ডেঙ্গুর ভয়ে পাগলপারা অবস্থা। সকালে উঠে হঠাৎ মনে হলো ডেঙ্গু প্রতিরোধে একটি মোবাইল অ্যাপ তৈরি হতে পারে কি-না। ধারণাটা ঠিক এরকম, প্রথম দফায় একটি অ্যাপলিকেশন তৈরি করা হবে মশার ঘনত্বের হিসেবে উপস্থিতি নির্ণয়ের, তারপর শব্দের ডেসিবল হিসাব করে এডিস মশার বৈশিষ্ট্য নিরূপণ করে তৈরি করা হবে আরেকটি অ্যাপ।
যা কোনো ঘরে এডিস মশার উপস্থিতি নির্ণয়ে সহায়ক হবে। অনেক আগে একজন সফটওয়্যার প্রকৌশলীর কাছে শুনেছিলাম, মোবাইল অ্যাপলিকেশন কিংবা কম্পিউটার সফটওয়্যার সবকিছুই তৈরি হয় বিজ্ঞান ও যুক্তির সমন্বয়ে। যুক্তি ও চিন্তা এখানে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই হিসেবে আমার চিন্তাটি যুক্তিপূর্ণ কি-না তা নিয়ে আলোচনা করলাম আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত একজন সফটওয়্যার প্রকৌশলীর সঙ্গে। তিনি চিন্তাটি নিলেন। বললেন হতে পারে।
হঠাৎ মনে হলো এত কিছুর মোবাইল অ্যাপ আছে, মশা মারার কি কোনো অ্যাপ নেই? খোঁজ করতেই আরেক রাজ্যের সন্ধান পেলাম। দেখলাম মশা নিধনের জন্য বহু সংখ্যক মোবাইল অ্যাপ রয়েছে। বহু অ্যাপ রয়েছে। যেগুলোতে মশা তাড়ানোর অভিনব সব পদ্ধতি। ২০১৯ সালেই মশা প্রতিরোধী বা মশানাশক দশটি অ্যাপ গুগল সন্ধানীতে সামনে এলো।
এগুলো হলো ১. এন্টি মসকিটো সাউণ্ড প্রাঙ্ক, ২. মসকিটো সাউণ্ড, ৩. এন্টি মসকিটো সিমুলেটেড, ৪. এন্টি মসকিটো সিমুলেটার, ৫. মসকিটো কিলার এক্স, ৬.এন্টি কসকিটো প্রাঙ্ক, ৭. এন্টি মসকিটো সিমুলেটার জোক, ৮. এন্টি মসকিটো সনিক রিপেলার, ৯. এন্টি মসকিটো রিপেলেন্ট সাউন্ড ও ১০. এন্টি মসকিটো সাউন্ড। এর বাইরেও বহু সংখ্যক মোবাইল অ্যাপ রয়েছে এন্ড্রয়েড ও আইফোনের জন্য।
এর সবগুলি শুধু ফ্যান্টাসি বা মজা করার জন্য তা নিশ্চয়ই নয়। বিজ্ঞানসম্মত এসব চিন্তার সঙ্গেই নিশ্চয়ই যৌক্তিকতা রয়েছে। আমার মনে হয় অর্থাৎ সফটওয়্যার প্রকৌশলীরা ভেবে দেখতে পারেন। এসব অ্যাপ-এর ধারাবাহিক সংস্করণ হিসেবে এডিস মশা প্রতিরোধী বিশেষ কিছু করা যায় কি না। আমরা কেন অন্য দেশের দোহাই দেই। কেন বলি, পৃথিবীর বহু মানুষ ডেঙ্গু ঝুঁকিতে আছে! অন্যদেশ একটি প্রযুক্তি বের করার পর তবে আমরা সেদিকে ঝাঁপিয়ে পড়বো? কেন আমরা নিজেরা এডিস মশা প্রতিরোধী বা ডেঙ্গু প্রতিরোধী কার্যকর কোনো কম্পিউটার প্রযুক্তি উদ্ভাবণ করতে পারছি না!
