আগামী ছয় মাসের মধ্যে ডাকসু নির্বাচনের আয়োজন করতে হাইকোর্ট নির্দেশ দেওয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন সত্যিই হতে যাচ্ছে; এমন আশায় বুক বাঁধছেন ছাত্রনেতারা। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সদিচ্ছা নিয়ে সন্দিহান থাকলেও তাদের বিশ্বাস, ডাকসু কার্যকরের মাধ্যমে কেটে যাবে ২৬ বছরের অচলায়তন। সাধারণ শিক্ষার্থীরা ফিরে পাবে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার।
ছয় বছর আগে করা এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের রায়ের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রিয়াশীল ছাত্রসংগঠনগুলোর নেতারা চ্যানেল আই অনলাইনের কাছে তাদের প্রত্যাশার কথা জানিয়েছেন।
তবে পদাধিকার বলে ডাকসুর সভাপতি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামান নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে স্পষ্ট করে কিছু বলেননি। হাইকোর্টের রায় হাতে পাওয়ার পর তা বিচার বিশ্লেষণ করে তারপর এ ব্যাপারে বিস্তারিত বলবেন বলে জানিয়েছেন তিনি।
দীর্ঘদিন যাবত ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে শিক্ষার্থীদের একটি অংশ সক্রিয় থেকে কখনও মৃদু, কখনও বা জোরালো আওয়াজ তুললেও তা খুব একটা আমলে নেয়নি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। কিন্তু গত মার্চে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০তম সমাবর্তনে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেন: ডাকসু নির্বাচন ইজ আ মাস্ট।
রাষ্ট্রপতি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্যের এমন বক্তব্যের পর থেকেই মূলত আরও জোরদার হতে থাকে ডাকসু নির্বাচনের দাবি। গত ডিসেম্বরে এই দাবিতে আমরণ অনশনে বসেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সান্ধ্যকালীন কোর্সের ওয়ালিদ আশরাফ নামে এক শিক্ষার্থী। সর্বশেষ হাইকোর্টের রায়ের পর নির্বাচন অনুষ্ঠানে অনেকটা আইনি বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়েছে। এ কারণে ছাত্রনেতারা বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন যে ডাকসু নির্বাচন এবার সত্যিই হবে।
দুই যুগ ধরে ডাকসু নির্বাচন না হওয়ায় প্রশাসনকে বাধ্য করতে ২০১২ সালে একটি রিট আবেদন করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৫ জন শিক্ষার্থী। আদালত তখন রুল দিয়ে জানতে চেয়েছিলেন, ডাকসু নির্বাচন করার ব্যর্থতা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না। সেই রুলের নিষ্পত্তি করেই বুধবার হাইকোর্ট তার রায়ে আগামী ছয় মাসের মধ্যে ডাকসু নির্বাচনের ব্যবস্থা নিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন। পাশাপাশি নির্বাচনের সময় যদি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তার দরকার হয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সে বিষয়ে ‘যথাযথ সহযোগিতা’ দিতে বলেছেন আদালত।
হাইকোর্টের রায়কে স্বাগত জানিয়ে ডাকসু নির্বাচনে অংশগ্রহণের কথা জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি আবিদ আল হাসান, ছাত্রদল সভাপতি আল মেহেদী তালুকদার, ছাত্র ইউনিয়ন সভাপতি তুহিন কান্তি দাস এবং ডাকসুর দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের প্রধান সমন্বয়ক মাসুদ আল মাহদী।
আবিদ আল হাসান চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: আদালতের রায়কে আমরা স্বাগত জানাই। আমরা শুরু থেকেই বলে আসছি ডাকসুর ব্যাপারে ছাত্রলীগ সবসময়ই ইতিবাচক। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে আমরা তাতে অংশগ্রহণ করবো এবং এ নির্বাচনকে সুষ্ঠু করার স্বার্থে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে আমরা সম্ভব সব ধরনের সহায়তা করবো।
তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে ‘সরকারের আজ্ঞাবহ’ দাবি করে জাতীয় নির্বাচনের আগে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সত্যিই নির্বাচন দেবে কিনা সে ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সভাপতি আল মেহেদী তালুকদার। তিনি বলেছেন, নির্বাচন হলে তারা তাতে অবশ্যই অংশ নেবেন।
‘‘ছাত্রদল সব সময়ই ডাকসু নির্বাচন দাবি করে আসছে। এখন যদি ডাকসু নির্বাচন হয় তবে আমরা তাতে অবশ্যই অংশগ্রহণ করবো। কিন্তু জাতীয় নির্বাচনের আগে সরকারের আজ্ঞাবহ প্রশাসন নির্বাচন সত্যিই দেবে কিনা সে ব্যাপারে আমরা সন্দিহান।’’
তার দাবি, নির্বাচনের আগে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে সব ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে বসতে হবে এবং ক্যাম্পাসে সহাবস্থান নিশ্চিত করতে হবে।
হাইকোর্টের রায়কে স্বাগত জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়ন সভাপতি তুহিন কান্তি দাস বলেছেন, নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় তারা অবশ্যই অংশগ্রহণ করবেন।
