সম্প্রতি সারাদেশে মারাত্মক আকারে ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ দেখা দিয়েছে। এ জ্বর কোন সাধারণ জ্বর নয়। ‘এডিস’ নামক এক ধরনের মশার কামড়ে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয় মানুষ। একবার এই রোগে আক্রান্ত হলে ভোগান্তির শেষ নেই। তাই ডেঙ্গু প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধের চেষ্টা করাই শ্রেয়।
তারপরও যদি আক্রান্ত হয়েই পড়েন, সেক্ষেত্রে রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের পরামর্শের পাশাপাশি ঘরোয়াভাবেও অবস্থার উন্নতি করা অনেকাংশে সম্ভব। যারা বাসার ছাদে বা বেলকনিতে টবে রেখে গাছের পরিচর্যা করেন, তাদের এসময় কিছুটা সর্তকতা অবলম্বন করা জরুরী। গাছের টব থেকে ‘এডিস’ মশার জন্ম হতে পারে। তাই ডেঙ্গু প্রতিরোধে ব্যক্তিগত উদ্যোগও আবশ্যক।
ডেঙ্গু একটি ভাইরাসজনিত জ্বর। অন্য ভাইরাসজনিত জ্বরের মতো ডেঙ্গুর সরাসরি প্রতিষেধক নেই, টিকাও নেই। লক্ষণ অনুযায়ী এর চিকিৎসা করা হয়। মশা নিধনে এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধি পেলে ডেঙ্গুর প্রকোপ শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনা সম্ভব। বর্ষা মৌসুমে কোথাও যাতে স্বচ্ছ পানি না জমে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। কেউ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে যথাসম্ভব দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
চলতি মাসে রাজধানীতে প্রতিদিন গড়ে ২০ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হচ্ছে। বেসরকারি হিসেবে এই সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ পর্যন্ত মোট ৩৬৩ জন ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গেছে। এ বছর আগস্ট শেষ হওয়ার আগেই শনাক্ত হয়েছে ১৩শ’ ডেঙ্গু রোগী।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিবছর জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গুর প্রকোপ থাকে। কিন্তু এ বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ গত কয়েক বছরের তুলনায় তীব্র মনে হচ্ছে। রাজধানীতে মশার উপদ্রব বেড়ে যাওয়ায় এবার ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ বেশি। চলতি বছর বর্ষা মৌসুমে প্রায় ২ হাজার মানুষ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। পরিসংখ্যানটি একেবারেই হেলাফেলা করার মতো নয়।
বর্ষা মৌসুমে, বিশেষত বছরের জুন মাস থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত সময়টিতে ডেঙ্গুর জীবানুবাহিত ‘এডিস’ মশার উপদ্রব বৃদ্ধি পায়। কাজেই পূর্ব সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে ও জনসচেতনতা সৃষ্টি করলে ডেঙ্গু মোকাবিলার কাজটি কঠিন কিছু নয়। কিন্তু ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের কার্যক্রমে দ্বিতীয়টি অর্থাৎ কিছু জনসচেতনামূলক পদক্ষেপ চোখে পড়লেও পূর্ব সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে মশক নিয়ন্ত্রণ এবং মশক প্রজনন ক্ষেত্রগুলো পরিস্কারে তেমন সক্রিয়তা দেখা যায়নি।
রাজধানীসহ সারা দেশে মশার উপদ্রব ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। স্প্রে আর মশার কয়েল ব্যবহার করেও এর আক্রমণ থেকে মুক্তি পাচ্ছে না দেশবাসী। মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ট হয়ে উঠেছেন রাজধানীতে বসবাসকারী সাধারণ মানুষ। তবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে যে,রাজধানী ঢাকা শহরের দুই ভাগে বিভক্ত ঢাকা উত্তর আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মশা নিধন কার্যক্রমের জন্যে বরাদ্ধকৃত অর্থের সিংহভাগই হাতিয়ে নিচ্ছে একটি সংঘবদ্ধ চক্র।
বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা বলছেন, আমাদের দেশে জুন ও জুলাই অর্থাৎ বর্ষা থেকে শুরু হয় ডেঙ্গুজ্বরের প্রকোপ। মশা নিধনের প্রচলিত যেসব কার্যক্রম বর্তমানে আছে তা কার্যকর বলে মনে হয় না। শুধু নর্দমায় মশা নিধনের ওষুধ ছিটিয়ে মশার বিস্তার রোধ করা সম্ভব নয়। ডেঙ্গুবাহিত মশার বিস্তার রোধ করতে হলে বিভিন্ন স্থানে জমে থাকা পানিও অপসারণ করতে হবে। সিটি করপোরেশনগুলোর ওষুধ ছিটানোর ক্ষেত্রে এ বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া উচিত।
পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, রাজধানীর মশা নিধনের কাজটি ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের। যে কাজটি সঠিকভাবে হয়নি। সিটি করপোরেশনের উচিত ছিল ডেঙ্গুজ্বর ছড়ানো এডিস মশার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে গুরুত্ব দিয়ে মশা নিধনে উদ্যোগ নেয়া। তাই দুই সিটি করপোরেশনকে জবাবদিহিতার বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে।
ঢাকা সিটি করপোরেশনের তথ্য মতে,শুধুমাত্র ঢাকা শহরেই ৫ শতাধিক জলাশয় রয়েছে। জলাশয়গুলো দীর্ঘদিন ধরে অযত্নে-অবহেলায় পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। জলাশয়গুলো পরিস্কার করার কারো কোনো উদ্যোগ নেই। সতীনের ছেলের মতো সবাই একে শুধু অবহেলাই করে গেল। তাই এ সব জলাশয়গুলো মশাদের প্রজনন ক্ষেত্র হিসেবে পরিণত হয়েছে।
জানা যায়, চলতি বছর ১ জানুয়ারি থেকে ২৮ জুলাই পর্যন্ত রাজধানীতে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা ৭৪২ জন। এদের মধ্যে মারা গেছেন ৪জন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে,২০১৫ সালে দেশে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়েছিলেন ৩ হাজার ১৬২ জন, মারা যান ৬জন।
ডেঙ্গুর প্রকোপ ঠেকাতে সরকারের বিভিন্ন প্রতিশ্রুতির পরও যখন এতো সংখ্যক মানুষ এ জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে,তখন স্বাভাবিকভাবেই মশা নিধনের বিষয়টি উপেক্ষিত হয়েছে বলেই প্রতীয়মান।
উল্লেখ্য, প্রতি বছর মশক নিয়ন্ত্রণ খাতে ব্যয় করা হয় ৩০ কোটি টাকা। চলতি অর্থ বছরে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এ খাতে অর্থ বরাদ্দ রেখেছে ১৭ কোটি টাকা এবং দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ১৩ কোটি টাকার কিছু বেশি। বাস্তবতা হচ্ছে, এই বিপুল অংকের বরাদ্দ সত্ত্বেও এর ন্যূনতম সেবা পাচ্ছে না নগরবাসী। নালা-নর্দমায় এবং উড়ন্ত মশক নিধনে সিটি করপোরেশনের কোনো কার্যক্রমই চোখে পড়ে না।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, দুই সিটি করপোরেশন এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের ঢাকা মশক নিবারণী কেন্দ্রে প্রায় ৭০০ জন মশক নিধন শ্রমিক রয়েছেন। ফগার মেশিন রয়েছে ৫০০ টি। এছাড়াও আঞ্চলিক কার্যালয়গুলোতে রয়েছে ১০ জন স্বাস্থ্য কর্মকর্তাসহ ১৫ জন কর্মকর্তা। তারা যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করছেন না। এক্ষেত্রে যে গুরুতর অভিযোগটি উঠছে তা হলো,মশক নিধনে যে ওষুধ বরাদ্দ দেয়া হয় তার সিংহভাগ বাইরে বিক্রি করে দেয় মশক নিধন কাজে নিয়োজিত শ্রমিকরা। অসাধু এই শ্রমিকচক্ররে সাথে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষরে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগও রয়েছে।