‘মশা প্যান প্যান করে, মশা ভ্যান ভ্যান করে রাজারবাড়ির মশা এলো গরীবের ঘরে’ এই গানটি অনেকেরই পরিচিত। এই গানটিরই কোনো এক অন্তরায় কথার পরিবর্তন রয়েছে। ‘মশা প্যান প্যান করে, মশা ভ্যান ভ্যান করে, কচুবনের মশা এলো রাজারও ঘরে’। আশির দশকের বাংলা চলচ্চিত্রের এই গানটি যেন দুই হাজার ঊনিশে এসে এক সত্যভাষণের গুরুত্ব পেয়ে গেছে। এডিস কিন্তু নাগরিক মশা।
এটি শহরের মানুষদের সঙ্গে মিশে থেকে এখানেই বংশ বিস্তারের মশা। শহরেই এর জন্ম। ডেঙ্গু পৃথিবীর যত জায়গাতে মহামারি আকারে ছড়িয়েছে, গোড়াপত্তন ঘটেছে শহরে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ এডিস মশা বিস্তারে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে পারে। ২০১১ সালের এক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বা এডিস মশার ব্যাপক বংশ বিস্তারের জন্য প্রধানত তিনটি কারণ দায়ী। ১. অপরিকল্পিত নগরায়ণ, ২. বিশ্বায়ণ ও ৩. মশা নিধনের ব্যর্থতা। সিঙ্গাপুরের সিগনেচার রিসার্চ প্রোগ্রাম ইন ইমার্জিং ইনফেকশাস ডিজিজ এর পরিচালক প্রফেসর ড. জে গাবলার ওই গবেষণা করেন।
গবেষণায় তিনি দেখিয়েছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অপরিকল্পিত নগরায়ণের পাশাপাশি যখন থেকে বিশ্বায়ণের বাতাস প্রবাহিত হতে শুরু করেছে তখন থেকেই একদেশ থেকে অন্যদেশে মানুষ, পশুপাখি ও বিভিন্ন দ্রব্য সামগ্রির আসা যাওয়া সুগম হয়েছে। এর মধ্য দিয়েই বিংশ শতক আমাদের দুর্যোগের মুখোমুখি করছে এবং টিকে থাকার শিক্ষা দিয়েছে নানা রোগ থেকে। এর মধ্যে রয়েছে গুটি বসন্ত, ম্যালেরিয়া, কলেরা, ডেঙ্গু, টিউবারক্যুলাসিস ও প্লেগের মতো রোগ।
২০১৬ সালে ইন্দোনেশিয়ার গবেষক ইসনু পুত্রা প্রাতামা তার পিএইচডি গবেষণাপত্রে ডেঙ্গুর জন্য অপরিকল্পিত নগরায়ণের দায়গুলো সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করেন। তিনি জানান, অপরিকল্পিত নগরায়ণই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের জন্ম দিতে পারে। এডিস মশা শহরের অধিক ঘনত্বের জনবসতি থেকে বিস্তার লাভ করে গ্রামমুখি হতে পারে। আমাদের দেশের বাস্তবতায় এবার সেটিই দেখা যাচ্ছে। শুরুতে ঢাকা শহরই ডেঙ্গুর জন্য আতংক ছিল, এখন সেটি ছড়িয়েছে সারাদেশে।
আমাদের দেশের প্রতিটি দুর্যোগই একটি শ্রেনীর জন্য বেশ সুবিধা নিয়ে আসে। আমরা অনেকেই আবুল মনসুর আহমেদের ‘রিলিফ ওয়ার্ক’ গল্পের সঙ্গে পরিচিত। আজকাল দেশে যেকোনো দুর্যোগে গণমাধ্যমের অগ্রগামী ভূমিকার পেছনে মানুষের হুমড়ি খেয়ে পড়ার দৃশ্যটি বেশ অস্বস্তিকর। তারপরও এটিই এখনকার রীতি। জনবহুল ও বাণিজ্য বিকশিত দেশে জনগণের দুর্ভোগে বাণিজ্য বহু রাস্তা দিয়ে ছুটে আসে। এখন যা কিছু ঘটছে তার সবটাই গণমাধ্যমের সামনে। শুধু মশার হুল ফুটানোর কাজটি হচ্ছে গণমাধ্যমের পেছনে। গণমাধ্যম এই দৃশ্য ধারণ করতে পারছে না।
