পানির রং কী? এ প্রশ্নটি বিতর্কের বিষয়বস্তু হয়ে উঠতে পারে যেকোন চায়ের টেবিলের আড্ডায়। এক্ষেত্রে একটু সচেতন কারও উত্তর হবে পানির কোন রং নেই। তবে কয়েকবছর আগেও বুড়িগঙ্গার পাড় থেকে যাদের ঘুরে আসার অভিজ্ঞতা আছে তারা বলবেন: রাজধানীর সদরঘাটে বুড়িগঙ্গার পানি কুচকুচে কালো আর হাজারীবাগ এলাকার পানি রক্তের মতো লাল!
পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী মৎস্য ও জলজ প্রাণীর জীবনধারণের জন্য পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ প্রতি লিটারে ৫ মিলিগ্রাম বা এর ওপরে থাকা প্রয়োজন, সেখানে গত বছর এই সময়ে পরিবেশ অধিদফতরের পরীক্ষায় বুড়িগঙ্গার প্রতি লিটার পানিতে দূষণের মাত্রা ছিল শূন্য দশমিক ৩৮ মিলিগ্রাম। যার পরিমাণ স্থান ভেদে ছিলো আরও খারাপ।
সদরঘাটে পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের (ডিও) পরিমাণ শূন্য দশমিক ৪০, আর ধোলাইখালের মুখে ডিওর পরিমাণ ছিল শূন্য দশমিক ৩৮ মিলিগ্রাম। তাই বুড়িগঙ্গার পানিতে মাছ কিংবা অন্য কোন জীবের অস্তিত্ব ছিলো না বলতে গেলেই চলে। এর ফলে এক সময় বিশ্বব্যাংক বুড়িগঙ্গাকে মৃত নদীর তালিকাভুক্ত করে।
বছর ঘুরে অবশ্য সেই চিত্র এখন কিছুটা হলেও বদলেছে, আবারও জেগে উঠেছে বুড়িগঙ্গা। এর পেছনে মূল কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে: হাজারীবাগে থাকা ২৫০ টির মতো ট্যানারি কারখানা সাভারে স্থানান্তর। তারপরও দূষণ রয়ে গেছে ঠিকই, কিন্তু দূষণের মাত্রা কমার পাশাপাশি এবারের বর্ষা মৌসুম আশীর্বাদ হয়ে এসেছে বুড়িগঙ্গার জন্য।
বসিলা ব্রিজের নিচে ছোট কাঠের নৌকায় মাছ ধরছিলেন কাশেম মিয়া। বুড়িগঙঙ্গার চিত্র পরিবর্তন প্রসঙ্গে তার সঙ্গে কথা বললে চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন, ১৯৮৫ সাল থেকে বুড়িগঙ্গায় মাছ ধরছি। প্রথম প্রথম অবস্থা ভালো থাকলেও আস্তে আস্তে দূষণের মাত্র বেড়ে মাছের পরিমাণও কমতে থাকে। সারা দিনে দুইশ’, আড়াইশ’ টাকার মাছ ধরতে পারিনি গত বছর। এবার তো বসে থাকলেও আটশ’ এক হাজার টাকা ইনকাম আছে।
পরিবর্তন বোঝাতে তিনি বলেন, ‘এখন তো পানি দেখতাছেন। অন্য সময় আসলে এই পানি পাইতেন লাল না হয় কালো। আর বর্ষার পর তো নদীতে পানি থাকতো না সব আঠা হয়ে যেতো! এবারের মতো পরিস্কার পানি গত বিশ বছরে দেখিনি।’
১৮০০ সালে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যিক প্রতিনিধি টেইলর বুড়িগঙ্গা নদী দেখে মুগ্ধ হয়ে লিখেছিলেন, ‘বর্ষাকালে বুড়িগঙ্গা যখন পানিতে ভরপুর থাকে তখন দূর থেকে ঢাকাকে ভেনিসের মতো দেখায়।’ নগরায়ন এবং শিল্পায়ণের ধাক্কায় সেই দিন এখন দূর অতীত। বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে, ঢাকার আশেপাশের চার নদী বুড়িগঙ্গা, বালু, তুরাগ, শীতলক্ষ্যার মোট দূষণের ৪০ ভাগের জন্য দায়ি ট্যানারি শিল্পকারখানাগুলো।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জ শহরে ট্যানারি শিল্পের গোড়াপত্তন। এর কিছুকাল পর সেটা চলে আসে ঢাকার হাজারীবাগে। প্রাথমিক ভাবে ২১টি ট্যানিারি কারখানা থাকলেও সময়ের পরিক্রমায় তা দাড়ায় ২৫০-এ।
সরজমিনে বুড়িগঙ্গায় গিয়ে দেখা যায়, আবারও পানিতে ভরে উঠেছে বুড়িগঙ্গা। তাতে যেমন আছে শ্যাওলার, ঠিক তেমনই আছে নানা প্রজাতির মাছ। তাই পরিস্কার পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখা গেছে কিশোরদের। এছাড়া সেখানে দেখা মিলেছে ভ্রমণ পিপাসু সাধারণ মানুষের।
