চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

ট্রাম্পের বিজয়ে বাংলাদেশের কী সমস্যা?

সম্ভবত বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের মন খারাপ। কারণ ডোনাল্ড ট্রাম্পই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। বাংলাদেশের মানুষ চেয়ে ছিলেন হিলারির জয়; আরও স্পষ্ট করে বললে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরাজয়। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের জরিপেও দেখা গেছে, বাংলাদেশে এই ভোট হলে হিলারি ক্লিনটন ৭০ শতাংশেরও বেশি ভোট পেতেন। যদিও এসব জরিপ শেষমেষ কী দাঁড়ায়, তার সবশেষ উদাহরণ মার্কিন নির্বাচনই।

কথা হচ্ছে, প্রায় সাড়ে তেরো হাজার কিলোমিটার দূরে,আরেকটি মহাদেশের ওই রাষ্ট্রে কে প্রেসিডেন্ট হলেন বা না হলেন তাতে বাংলাদেশের বা বাংলাদেশের মানুষের কী আসে যায়? কেন তাদের মন খারাপ অথবা কেন এই ট্রাম্পবিদ্বেষ?

বাংলাদেশ তো বটেই, সম্ভবত পৃথিবীর সব দেশেই নিজস্ব ভোটের চেয়ে বিরুদ্ধ ভোটের ক্ষমতা বেশি। যে কারণে গাধাকে ঠেকানোর জন্য মানুষ হাতিকে ভোট দেয়। এখানে হাতির নিজস্ব কিছু ভোট থাকলেও অনুসন্ধান চালালে দেখা যাবে, মোট ভোটের একটা বড় অংশই গাধাবিরোধী, অর্থাৎ যারা চেয়েছে গাধার পতন হোক। ফলে তারা হাতিকে ভোট দিয়েছে। এই বাস্তবতা বাংলাদেশেও অভিন্ন।

ক্ষমতাসীনরা যত ভালো কাজই করুক, কিছু গণবিরোধী কাজও তারা করে। ফলে ভেতরে ভেতরে একটা জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে যারা সুইং বা দোদুল্যমান, তারা ভোটের সময় এর প্রতিশোধ নেয়। অর্থাৎ তারা যেহেতু গাধা হাতি কোনো দলেরই নয়, তাই তারা ক্ষমতাসীন গাধাকে সরানোর জন্য অপেক্ষাকৃত মন্দের ভালো মনে করে হাতিকে ভোট দেয়।trump11

কথা হলো, হিলারির চেয়ে ট্রাম্প কি বেশি যোগ্য? সেটি অন্য তর্ক। আমরা বরং দেখি যুক্তরাষ্ট্রে হাতির দলের নেতা ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয়ে বাংলাদেশের মানুষের কিংবা অভিবাসী বাংলাদেশির কেন মন খারাপ হলো?

ট্রাম্প যেসব নীতিতে বিশ্বাস করেন, তার মধ্য থেকে বাছাই করে ১০টির কথা উল্লেখ করেছে বিবিসি। যেমন ট্রাম্প বারবার বলে এসেছেন, ৯/১১ হামলায় আরব বংশোদ্ভূত মার্কিন ও মুসলমানরা খুশি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিমরা আনন্দ করেছে। তাই যুক্তরাষ্ট্রের সব মসজিদের ওপর নজরদারি এমনকি সন্ত্রাসবিরোধী পদক্ষেপের অংশ হিসেবে প্রত্যেক মুসলিম মার্কিনের গতিবিধির ওপর নজরদারি করা উচিত বলেও তিনি মনে করেন।