আমাদের দেশের বড় বড় সিনে তারকা, নেতা- নেত্রী, সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীরা মানুষকে ঝোপ-ঝাড় ঝাড়ু দিতে উদ্বুদ্ধ করার অংশ হিসেবে সুপরিসর পরিচ্ছন্ন জায়গায় ডজন ডজন ঝাড়ু নিয়ে ঘষাঘষি করার যে দৃশ্য ক্যামেরার মাধ্যমে গণমানুষকে পাঠিয়েছেন, তাতে সাধারণ মানুষ হতবিহ্বল হয়ে পড়েছে। সম্ভবত এই দৃশ্য দেখে মশারও হাসি পাচ্ছে। তারপরও বড় বড় মানুষ আড়মোড়া ভেঙে যে ঝাড়ু হাতে নিয়ে ক্যামেরার সামনে দাঁড়াচ্ছেন এই বা কম কি। এতে মশা পালাক বা আকৃষ্ট হয়ে ছুটে আসুক, একটি নজির তো গড়ে উঠছে।
উল্লেখ করা দরকার যে, এদেশে মানুষকে সবই শিখিয়ে দিতে হয়, তারপরও শিখতে চায় না। যেমন হাত ধুয়ে খাবার খাওয়া কিংবা পায়খানা থেকে ফিরে হাত ধোয়ার কথাটি সেমিনার করে, টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন দিয়ে পত্র-পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখে শিখিয়ে দিতে হয়। তারপরও মানুষ হাত ধোঁয়ার কথা ভুলে যায়।
ডেঙ্গু ক্যান্সার বা এইডস এর মতো দূরারোগ্য কিছু নয়। এক ধরণের জ্বর। এই জ্বর মোকাবিলা করতে গিয়েই হিমশিম খাচ্ছি আমরা। হাসপাতালগুলোতে রোগীর আর ঠাঁই মিলছে না। প্রাচীনকালের পালাজ্বর কিংবা কালাজ্বরের মতো ঘরে ঘরে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। আকস্মিকভাবে মারাও যাচ্ছে। হাসপাতালে গিয়ে অথবা বাসায় মারা যাচ্ছে। মানুষ সরকারি হাসপাতাল নাকি বেসরকারি হাসপাতালের ওপর আস্থা আনবে বুঝে উঠতে পারছে না। অনেক বেসরকারি হাসপাতালে নাকি ডেঙ্গু পরীক্ষার সব ব্যবস্থা নেই। আবার বড় বড় পাঁচ তারকা হোটেলের মতো হাসপাতাল থেকেও রোগী মারা যাচ্ছে।
রোগী চিকিৎসার চেয়ে তারা আভিজাত্য আর বাণিজ্যিক ভাব বেশি ফোটাতে গিয়ে হাতে ধরে মানুষ মেরে ফেলছে। ডেঙ্গু জ্বরে আরোগ্যের সবচেয়ে বড় উপায় বিশ্রাম। কিন্তু মানুষ ঘরে বিশ্রাম নিতে ভয় পাচ্ছে। রক্তের প্লাটিলেট কমে গেলে বিশ্রামেও তো কাজ হবে না। এই প্লাটিলেট এক ধাক্কায় বিপদজনক হারে নেমে যাচ্ছে। অবশ্য বলা দরকার, ডেঙ্গু ছাড়াও মৌসুমী জ্বরেও আক্রান্ত হচ্ছে বহু মানুষ। এসব মানুষও ডেঙ্গুর ভয়ে হাসপাতালে যাচ্ছে পরীক্ষা নিরীক্ষা করছে। বড় বড় বেসরকারি হাসপাতাল এসব আতংকিত মানুষকে ঠাণ্ডা ঘরে শুইয়ে রেখে ডেঙ্গু ঝুঁকির পিরিয়ড পার করছে লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে।