কথা হচ্ছিলো ঢাকার একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের শিক্ষার্থী নুয়াম তায়েফের সঙ্গে। সে তার বন্ধুর বাড়ি হাজারিবাগে ঘুরতে এসেছে। বন্ধু রাহুল তাকে বুড়িগঙ্গায় নৌকা ভ্রমণে যাওয়ার প্রস্তাব দিলে তার প্রথমেই মাথায় আসে বুড়িগঙ্গা দুর্গন্ধময় পরিবেশের। তবে বন্ধুর পীড়াপীড়িতে শেষ পর্যন্ত বসিলা ব্রিজের নিচে এসেছেন নৌকা ভ্রমণের জন্য। তবে বুড়িগঙ্গা বদলে গিয়ে এতোটা সুন্দর হতে পারে এটা ছিলো তার ধারণার বাইরে।
২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত বাংলাদেশ নৌবাহিনীর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বুড়িগঙ্গার নদী দূষণের জন্য দায়ী মূলত শিল্পবর্জ্য। নদীতে পড়া বর্জ্যের ৬০ শতাংশ শিল্প খাতের। আর ৪০ শতাংশ ট্যানারি শিল্পের।
প্রতিবেদনটিতে আরো বলা হয়, বুড়িগঙ্গা নদীতে প্রতিদিন ঢাকা শহরের চার হাজার ৫০০ টন আবর্জনা ফেলা হচ্ছে। ২২ হাজার লিটার বিষাক্ত ট্যানারি বর্জ্য এ নদীকে হজম করতে হয়েছে এত দিন। এ ছাড়া পলিথিন জমে নদীটির তলদেশে ১০-১২ ফুট ভরাট হয়ে গেছে।
২০০১ সালে হাইকোর্ট চামড়াশিল্পসহ দূষণ সৃষ্টিকারী কারখানাগুলো এক বছরের মধ্যে দূষণ নিয়ন্ত্রণের নির্দেশ দেন।২০০৩ সালের ১৬ আগস্ট জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় অনুমোদন দেয়া হয় সাভারের হেমায়েতপুরে চামড়া শিল্পনগর প্রকল্প। কথা ছিল ২০০৫ সালের মধ্যে কাজ শেষ হবে। এরপরই হাজারীবাগ ছেড়ে যাবে ট্যানারি কারখানাগুলো।
কিন্তু ট্যানারি মালিকদের টাল-বাহানায় যথা সময়ে সেটা সম্ভব হয়নি। শেষ পর্যন্ত কারখানা গুলোর বিদ্যুৎ-গ্যাস ও পানির লাইন বিচ্ছিন্ন করে দিতে বাধ্য হয় সরকার। এ বছর ৮ এপ্রিল হাজারীবাগ থেকে পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয় ট্যানারি কারখানা গুলো।যার স্থান এখন সাভারের হেমায়েতপুরে।
তবে রায়ের বাজার সুইচ গেট এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, এখানে দূষণ এখনও রয়েছে। ট্যানারি বন্ধের পরও কেন এমন দূষণ জানতে চাইলে সামিনা ট্যানারি (প্রাইভেট) লিমিটেডের জেনারেল ম্যানেজার এমডি মুক্তার হোসেন দাবি করেন, এখানে আপনারা যে দূষণ দেখছেন সেটা মূলত, সিটি কর্পোরেশনের পয়ঃনিষ্কাশন লাইনের বর্জ্য আর জিনজিরার টেক্সটাইল মিলগুলোর ডাইংয়ের বর্জ্য।
বুড়িগঙ্গার মোট দূষণের ৪০ শতাংশের জন্য দায়ি ছিলো ট্যানারি এবং নাগরিক বর্জ্য এবং টেক্সটাইল ডাইং বর্জ্যের দায় ছিলো ৬০ শতাংশ।
তবে ট্যানারিগুলোর সরে যাওয়ার কথা থাকলেও সরজমিনে গিয়ে দেখা যায় সামিনা ট্যানারিসহ কিছু কিছু ট্যানারির কার্যক্রম এখনও চলছে। এসম্পর্কে জানতে চাইলে মুক্তার হোসেন বলেন, আমরা সরকারি সুবিধায় সাভারে সকল কার্যক্রম স্থানান্তর করেছি। এখন যেটা দেখছেন তা হলো, ফিনিশিং এবং গুডস্ লেভেলের কাজ। কাঁচা চামড়ার কাজ হচ্ছে না। পরিবেশ দূষণের মূল কারণ তো হচ্ছে কাঁচা চামড়া বয়লারিং। সেটা তো এখানে হচ্ছে না!
এমন দাবি করলেও মুক্তার হোসেন স্বীকার করেন, ৮ এপ্রিল গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানির লাইন বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার পর কিছু অসাধু ব্যাবসায়ী আবার আবেদন করে লাইন নিয়ে মূল গেট বন্ধ রেখে উৎপাদন চালু রেখেছে। যদিও সেটা সীমিত পর্যায়ে বলে দাবি করেন তিনি।