রাজধানীতে সরকারিভাবে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত এবং মৃত্যুর যে তথ্য দেয়া হয়েছে বাস্তবের সঙ্গে তার বিস্তর পার্থক্য থাকতে পারে বলে অনেকে ধারণা করছেন। রাজধানীর অধিকাংশ হাসপাতালেই ডেঙ্গু শনাক্তকরণের কার্যকর ব্যবস্থা নেই। ফলে টাইফয়েড ও ডেঙ্গুর পার্থক্য নির্ণয়ে প্রায়ই চিকিৎসকদের হিমশিম খেতে হয়।
চিকিৎসকরা বলেছেন, বৃষ্টি ও তাপমাত্রা বৃদ্ধি ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়াতে ভূমিকা রাখে। ঘন ঘন বৃষ্টির কারণে রাজধানীর যেখানে সেখানে পানি জমছে। স্বচ্ছ পানিতে ডিম পারছে ডেঙ্গুর ভাইরাস বহনকারী ‘এডিস’ মশা।
রাজধানীতে ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধি এবং এ রোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা গত ২০ বছরের সকল রের্কড ছাড়িয়ে গেছে। এই ঘটনা নির্বাচিত দুই সিটি করপোরেশনের জন্যে কলঙ্কের তিলক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। মশক নিধনে ওষুধ ছিটানো যন্ত্রের অভাব রয়েছে দুই সিটি করপোরেশনেই।
তবে মশক নিধন কার্যক্রমের সাথে সংশ্লিষ্টরা যদি দুর্নীতিবাজ হয়, তাহলে সব ধরনের উপকরণ থাকার পরও মশার উপদ্রব কমবে না। সুতরাং সর্বাগ্রে সিটি করপোরেশনকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না, সিটি নির্বাচনের আগে মেয়র প্রার্থীরা এ ব্যাপারে বড় বড় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। দুই সিটি করপোরেশনের মেয়র মহোদয়রা যেন তা ভুলে না যান। মশক নিধনসহ সব ধরনের নাগরিক সেবা প্রদানে তারা দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেবেন, তেমনটি-ই নগরবাসী প্রত্যাশা করেছিলেন।
পত্রিকান্তরে জানা যায়, রাজধানীর মশা নিধনের কার্যক্রমের জন্যে গড়ে প্রতি মাসে ১ কোটি ৯৩ লাখ ১৫ হাজার টাকা ব্যয় হচ্ছে। কিন্তু এই টাকা কোথায় খরচ হচ্ছে, সেটা একটি বিরাট প্রশ্ন! রাজধানীতে ক্রমশ মশার উপদ্রব বেড়েই চলছে।
পর্যাপ্ত সংখ্যক লোকবল ও ব্যাপক সরঞ্জামাদি এবং যথেষ্ঠ পরিমাণ বরাদ্দ থাকার পরও মশা নিধন কার্যক্রমে পুরোপুরি ব্যর্থ রাজধানী ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ যতো কথাই বলুন না কেন, মূল কথা হচ্ছে সিটি করপোরেশনের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের লুটপাটের কারণেই মশার জ্বালা বা মশার উৎপাত ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে মনে করেন ভুক্তভোগীরা। দুর্নীতি বন্ধ হলে বাংলাদেশ থেকে শতকরা ৮৫ ভাগ ব্যর্থতা দূর করা সম্ভব বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত।
রাজধানীতে মশা ও মাছির উপদ্রব অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। অনির্বাচিত সিটি করপোরেশনের আমলে অভিযোগ ছিলো ব্যাপক। মশা নিধনে রাজধানীর দুটি স্থানীয় সরকারি প্রতিষ্ঠান গাফিলতির পরিচয় দিচ্ছে সমান্তরালে।
বর্তমানে নির্বাচিত সিটি করপোরেশনের আমলে ‘এডিস’ মশাবাহী রোগ ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করায় প্রমাণিত হয়েছে, নির্বাচিত সিটি করপোরেশন এ ব্যাপারে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে পারেনি। মশা নিধনে বরাদ্দ বাড়লেও সেটা জনর্দুভোগ কমাতে পারেনি, ডেঙ্গুর প্রকোপ সে বাস্তবতাই তুলে ধরছে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)