তিনি বলেন: শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক চিন্তা চেতনা এবং স্বাধীন মতামত প্রকাশের জন্য ডাকসু নির্বাচন ইজ আ মাস্ট। নির্বাচনে কারা নির্বাচিত হবে সে চিন্তা থেকে নয়, শিক্ষার্থীরা যাদের নির্বাচিত করবে তাদেরকে সর্বোচ্চ সাংগঠনিক সহায়তা দেওয়া হবে আমাদের পক্ষ থেকে।
‘তবে শুধু হাইকোর্টের রায়ের ওপর ভরসা করে বসে থাকলে হবে না। শিক্ষার্থীদের অধিকারের ডাকসু নির্বাচন তাদেরকেই আদায় করে নিতে হবে।’
বেশ কিছু দিন যাবত ডাকসুর দাবিতে গড়ে উঠেছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নতুন প্লাটফর্ম ‘ডাকসুর দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীবৃন্দ’। ভিসি প্যানেল নির্বাচনের সময় অবস্থান কর্মসূচি, সাইকেল শোভাযাত্রা, সংবাদ সম্মেলন এবং স্বাক্ষর সংগ্রহসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছে এ প্লাটফর্মটি।
এর প্রধান সমন্বয়ক গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী মাসুদ আল মাহদী মনে করছেন, হাইকোর্টের রায়ের ফলে ডাকসু নির্বাচনের জন্য আইনি ভিত্তি আরও জোরদার হলো। এর ফলে ডাকসু নির্বাচনের জন্য শিক্ষার্থীদের যে যৌক্তিক দাবি তা প্রমাণিত হলো।
তিনি বলেন: আইনি বাধ্যবাধকতা তৈরি হওয়ার আমার মনে হয়, এবার বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নির্বাচন না দিয়ে পারবে না। ৈতাই এ নির্বাচনের ব্যাপারে আমরা আশাবাদী। তারপরও যদি প্রশাসন গড়িমসি করে তবে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়ে আমরা ধারাবাহিক কর্মসূচি দেবো।
৯০’র পর বারবার বাতিল হয়েছে ডাকসু নির্বাচন
১৯৯০ সালের ৬ জুন সর্বশেষ ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এরপর বিভিন্ন ছাত্র সংঠনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন সময় এ নির্বাচনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও নানা কারণে নির্বাচন আর হয়নি।
গত ২৬ বছরে আওয়ামী লীগ চলতি মেয়াদসহ তিনবার এবং বিএনপি দুইবার ক্ষমতায় ছিল। কিন্তু, যখনই তারা ক্ষমতার বাইরে ছিল তখন তাদের সহযোগী সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগ এবং ছাত্রদল ডাকসু নির্বাচেনর বিরোধিতা করেছে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ১৯৯১ সালের ১২ জুন তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মনিরুজ্জামান মিঞা ডাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছিলেন। ওই সময় কিছু ছাত্রনেতা তাদের ছাত্রত্ব বজায় রাখার জন্য বিশেষ ভর্তির দাবি জানান। এ নিয়ে উদ্ভূত সহিংসতায় ডাকসু নির্বাচন ভণ্ডুল হয়ে যায়।
এরপর ১৯৯৪ সালে তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দিন আহমদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন। কিন্তু ডাকসু নির্বাচনের পরিবেশ না থাকার অভিযোগ আনে ছাত্রলীগ। ফলে ডাকসু নির্বাচন স্থগিত হয়ে যায়। ১৯৯৫ সালে আবার নির্বাচনের তফসিল ঘোষিত হলেও নির্বাচন হয়নি।
পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালের অক্টোবরে অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরী ভিসির দায়িত্ব নেয়ার পর অন্তত ছয়বার ডাকসু নির্বাচনের নির্দিষ্ট সময়সীমা গণমাধ্যমকে জানানো হয়েছিল। কিন্তু ‘বিভিন্ন বাধার’ কারণে তিনি আর ডাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করতে পারেননি।
১৯৯৭ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান হলে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ছাত্রদল নেতা আরিফ হোসেন তাজ খুন হলে এ ঘটনা তদন্তের জন্য গঠিত কমিটি তাদের সুপারিশে ডাকসু ভেঙে দিয়ে ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলে। ১৯৯৭ এর ২৭ মে সিন্ডিকেটের সভায় ১৯৯০ সালে নির্বাচিত ডাকসু ভেঙে দেয়া হলেও নির্বাচন আর হয়নি।
ডাকসুর জন্য গঠিত সংশোধিত গঠনতন্ত্রে ডাকসু ভাঙার চার মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলা হয়েছে। সে অনুযায়ী ১৯৯৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বরের আগেই ডাকসু নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল।
আনুষ্ঠানিকভাবে ডাকসু ভেঙে যাওয়ার সাত বছর পর ২০০৫ সালের মে মাসে ভিসি হিসেবে দায়িত্ব নেয়া অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ ওই বছর ডিসেম্বরে ডাকসু নির্বাচন দেয়ার কথা বলেন। কিন্তু তৎকালীন বিরোধীদলীয় ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের বিরোধিতার কারণে সে নির্বাচনও হয়নি।
গত ২৬ বছর ধরে অকার্যকর ডাকসুর দাবিতে কখনও মৃদু, কখনও জোরালো আওয়াজ উঠলেও নির্বাচন আয়োজন করতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।