মজার ব্যাপার হলো, সভ্যতার এই পর্যায়ে এসে মানুষ শত বিপদেও ব্যবসা করতে শিখে গেছে। আমাদের দেশের প্রাইভেট হাসপাতালগুলো, স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাস্থ্য বিজ্ঞান নিয়ে একতিলও অগ্রসর হতে চায় না। তারা অনেক বেশি সচেতন স্বাস্থ্য বাণিজ্যে। সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও ভারত থেকে আমরা স্বাস্থ্য ব্যবসা শিখছি। আমরা রোগী জবাই করে টাকা আদায় করার নানান যুক্তি বুদ্ধি ও পদ্ধতি রপ্ত করছি।
সে কারণে ডেঙ্গুর মৌসুমেও অনেক প্রাইভেট হসপিটাল তাদের স্ব স্ব কৌশলের ভেতরে থেকে বাণিজ্য প্রসার করে চলেছে। আবার অনেক হাসপাতাল এই জাতীয় সংকটে বেকায়দায় পড়া থেকে নিজেদের বিরত রাখতে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি নিচ্ছে না। তারা বলছে, আমাদের এখানে ডেঙ্গু পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই। ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনার উপায় নেই। কিন্তু বাজার ভর্তি হয়ে গেছে নানারকম মশা প্রতিরোধী পণ্যে।
ভারতীয় নানা নামের পণ্য আসছে কোনটি শরীরে মাখার ক্রিম, কোনটি কাপড়ে লাগানোর ড্রপ, কোনটি বিদ্যুৎ সংযোগে এক আবেশ ছড়িয়ে মশা তাড়ানোর ব্যবস্থা, কোনটি বিষাক্ত কয়েল। মজার ব্যাপার কোনো কোনো পণ্যের গায়ে ‘ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে আপনার পরিবারের পক্ষে যুদ্ধ করে’ ধরণের বাক্যও লেখা। মুদি দোকানিরা ক্রেতাকে প্রলুব্ধ করে কয়েকগুণ দাম বাড়িয়ে এগুলো বিক্রি করছে। এগুলো ধরে জরিমানা করার জন্য মোবাইল কোর্টও বেরিয়েছে। ইতোমধ্যে বেশ কিছু জরিমানা করার ঘটনাও ঘটেছে। ’
প্রাণিকূলের মধ্যে মশার গুরুত্ব সাংঘাতিকভাবে বেড়েছে। বাঘ কিংবা সাপও এখন নস্যি। এখন মানুষ কালকেউটের লকলকে পথচলা দেখে নিজেকে সামলাতে পারছে কিন্তু সামনে দিয়ে মশা উড়ে যাওয়াকে সহ্যই করতে পারছে না। মশা মানেই ডেঙ্গু। আর যদি হয় দিনের মশা তাহলে তো কথাই নেই। অনেকেই একটি বিশেষ রঙের বা কালো ফোটা-ফোটা বিশেষ ধরণের মশার ছবি দেখিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন এটিই এডিস মশা। এটিই কি ঠিক? নাকি, যেকোনো ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর শরীরে বসা মশা যদি আরেকজনের শরীরে বসে তাহলে সেটিই ডেঙ্গু সংক্রমণকারী এডিস মশা হিসেবে ভূমিকা রাখবে। নাকি একমাত্র এডিস মশা রক্ত-শোষণ করলেই ডেঙ্গুর জীবানুতে মানুষ আক্রান্ত হবে?
