চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

ডেইলি স্টার নিয়ে যে নোংরা রাজনীতি

‘মাহফুজ আনামকে নিয়ে আমি কথা বলব না। কারণ, সেদিন ভয়ে অনেকে বিবেককে জলাঞ্জলি দিয়েছিলেন। আজকে এই সংসদে সদর্পে বসে আছেন যাঁরা, সেদিন যাঁরা বাধ্য হয়ে বিবেককে জলাঞ্জলি দিয়ে সত্যের অপলাপ করেছিলেন।’ সংসদ সদস্য তাহজীব আলম সিদ্দিকী এইটুকু বলার পরই স্পিকার জানতে চান- সংসদ সদস্য কি বিষয়ে কথা বলতে চান। যিনি জাতীয় সংসদের সদস্য হয়েছেন, তার স্পিকারের ঈঙ্গিতটুকু বুঝতে না পারার কোনো কারণ নাই।

তাহজীব আলমও সঙ্গে সঙ্গে অন্য প্রসঙ্গে চালে যান। এটুকু বাদ দিলে বাদবাকি এমপিদের যারা ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামের বিষয়ে বক্তৃতা করেছেন- তাদের মধ্যে স্পষ্টতই একটা প্রতিযোগিতা ছিলো- কে কতো তীব্র ভাষায় আক্রমণ করতে পারেন।

কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় ডেইলি স্টার সম্পাদককে নিয়ে যে বক্তব্য ফেসবুকে দিয়েছিলেন- মূলত: সেগুলোকেই পুনরায় তারা বলছিলেন। সম্ভবত সজীব ওয়াজেদ জয়ের দৃষ্টি আকর্ষণের একটি প্রতিযোগিতাও তাদের মধ্যে কাজ করছিলো।

জাতীয় সংসদে কারো নাম উল্লেখ করে কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ সমালোচনা হলে তাকেও আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়ার রেওয়াজ আছে। এটা সংসদীয় রীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরা অবশ্য সংসদে নেই মানে এমপি নন- সংসদে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ নাই, এমন ব্যক্তিদের ‘ধোলাই দেওয়া’কেও সংসদীয় রীতি বানিয়ে ফেলেছেন।

কাজেই মাহফুজ আনামকে নিয়ে সংসদে ‘বাক্য ধোলাই’ দেওয়া নিয়ে নীতি নৈতিকতা, যৌক্তিকতা- ইত্যাদির প্রশ্ন তোলা অবান্তর। আমরা বরং সংসদ সদস্যদের বক্তব্যগুলোর একটি বিশ্লেষণ দাঁড় করাতে পারি। জাতীয় সংসদের ফ্লোরে দাঁড়িয়ে সরকারি দলের সংসদ সদস্যগণন যখন দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়ার দাবি তুলেন- তখন যে কোনো সচেতন মানুষই আতংকিত না হয়ে পারেন না।

তর্কের খাতিরে কেউ কেউ হয়তো বলবেন, এটি তো সরকারের দায়িত্বশীল কারো বক্তব্য নয়, কয়েকজন এমপিদের ভাবনা মাত্র। একমত। কিন্তু কয়েকজন এমপি’র সেই ভাবনাগুলো জাতীয় সংসদে উন্মোচন করা হয়েছে এবং স্পিকার সেই আলোচনাকে অনুমোদন করেছেন। সরকারের এই আলোচনায় সায় না থাকলে সরকারদলীয় চিফ হুইপ সেই আলোচনা থামিয়ে দিতে পারতেন। মাহফুজ আনামকে গ্রেফতার এবং ডেইলি স্টার বন্ধ করে দেওয়ার মতো আতংকজনক ভাবনায় তা হলে সরকারের সায় আছে?

