জাতীয় রাজনীতিতে ছাত্ররাজনীতির গুরুত্ব তুলে ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের ব্যাপারে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদের আহ্বানকে ছাত্রলীগ স্বাগত জানালেও ‘ন্যুনতম আস্থা’ রাখতে পারছে না ছাত্রদল। মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্র ফেডারেশনসহ বিভিন্ন বাম সংগঠন। আর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে, চ্যান্সেলর নিজে ডাকসু নির্বাচনের তাগিদ দেয়ার পর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ভাবা হচ্ছে।
শনিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে আয়োজিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০তম সমাবর্তনে রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য মোঃ আবদুল হামিদ বলেন, ‘ডাকসু নির্বাচন ইজ অ্যা মাস্ট। নির্বাচন না হলে ভবিষ্যৎ নেতৃত্বে শূন্যতার সৃষ্টি হবে।’
রাষ্ট্রপতির আহ্বানকে স্বাগত জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ সভাপতি আবিদ আল হাসান চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ‘নির্বাচন আয়োজনের সম্পুর্ণ দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের। তারা যদি নির্বাচনের আয়োজন করে তবে আমরা স্বতঃস্ফুর্তভাবে তাতে অংশগ্রহন করবো।’
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগও একইরকম মত তুলে ধরে চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: এটা আমাদের দীর্ঘদিনের দাবি। শুধু ডাকসু নয়, সকল বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজেই ছাত্র সংসদ নির্বাচন হওয়া উচিত। আশা করি, অচিরেই নির্বাচনগুলো আয়োজন করা হবে।
তবে, প্রশাসনের উপর আস্থাহীনতার কথা তুলে ধরে রাষ্টপতির আহ্বানকে প্রত্যাখ্যান করেছে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি আল মেহেদি তালুকদার চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ‘এ বক্তব্য ভুতের মুখে রামনামের মতো। আমাদের তাতে ন্যুনতম আস্থা নেই।’
ডাকসু নির্বাচনের আগে ছাত্রদল সভাপতি গুরুত্ব দিতে চান ক্যাম্পাসে বিভিন্ন সংগঠনের সহাবস্থানের উপর। এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে অসহযোগিতার অভিযোগ করেন তিনি।
বিষয়টি নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া এসেছে বাম ছাত্র সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে। ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি তুহিন কান্তি চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, দেরিতে হলেও রাষ্ট্রপতি যে ডাকসু নির্বাচনের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পেরেছেন এজন্য স্বাগত জানাই। এখন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চাইলেই হয়। যদি এ নির্বাচনের আয়োজন না হয় তাহলে আমরা খুব দ্রুতই এ দাবিতে বিভিন্ন কর্মসূচি দেবো।’
ছাত্র ফেডারেশন মনে করে রাষ্ট্রপতি বলার চেয়ে স্বায়ত্ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য যদি এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট আশ্বাস দেন তবে তারা আরও বেশি আশাবাদী হবেন।
সংগঠনটির বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক তাহসিন মাহমুদ চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, রাষ্ট্রপতির চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য যদি ঘোষণা দেন বা ক্যাম্পাসে সক্রিয় বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে আলোচনায় বসেন তবে আমরা আশাবাদী হবো।
পাল্টা প্রশ্নে তাহসিন মাহমুদ বলেন, ‘আচার্য চান, উপাচার্য চান; তবে ডাকসু নির্বাচন আয়োজনের ক্ষেত্রে বাধাটা কোথায়?’
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: ডাকসু নির্বাচন নিয়ে আমরা দীর্ঘদিন ধরেই চিন্তা-ভাবনা করছি। রাষ্ট্রপতির বক্তব্যের পর বিষয়টি নিয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ভাবছি। সবকিছু ঠিক থাকলে আমরা দ্রুতই নির্বাচনের আয়োজন করতে পারবো।
উপাচার্য বলেন, আমরা চাই শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে নিয়মিত শিক্ষার্থীরাই আসুক। সে ব্যাপারটি নিশ্চিত করতে হবে আগে।
৯০’র পর বারবার বাতিল হয়েছে ডাকসু নির্বাচন
১৯৯০ সালের ৬ জুন সর্বশেষ ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এরপর বিভিন্ন ছাত্র সংঠনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন সময় এ নির্বাচনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও নানা কারণে নির্বাচন আর হয়নি।
গত ২৬ বছরে আওয়ামী লীগ চলতি মেয়াদসহ তিনবার এবং বিএনপি দুইবার ক্ষমতায় ছিল। কিন্তু, যখনই তারা ক্ষমতার বাইরে ছিল তখন তাদের সহযোগী সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগ এবং ছাত্রদল ডাকসু নির্বাচেনর বিরোধিতা করেছে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ১৯৯১ সালের ১২ জুন তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিঞা ডাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষনা করেছিলেন। ওই সময় কিছু সংখ্যক ছাত্রনেতা তাদের ছাত্রত্ব বজায় রাখার জন্য বিশেষ ভর্তির দাবি জানান। এ নিয়ে উদ্ভূত সহিংসতায় ডাকসু নির্বাচন ভণ্ডুল হয়ে যায়।
এরপর ১৯৯৪ সালে তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দিন আহমদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষনা করেন। কিন্তু ডাকসু নির্বাচনের পরিবেশ না থাকার অভিযোগ আনে ছাত্রলীগ। ফলে ডাকসু নির্বাচন স্থগিত হয়ে যায়। ১৯৯৫ সালে আবার নির্বাচনের তফসিল ঘোষিত হলেও নির্বাচন হয়নি।
পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালের অক্টোবরে অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী ভিসির দায়িত্ব নেয়ার পর অন্তত ছয়বার ডাকসু নির্বাচনের নির্দিষ্ট সময়সীমা গণমাধ্যমকে জানানো হয়েছিল। কিন্তু ‘বিভিন্ন বাধার’ কারণে তিনি আর ডাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষনা পারেননি।
১৯৯৭ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান হলে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ছাত্রদল নেতা আরিফ হোসেন তাজ খুন হলে এ ঘটনা তদন্তের জন্য গঠিত কমিটি তাদের সুপারিশে ডাকসু ভেঙে দিয়ে ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলে। ১৯৯৭ এর ২৭ মে সিন্ডিকেটের সভায় ১৯৯০ সালে নির্বাচিত ডাকসু ভেঙে দেয়া হলেও নির্বাচন আর হয়নি।
ডাকসুর জন্য গঠিত সংশোধিত গঠনতন্ত্রে ডাকসু ভাঙার চার সাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলা হয়েছে। সে অনুযায়ী ১৯৯৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বরের আগেই ডাকসু নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি।
আনুষ্ঠানিকভাবে ডাকসু ভেঙে যাওয়ার সাত বছর পর ২০০৫ সালের মে মাসে ভিসি হিসেবে দায়িত্ব নেয়া অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ ওই বছর ডিসেম্বরেই ডাকসু নির্বাচন দেয়ার কথা বলেন। কিন্তু তৎকালীন বিরোধী ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের বিরোধিতার কারণে সে নির্বাচনও হয়নি।
গত ২৬ বছর ধরে অকার্যকর ডাকসুর দাবিতে কখনও মৃদু, কখনও জোরালো আওয়াজ উঠলেও নির্বাচন আয়োজন করতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।