হয়তো স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও বিজ্ঞানীরা এসব বিষয় ভালো করেই জানেন। তারা টেলিভিশন টক শো কিংবা নানান জায়গায় তাদের এসব বিষয়ের অভিজ্ঞতা জানান দিচ্ছেন, কিন্তু আমার চোখে, কানে পড়েনি। তাই প্রশ্নটি থেকেই গেছে। গতবছর যখন আমি চিকনগুনিয়া আক্রান্ত হয়ে একজন মেডিসিন বিশেষজ্ঞের কাছে যাই, তিনি এক আজব বিষয় আমাকে বলেছিলেন। ‘এসব মশা টশা কিছু না। আমাদের কোনো শত্রূদেশ কৌশলে আমাদের দেশের বাতাসে কিংবা মশার মাধ্যমে এমন কোনো জীবানু ঢুকিয়ে দিয়েছে, যা থেকে আমাদের আর নিস্তার নেই। এর ফলাফল আরো হয়তো ভয়াবহ”। সিনেমায় এমন বিষয় দেখেছি। এ যদি বাস্তব হয়, তাহলে তো সত্যিই রোমহর্ষক।
আমি নিজেই একজন পুরোনো ডেঙ্গু রোগী। আমার তিনবার এই ধরণের জ্বর হয়েছে। এখনও সারা শরীরে ব্যথা বয়ে চলেছি। শরীরের হাড্ডির জোড়ায় জোড়ায় ব্যথাকেই জীবনসঙ্গী করে নিয়েছি। এ্যালোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি, কবিরাজি সব শেষ করেছি। নিজে বুদ্ধি করে অনেক টোটকা চিকিৎসা আবিস্কার করে প্রয়োগ করেছি। কাজ হয়নি বরং ব্যাথা থেকে আরো কয়েকটি রোগকে সঙ্গী করেছি।
এক. প্যানিক ডিজঅর্ডার, দুই. হাইপার টেনশন, তিন. স্মৃতি ভুলে যাওয়া। ২০১৬ সালে একবার ডেঙ্গু এবং পরের বছর ২০১৭ সালে দুইবার চিকনগুনিয়া। শেষবারের একবার ডেঙ্গু ছিল কি-না জানিনা। অনেকেই বলছেন তিনবার ডেঙ্গু হলে মানুষ বাঁচে না। তার মানে আমি বুঝে নিয়েছি আমার তিনবার ডেঙ্গু হয়নি। যাতে আরো দুইবার ডেঙ্গু আক্রান্তের সুযোগ থাকে, তাই আমি সাধারণত বলি একবার ডেঙ্গু হয়েছে। দুইবার যদি ডেঙ্গু হয়, তাহলে আমার পরের বারের ডেঙ্গুটি হতে পারে প্রাণঘাতি। যখনই মশা আমার শরীরে বসে শুর ডুবিয়ে দেয়, আমি মশাটিকে মারার চেষ্টা করার আগেই অনেক আতংকিত হয়ে যাই। হয়তো রক্ষে নেই এবার। যা হোক, ভয়ে ভয়ে আছি।
আমার মতো ভয়ে ভয়ে আছেন সারা ঢাকার মানুষ। সারা দেশের মানুষ। আমাদের দেশে গত পাঁচ বছর ধরে একই মৌসুমে ক্রমান্বয়ে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বাড়ছে। এ নিয়ে রোগতত্ত্ব গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নানা পরিকল্পনা ও চিন্তাভাবনা করেন। কিন্তু মৌসুম এসে গেলে বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো সংকট ঢুকে পড়ে। তখন কারোরই কিছু করার সাধ্য থাকে না।
আমার প্রশ্ন জেগেছিল, যেসব যন্ত্রপাতি দিয়ে ডেঙ্গুর ভাইরাস পরীক্ষা করা হচ্ছে, সেগুলো ঠিক আছে কি-না! সে প্রশ্ন তোলা হয়নি। কারণ, এটি ডাক্তাররা নিশ্চিত হতে পারেন সহজ ও প্রচলিত কিছু পরীক্ষার মাধ্যমে। যা হোক সরকার ডেঙ্গু পরীক্ষার জন্য প্রচুর সংখ্যক কীট আমদানি করা হচ্ছে। আমদানিকারকরা সরকারের কাছে অনুনয় বিনয় করে সেগুলো অনুমোদন নিয়েছে। সেগুলো বিভিন্ন স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে বিতরণ করা হচ্ছে। সেগুলো দিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ডেঙ্গু সনাক্ত করা হবে। জানা যাচ্ছে, আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই আতংক আর তৎপরতা থাকবে। না জানি এই সময়ের মধ্যে কত কত আতংকজনক খবর আর শোকের কষ্ট আমাদেরকে দংশন করবে।