মজার ব্যাপার হচ্ছে, যে ঘটনাগুলো প্রকাশের জন্য ডেইলি স্টার বন্ধের দাবি তোলা হচ্ছে- সেই ঘটনাগুলো কিভাবে তৈরি হলো তা নিয়ে কিন্তু কেউ কথা বলছেন না। ডেইলি স্টার নিজেরা মিথ্যা কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি। তারা ডিজিএফআইর পাঠানো প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলো মাত্র। যেটি সেই সময় প্রায় সবকটি পত্রিকাই প্রকাশ করেছে। আর ডিজিএফআইর পাঠানো প্রতিবেদনগুলো ছিলো মূলত: আওয়ামী লীগের নেতাদের জবানবন্দি। এমপি সাহেবরা সংসদে ডেইলি স্টারের শাস্তি দাবি করলেও যারা মিথ্যা জবানবন্দি দিয়েছেন কিংবা মিথ্যা জবানবন্দি দিতে বাধ্য করেছিলেন- তাদের ব্যাপারে টুঁ শব্দটিও করছেন না।

এতেই কিন্ত তাদের উদ্দেশ্যটা পরিষ্কার হয়ে যায়। একটি দেশে গণতন্ত্রের ভিত্তি কতোটা মজবুত তা সেই দেশের গণমাধ্যমের অবস্থান থেকে পরিমাপ করা যায়। যে দেশের গণতন্ত্র যতো মজবুত সেই দেশে গণমাধ্যমও ততোটাই শক্তিশালী। স্বৈরশাসকেরা কখনো গণমাধ্যমকে শক্তিশালী হিসেবে দেখতে চায় না। অগণতান্ত্রিক শাসনামলে স্বাধীন এবং শক্তিশালী মিডিয়া নানাভাবে হয়রানির শিকার হয়, আর দুর্বল, বশংবদ মিডিয়া রাষ্ট্রের তথা সরকারের অনুকূল্য পায়। আশংকার কথা, বাংলাদেশেও এখন শক্তিশালী মিডিয়াগুলো সরকার এবং সরকার সমর্থকদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্ততে পরিণত হয়েছে।এটা সত্য যে, মাহফুজ আনামের ভুল স্বীকারের মধ্য দিয়ে ১/১১ আবারো আলোচনায় উঠে এসেছে। এমপি সাহেবরাও এ নিয়ে সোচ্চার হয়েছেন। খুবই ভালো কথা। এমপিরা সাহেবরা কি পুরো ১/১১ এবং পরবর্তী সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভূমিকা খতিয়ে দেখার জন্য একটি টাস্কফোর্সের দাবি তুলতে পারবেন?

সেই সময় কার কী ভূমিকা ছিলো, রাজনীতিকদের কী ভূমিকা ছিলো, আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতারা কেনো দলীয় নেত্রীর বিরুদ্ধে এমন অপবাদ তুলে জবানবন্দি দিলেন, সামরিক গোয়েন্দা সংস্থাই বা কেনো সেগুলো মিডিয়ায় পাঠিয়ে তা প্রকাশে বাধ্য করলো- এসব কিছুইতো পর্যালোচনা হওয়া দরকার। যেই এমপিরা সংসদে ডেইলি স্টার নিয়ে সোচ্চার হয়েছেন, তারা কি এগুলো নিয়েও প্রশ্ন তোলার সাহস রাখেন? ১/১১ নিয়ে নতুন বিতর্কে সরকারের, দল হিসেবে আওয়ামী লীগের অবস্থানটাও বোধ হয় পরিষ্কার হওয়া দরকার। জাতীয় সংসদে একটি পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়ার দাবি তোলা হলে- সরকারের চরিত্র সম্পর্কে প্রশ্ন তৈরি হয়। সামগ্রিকভাবে অন্যান্য মিডিয়ার জন্যও আতংকজনক পরিস্থিতি তৈরি করে।

আর একটা কথা, ডেইলি স্টার- মাহফুজ আনাম আক্রান্ত হয়েছেন- এই ভেবে যে সম্পাদকরা তৃপ্তির ঢেকুর তুলছেন, তারা বোধ হয় নিজেদের বিপদটা আঁচ করতে পারছেন না। ডেইলি স্টার শক্তিশালী মিডিয়া, শক্তিশালী মিডিয়া আক্রান্ত হলে, সেই আক্রমণ কোনো ধরনের প্রতিরোধ বা প্রতিবাদের মুখোমুখি না হলে অপেক্ষাকৃত দুর্বল মিডিয়াগুলোতে নিমিষেই নাই হয়ে যাবে। ডেইলি স্টার নিয়ে নোংরা রাজনীতির এখনই অবসান হওয়া দরকার।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)