যেকটি ঘটনায় প্রচুর মানুষের মৃত্যু হয়েছে এবং এরপরই উন্নয়ন হয়েছে। মৃত্যু আর উন্নয়ন রেলগাড়ির দুই চাকার মতন; বহে সমান্তরাল। কিন্তু সেই ৯১’র পর দেশে আর কোন বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগও হয়নি। মানুষতো কমে নারে ভাই! একটা রানা প্লাজা আর দুইটা তাজরীনের ঘটনায় কয়টা মানুষই মারা গেছে? মানুষ না কমলে দেশের উন্নয়ন কিভাবে হবে, এটা আমারে কেউ বুঝান।
বার্থ কন্ট্রোলারঃ আমি বরং চলে যাই। আমারতো এখানে কোন কাজ নাই। অনেক রাত হয়েছে, বৌ বার বার ফোন দিচ্ছে।
পলিটিক্যাল বিজনেসম্যানঃ ঠিক আছে কন্ট্রোলার, আপনি তাহলে যান। শুধু কন্ট্রোলের ব্যাপারটা মাথায় রাইখেন। তো, সভাপতি সাহেব যা বলছিলেন। আমি আপনাকে একটা কথাই বলবো। সেটা হচ্ছে, আপনি শান্ত হোন। এই মুহূর্তে শান্ত হওয়া ছাড়া কোন উপায় নেই। আপনার মত আমিও হতাশ। কিন্তু কী করবো বলুন? এই যে ব্লগার হত্যা নিয়ে কী পরিমাণ আলোচনা সমালোচনা হচ্ছে। মিছিল মিটিং, প্রতিবাদ, বিক্ষোভ হচ্ছে। কিন্তু আপনি দেখুন ২০১৩ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত মাত্র ৬ জন ব্লগার মারা গেছে। মাত্র ৬জন ব্লগারের প্রাণহানির বিপরীতে এত বেশি আলোচনা সমালোচনা হলে কি পোষায়, বলুন! আমিতো এই বিষয়টা কোনভাবেই মেনে নিতে পারছি না।
মানববাদীঃ এইভাবে ব্লগারদের মৃত্যু খুবই মর্মান্তিক। এটা অমানবিক। মানুষের মানবিক মূল্যবোধের প্রতি চরম অপমান, অবজ্ঞা। এইসব নৃশংসতা থামাতে হবে। এইসব বর্ববতার বিনাশ এখনই করতে হবে। নইলে দেশে ব্যাপক আকারে মানবিক সংকট দেখা দিবে।
আইন রক্ষকঃ কীসের মধ্যে কী! আমি এখানে কোন অমানবিকতা দেখছি না। একদমই না। একটা ঘটনা ঘটছে, সেটাকে বিচারের আওতায় আনার জন্য পর্যাপ্ত আইন আছে। এখানে অমানবিকতার কী হলো বুঝলাম না।
মানববাদীঃ আরে নাহ! আপনি বুঝতে পারছেন না, এটা অত্যন্ত অমানবিক বিষয়।
শৃঙ্খলা রক্ষকঃ দেখুন মানববাদী সাহেব, ব্লগার হত্যা সুস্পষ্টভাবে বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এটাকে কেন মূলধারায় নিয়ে আসছেন?
মানববাদীঃ সে যাই হোক, এভাবে ব্লগার হত্যা অত্যন্ত অমানবিক কাজ। আমি এর নিন্দা জানাই।
সভাপতিঃ কী ব্যাপার বুদ্ধিজীবী, কোন আওয়াজ নাই ক্যান?
বুদ্ধিজীবীঃ ওহ স্যরি! আসলে একটা লেখার সাবজেক্ট নিয়ে ভাবছিলাম। আমাকে কথা বলার সুযোগ দেয়ার জন্য উপস্থিত সবাইকে আন্তরিক সাধুবাদ। আমি মানববাদীর কথার সাথে আংশিকভাবে একমত। আসলেই এভাবে একের পর এক ব্লগার খুন করে যাওয়াটা যথেষ্ট অমানবিক ব্যাপার। কিন্তু আমি যেটা মনে করি, উভয় পক্ষকেই শান্ত হতে হবে। এখানে একটা সামাজিক সমঝোতার প্রয়োজনীয়তা আছে। আমার মনে হয়, সহনশীলতার বেশ খানিকটা ঘাটতি আছে। উভয় পক্ষকেই সহনশীল হতে হবে। শত শত ব্লগারের মধ্যে দুই বছরে মাত্র ৬ জন মারা গেছে। এই হত্যাকান্ডগুলো ইগনোর করে গেলেই কিন্তু সমাজে একধরনের শান্তি বিরাজ করবে। এই শান্তিটুকু খুব জরুরী। শান্তি মানুষকে সহনশীল হতে সাহায্য করে।
মানববাদীঃ দেখুন, মানবিক মূল্যবোধের উপর সমাজ সভ্যতা গড়ে উঠে, টিকে থাকে। এই মানবিক মূল্যবোধ না থাকলে মানুষে মানুষে সম্পর্ক ভেঙে যাবে, সমাজ ভেঙে, সভ্যতা ধ্বসে যাবে। তাই আমাদেরকে মানবিক মূল্যবোধের প্রতি বেশি জোর দিতে হবে।
সভাপতিঃ আরে ভাই, আপনি একদিকে দেশের উন্নয়ন চান, আবার ব্লগার মরলে বলেন মানবাধিকারের লংঘন হচ্ছে! এসব কীরে ভাই?
