নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি নেতৃত্বাধীন তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকারের সব ধরনের গেম-প্ল্যানকে নস্যাৎ করে জেনারেল মইনের নেতৃত্বাধীন সেনাবাহিনীর পৃষ্ঠপোষকতায় ড. ফখরুদ্দীন আহমদের সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও মিডিয়ায় তা ১/১১ সরকার হিসেবে পরিচিত পায়।
তৎকালীন রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও বিপদসংকুল অবস্থার প্রেক্ষিতে ফখরুদ্দীন-মইনউদ্দীন সরকারকে দেশের প্রবীণ সাংবাদিকদের কেউ কেউ ‘গড-গিফটেড’ বলেও অভিহিত করেছেন। বলা বাহুল্য, অনির্বাচিত এই সরকারের শক্তিশালী আগমনের পর দেশের সাধারণ জনগণ বিপুল সমাদরে গ্রহণ করেছে। রাজনৈতিক দলের মধ্যে ১/১১ সরকারকে সর্বপ্রথম অভিনন্দন জানিয়েছে বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এমনকি এই দলের শীর্ষ ব্যক্তি ১/১১ সরকারকে তাদের আন্দোলনের ফসল হিসেবে সার্টিফাই করেছেন।
বিএনপি জোট ছাড়া অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতারা ইয়াজ উদ্দীনের তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে হটিয়ে ১/১১ সরকার আনার ক্রেডিট নেওয়ার জন্য অঘোষিত প্রতিযোগিতায় নেমেছিলেন। এর পিছনের কারণটাও অবশ্য পরিষ্কার। আর তা হলো, ফখরুদ্দীন-মইনউদ্দীন সরকারের আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা। মূলত ১/১১ সরকারের অভাবনীয় জনপ্রিয়তায় ভাগ বসানোর জন্যই এই সরকারকে ক্ষমতায় আনায় তাদের অবদানের কথা বলে বেড়াতেন।
এটা ভুলে যাওয়ার কোন কারণ নেই যে, ১/১১’র পর ফখরুদ্দীন-মইনউদ্দীন সরকার প্রতিষ্ঠার পর দুর্নীতি বিরোধী টাস্কফোর্সের সাঁড়াশি অভিযানে সকল রাজনৈতিক দলের নেতারাই আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন। অনেক বাঘা বাঘা নেতা গ্রেফতার হন। কেউ কেউ দেশ ছেড়ে পালিয়ে বাঁচেন। গ্রেফতারকৃত নেতাদের দুর্নীতির অজানা কাহিনীর অডিও সিডি ডিজিএফআইয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন মিডিয়ায় সরবরাহ করা হয়।
এমনিতে রাজনীতিকদের চরম অসহিষ্ণুতা ও বাড়াবাড়ি সাধারণ জনগণ ভালোভাবে নেয়নি। দলীয় নেতাকর্মী বাদে আপামর জনসাধারণ রাজনীতিকদের একরকম ঘৃণা করাই শুরু করেন। ডিজিএফআই যেমন এই বাস্তবতার সুযোগ নিয়েছে। দেশের মিডিয়াও এমন সুযোগ হাত ছাড়া করতে চায়নি। তাই, ডেইলি স্টার-প্রথম আলোসহ দেশের উল্লেখযোগ্য সব পত্রিকায়ই তা সিরিজ আকারে ছাপা হয়। ওই সময়ে পত্রিকার সার্কুলেশন পর্যন্ত বেড়ে গিয়েছিল।
রাজনীতির মানুষদের দুর্নীতির মুখরোচক কাহিনীগুলো দেশের সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও ছড়িয়ে পড়ে। যদিও আমাদের রাজনীতিকরা ধোঁয়া-তুলসি পাতা নন, তথাপি এ ধরণের প্রচারণায় তাদের এতদিনের ভাবের মূর্তিটি দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
তারপর যেন সব ঠিক ঠাক। নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ তার মহাজোট নিয়ে ক্ষমতায় বসে মধু-চন্দ্রিমা শেষে এসব কষ্ট কথা বেমালুম ভুলে যায়। ক্ষমতাসীন রাজনীতির মানুষগুলো আবারো তাদের চিরাচরিত পেশায় মনোযোগ দেয়। অন্যদিকে বিএনপি ও তার জোট নির্বাচনে প্রাপ্ত নগণ্য ভোটের কষ্ট সামলাতে একাই ১/১১ সরকারের চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধারে নামে।