ক্যালিফোর্নিয়ার স্যান বার্নার্দিনোতে মুসলিম দম্পতির রক্তক্ষয়ী বন্দুক হামলার পর ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিমদের প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করার পক্ষে মত দেন। ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত ১ কোটি ১০ লাখ অবৈধ অভিবাসীকে বের করে দিতে চান। জলবায়ু পরিবর্তনকে ট্রাম্প স্রেফ ‘আবহাওয়ার’ বিষয় বলে মনে করেন। তিনি মনে করেন, এর দোহাই দিয়ে নিজের দেশের কোম্পানিগুলোকে উৎপাদনবিমুখ করা ঠিক হবে না।

ধরে নেয়াই সঙ্গত যে, ট্রাম্প তার নির্বাচনী প্রচারে এসব কথা না বুঝে বলেননি। কিছু কথা শ্বেতাঙ্গ এবং কট্টরপন্থি আমেরিকানদের খুশি করতে তথা তাদের ভোট পাওয়ার জন্য বলেছেন, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু সামগ্রিকভাবে তার এই নীতির যদি ৫০ শতাংশও তিনি বাস্তবায়ন করেন, তাহলে এতে সন্দেহের কারণ নেই যে, যুক্তরাষ্ট্রে নাইন ইলেভেনের পরে মুসলমানরা যেরকম বিপদের মুখে পড়েছিলেন, সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে পারে নানা জায়গাতেই।US-VOTE-DEBATE

আর বাংলাদেশ থেকে যারা যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে অভিবাসী হয়েছেন অথবা হওয়ার অপেক্ষায় আছেন কিংবা হতে চান, তাদের জন্য অভিবাসনবিরোধী ট্রাম্পের বিজয় মোটেও সুখের সংবাদ নয়। ট্রাম্প বলেছেন, তিনি আমেরিকাকে ঐক্যবদ্ধ করবেন এবং আবার গ্রেট আমেরিকা বানাবেন। তার কথার টোনে উগ্র জাতীয়তাবাদ স্পষ্ট। আর যেকোনো উগ্র জাতীয়তাবাদী শাসকের আমলে তার দেশে অন্য জাতির লোকদের সুখ হয় না। আমেরিকা একটি বহুজাতির দেশ। বহু দেশ থেকে যাওয়া অভিবাসীর আশ্রয়স্থল। কিন্তু ট্রাম্পের এই উগ্র জাতীয়াবাদের শিকার হতে হলে সেখানে অন্য দেশের পাশাপাশি একটি বড় মুসলিমপ্রধান দেশ হিসেবে বাংলাদেশের মানুষকেও বিড়ম্বনায় পড়তে হতে পারে।

জলবায়ু পরিবর্তনকে ট্রাম্প স্রেফ আবহাওয়ার বিষয় মনে করলেও এটি যে এখন বিজ্ঞান এবং সর্বজন স্বীকৃত পুরো মানব জাতির জন্য একটা ভয়াবহ ‍দুযোগ-সেটি এখন সবাই একবাক্যে স্বীকার করেন। এই ইস্যুতে এরইমধ্যে হয়ে যাওয়া বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বাংলাদেশের মতো উপকূলীয় স্বল্পোন্নত ও গরিব দেশগুলোকে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিপাক মোকাবেলায় জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য প্রধানত দায়ী শিল্পোন্নত দেশগুলোর ক্ষতিপূরণের বিষয়েও সবাই একমত হয়েছেন। trump7

কিন্তু ট্রাম্প যদি এই জলবায়ু তহবিলে অর্থ দেয়া বন্ধ করে দেন, তাহলে বাংলাদেশের মতো বহু ঝুঁকিপূর্ণ দেশ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত মোকাবেলায় নেয়া কর্মসূচি বাস্তবায়নে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। কারণ এই তহবিলে সবচেয়ে বড় অংকের অর্থ আসার কথা যুক্তরষ্ট্রের কাছ থেকেই।

আবার যুক্তরাষ্ট্র এই খাতে অর্থ বন্ধ করে দিলে শিল্পোন্নত বাকি দেশগুলোও আর অর্থ দিতে উৎসাহ পাবে না। ফলে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার পুরো কর্মসূচি কার‌্যত স্থবির হয়ে পড়বে। ফলে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয়ে বাংলাদেশিদের মন খারাপের এটিও একটি বড় কারণ।