মানববাদীঃ দেখুন, উন্নয়নের কোন বিকল্প নেই। কিন্তু সেটা মানবিক উপায়ে করতে হবে। এভাবে চাপাতি দিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে মানুষ খুন করে কখনো উন্নয়ন হবে না। এসব উন্নয়ন টিকবে না। আপনারা দুইজন ব্লগার ও দুইজন প্রকাশকের উপর হামলা করলেন। কই, সবাইকেতো মারতে পারলেন না। মরলো মাত্র একজন। যে মরে গেছে, তাকেতো আমরা ডেথ ফিগারে গুনতে পারছি। কিন্তু যাদেরকে মারতে পারেননি, তারা এখন হাসপাতালে কাতরাচ্ছে। সেখানে গিয়ে দেখুন কী অবস্থা। কী পরিমাণ মানবিক সংকটক সৃষ্টি হয়েছে! অথচ আপনারা চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে ব্লগার হত্যার মাঝে কোন অমানবিকতা খুঁজে পাচ্ছেন না।
পলিটিক্যাল বিজনেসম্যানঃ না, আমরা এখানে কোন অমানবিকতা খুঁজে পাচ্ছি না। তাছাড়া ব্লগার হত্যা কি মানবিক কায়দায় হচ্ছে, নাকি অমানবিক কায়দায় হচ্ছে, তা মোটেও গুরুত্বপূর্ণ কিছু না। আপনি কী বলতে চান, স্পষ্ট করে বলুন।
সভাপতিঃ আমার মনে হয় না এখানে অমানবিক কিছু আছে। এসব স্বাভাবিক পদ্ধতি। কুপিয়ে মানুষ খুন করার সংস্কৃতি যুগ যুগ ধরে চলে আসছে, এটা আমাদের ঐহিত্যের অংশ।
শৃঙ্খলা রক্ষকঃ দেখুন মানববাদী সাহেব, মানবাধিকার নিয়ে আমরাও একটু আধটু কাজ করেছি। কোথাও আলাদা করে লেখা নেই যে চাপাতি দিয়ে মানুষ কুপিয়ে মারলে মানবাধিকারের লঙ্ঘন।
আইন রক্ষকঃ এ বিষয়ক কোন আইনও নেই। চাপাতি দিয়ে কোপালে শাস্তির ব্যবস্থা আছে, কিন্তু এটা অমানবিক, এমন কোন কথা লেখা নেই। আমি কখনো পাইনি।
মানববাদীঃ স্যরি, আপনাদের সাথে একমত হতে পারলাম না।
সভাপতিঃ আপনি একমত হলেই কী, আর না হলেই বা কী! আপনার একমত না হওয়াতে আজ পর্যন্ত কোন কিছু আটকায়নি। মানবাধিকার নিয়ে কথা বলার দায়িত্ব, কথা বলবেন। একমত দ্বিমত হওয়ার এখতিয়ার নাই আপনার। এই জিনিসটা বারবার মনে করিয়ে দেয়ার পরও আপনি ভুলে যান। যাই হোক, আজকের কনফারেন্স অত্যন্ত সফল হয়েছে বলে মনে করি। এই মর্মে সবাই একমত হলাম যে, দেশের উন্নয়নের জন্য প্রচুর লাশ দরকার, মৃত্যু দরকার। মৃত্যু এবং উন্নয়ন একে অপরের পরিপূরক। আমরা সবাই ডেথ ফিগার বাড়ানোর জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাবো। এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ডেথ কনফারেন্স এখানেই শেষ। সবাই ভালো থাকুন।
কনফারেন্স শেষেও তর্ক চলতে থাকে অমানবিক মৃত্যু নিয়ে। বাংলাদেশে অস্বাভাবিক মৃত্যু কোন অমানবিক বিষয় নয়। অস্বাভাবিক মৃত্যুই এখানে স্বাভাবিক। মৃত্যুর নির্মমতার উপর নির্ভর করে এটা কি অমানবিক মৃত্যু ছিলো, নাকি ছিলো না। মানবিক কিছুই আর অবশিষ্ট নেই।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)