সাধারণের প্রশ্ন ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কি একঝাঁক উৎসাহী নেতা-বুদ্ধিজীবী-তারকা নিম্নমাণের ঝাড়ুদারের ভূমিকা রেখেই দায়িত্বের ইতি টানবেন? বিজ্ঞানসম্মতভাবে কি কিছুই করা হচ্ছে না? আসলে কাজ অনেকই হচ্ছে। বাইরে থেকে অনেক কিছু আমদানি যেমন চলছে, স্থানীয়ভাবেও চলছে বিপুল অংকের অর্থ ব্যয়সাপেক্ষ গবেষণাসহ নানামুখি তৎপরতা।
অনেকেই এখনও জানেন না পৃথিবীর অন্যান্য দেশের বিজ্ঞান গবেষণার সঙ্গে ছন্দ মিলিয়ে আমাদের দেশেও এডিস দিয়ে এডিস মশা বিনাশ করার একটি গবেষণা চলছে। বিজ্ঞানীরা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে এখন দুটো বিকল্প উপায় বিবেচনা করছে। এজন্যে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি কমিটিও গঠন করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
তারা এখন মশা মারতে কামান দাগানো নয় বরং মশা দিয়েই চাইছেন ‘ডেঙ্গু মশা’ মোকাবেলা করতে। কমিটি ভাবছে দুটি দিক। এক. উবাকিয়া ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে এডিস প্রতিরোধ, দুই. জেনেটিক্যালি মডিফায়েড মশা উদ্ভাবণ। এই দুটো পদ্ধতিই চীনে পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে। পরীক্ষা করা হয়েছে দু’বছর সময় ধরে। তাতে দেখা গেছে সেখানে মশার বংশ-বিস্তার ৯০ শতাংশের মতো কমে গেছে। তবে এ পদ্ধতি নিয়েও বিতর্ক ও প্রশ্ন রয়েছে। অনেকেই মনে করছেন জেনেটিক্যালি মোডিফাইড মশার মাধ্যমে যখন মশার বংশ বিস্তার রোধ করার উদ্যোগ নেয়া হবে, তখন সেই মশা মানুষের রক্ত শোষণ করার সময় তার দেহের যে বৈশিষ্ট মানুষের রক্তে সরবরাহ করবে, এতে মানুষেরও বন্ধ্যা হয়ে পড়ার আশংকা রয়েছে।
নিশ্চয়ই এসব বিষয় বিবেচনা করেই পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর গবেষণার সঙ্গে মিলিয়েই আমাদের দেশের উপযোগী একটি পদ্ধতি আবিস্কার ও প্রয়োগ করা সম্ভব হবে। তবে মশা নিধন ঔষধ আমদানির ক্ষেত্রেও আমরা যেভাবে চুরি, কারচুপি ও অনিয়ম করি এতে আমাদের ওপরও যে প্রকৃতির এক দীর্ঘশ্বাস জেঁকে বসেছে এতে সন্দেহ নেই। আমরা অন্যায়, নীতিহীনতা, কাপটতা, ভণ্ডামি, অত্যাচার, মিথ্যাচার এসব করতে করতে নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে এতদূর এসে পড়েছি যে, আমরা নিজেরাই এখন ভয় পাচ্ছি, হয়তো কখন অকস্মাৎ কোনো দুর্বিপাকে প্রাণপাত ঘটে যায়।
আমার এক সাংবাদিক বন্ধু বলছিলেন, আমরাও এখন সিরিয়ার নাগরিকের মতো মৃত্যুর আতংক নিয়ে ঘুরছি। যে যুদ্ধ চলছে, যে নাশকতা চলছে, তাতে কখন কে অকস্মাৎ জীবনসাঙ্গ করে চলে যাই তা অনুমান করারও উপায় নেই। সবাই যেন ঠোঁটের ওপর প্রাণ নিয়ে সবকিছু ভুলে স্বাভাবিক পথ চলার অভিনয় করে যাচ্ছি।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)