ট্রাম্প যদি তার ঘোষণা অনুযায়ী বেশ কয়েকটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি বাতিল করেন তাহলে মেক্সিকো থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য প্রবেশে নানা জটিলতা তৈরি হবে। আর যদি তিনি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করেন এবং চীন থেকে আসা পণ্যের ওপর ৪৫ ভাগ এবং মেক্সিকো থেকে আসা পণ্যের ওপর ৩৫ ভাগ শুল্ক বসান-তার প্রভাব অন্য দেশগুলোর বাজারেও পড়বে।

এরই ধারাবাহিকতায় যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলদেশি পণ্যের প্রবেশ সীমিত করা বা সেখানে কঠিন শর্ত আরোপেরও আশঙ্কা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে জিএসপি সুবিধা আপাতত বন্ধ। এটির দরজা আর খুলবে বলে মনে হয় না। ফলে বাণিজ্যিক স্বার্থের দিক থেকেও ট্রাম্পের বিজয় বাংলাদেশের জন্য সুখকর নয়।

পরমাণু বোমা এবং এই বোমার ভয়াবহতা নিয়েও ট্রাম্পের ধারণা যে স্পষ্ট নয়, তা তার কথাবার্তায় টের পাওয়া গেছে। ফলে বৈশ্বিক নিরাপত্তার জন্যও ট্রাম্প বড় ধরনের হুমকি তৈরি করতে পারেন যদি তিনি পরমাণু বোমা আছে বলেই মেজাজ খারাপ করে উত্তর কোরিয়া অথবা ইরানেরর ওপর এটি বর্ষণ করেন। হয়তো তিনি সেটি করতে পারবেন না, কারণ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট যিনিই হোন না কেন, তিনি চাইলেই সবকিছু একা করতে পারবেন না।

বলা হয়, আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট যিনিই থাকুন, তাতে তাদের বিদেশনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে না। যে কারণে বুশের সময়ে শুরু হওয়া ইরাক যুদ্ধের লিগ্যাসি টানতে হয়েছে শান্তিতে নোবেল পাওয়া বারাক ওবামাকে এবং তার আমলেই হত্যা করা হয়েছে ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন এবং লিবিয়িার প্রেসিডেন্ট মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে।trump-3

ফলে ডোনাল্ড ট্রাম্প তার নির্বাচনী জনসভা ও বক্তৃতায় যেসব কথা বলেছেন, তার সবই যে তিনি বাস্তবায়ন করে ফেলবেন বা করতে পারবেন- তা হয়তো নয়। বিশেষ করে বিদেশনীতির ক্ষেত্রে। কিন্তু তারপরও তিনি আমেরিকানদের ভোট পাওয়ার জন্য তাদের মনে যে মাইগ্রেশন ও ইসলামোফোবিয়া ঢুকিয়ে দিতে পেরেছেন-এর প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারি।

কারণ তিনি একটি বড় জনগোষ্ঠীর মনজগতে একটা বড় ধাক্কা দিয়েছেন। সেই ধাক্কাটি এতই বড় যে, বিশ্বব্যাপী সমালোচনার মধ্যেও তার মতো একজন লোককে পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বানিয়ে ফেলেছে মার্কিনিরা। এখন এই মনজাগতিক পরিবর্তন আসলেই যুক্তরাষ্ট্রকে কী ধরনের পরিবর্তনের পথে নিয়ে যায় এবং সেই পরিবর্তন বাংলাদেশসহ অন্য দেশের লোকেদের ওপর কী প্রভাব ফেলে, তা হয়তো মি. ট্রাম্পের ক্ষমতা গ্রহণের মাস কয়েকের মধ্যেই আঁচ পাওয়া যাবে।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)