সম্প্রতি ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম এটিএন নিউজের একটি টকশোতে এ ব্যাপারে অভাবনীয় মন্তব্য করার পর আমাদের আয়েশী রাজনীতিকদের যেন টনক নড়েছে। তারা নিজেদের চরিত্রের শুদ্ধতা প্রমাণের সুযোগ পেয়ে গেছেন মাহফুজ আনামের স্বীকারোক্তির পর। তাই আর দেরি না করে নিজেদের দেবতা প্রমাণে মাহফুজ আনামদের এক হাত নিতে চান! এ জন্য তারা জাতীয় সংসদে সমস্বরে মাহফুজ আনাম ও তার ডেইলি স্টারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি তুলেছেন।
সাংসদদের হঠাৎ এমন প্রতিবাদী হয়ে ওঠার শান-ই-নুযুলটাও মোটামুটি স্পষ্ট। প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা, প্রধানমন্ত্রীপুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের ফেসবুকে মাহফুজ আনামকে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় অভিযুক্ত ও ডেইলি স্টার পত্রিকা বন্ধ করে দেয়ার দাবি জানানোর পর মাননীয় জাতীয় সংসদ সদস্যগণ সোচ্চার হয়েছেন। যদিও সন্দেহ থেকেই যায়, আসলেই কি তারা মাহফুজ আনামকে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় শাস্তি দিতে চান, নাকি বিশেষ কোন ব্যক্তির আশীর্বাদ-ধন্য হতে চান?
মাহফুজ আনাম টকশোতে ১/১১ সরকারের সময় সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বহীনতার জন্য ভুল স্বীকার করেছেন। একই সাথে তিনি ইংরেজি দৈনিক নিউ এজ পত্রিকা ও এর সম্পাদক নুরুল কবিরকে সঠিক দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার জন্য কৃতিত্ব দেন।
আলোচিত টকশোর পর জনাব মাহফুজ আনামকে নিয়ে দেশব্যাপী ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়। বিশেষ করে দ্বিধা-বিভক্ত ও সুবিধাবাদী সাংবাদিকদের একাংশ মাহফুজ আনাম ও তার ডেইলি স্টারকে ‘সাইজ’ করতে উঠে পড়ে লেগেছেন। ক্ষমতাসীন রাজনীতিকদের কিছু অংশ মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে জিহাদে নামলেও বিস্ময়করভাবে বিএনপি মাহফুজ আনামের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছে! যদিও মাহফুজ আনামের এমন সরল স্বীকারোক্তি অনেক মহলে প্রশংসিত হয়েছে।
ডিজিএফআইয়ের দেয়া দুর্নীতির কাহিনী ছাপানোর কারণে নিজেদের চরিত্রে কালিমা লাগায় যাদের দিলে চোট লেগেছে, তারা কিন্তু এসব কাহিনী যেসব রাজনীতিকদের স্বীকারোক্তিমূলক বয়ানে সৃষ্ট, তাদের ব্যাপারে একেবারেই নিরব! বরং নিজেদের চরিত্রে কালিমা লেপনকারী সেইসব রাজনীতিকদের সাথে নিয়েই ‘দেশ উন্নয়ন কিংবা দেশ উদ্ধারে’ সতীর্থ হয়েছেন। ডিজিএফআইয়ের তখনকার ভুমিকা নিয়েও তাদের কোন বক্তব্য নেই।
ডিজিএফআইয়ের ‘অনৈতিক ভুমিকা’ নিয়ে যাদের টু-শব্দটি করার শক্তি সাহস নেই, তারা দেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী ইংরেজি দৈনিকের সম্পাদককে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলাতে আদা-জল খেয়ে নেমেছেন। মাহফুজ আনাম বিষয়ক ‘লেবু-কচলানো’ আর কতদিন চলে কে জানে। তবে এটা সবাই জানে, লেবু বেশি কচলালে তেঁতো হয়!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)