পরিপূর্ণ একজন ক্রিকেটারের সক্ষমতা ও কার্যকারিতা প্রমাণ হয় টেস্টে। দীর্ঘ পরিসরের ফরম্যাটে প্রতিষ্ঠা পেতে সুনির্দিষ্ট স্বপ্ন যেমন থাকা চাই; সঙ্গে চাই অসীম ধৈর্য্য, কঠিন পরিশ্রম ও দৃঢ় সংকল্প। এসবের যথাযথ সম্মিলন ঘটাতে পারলেই একজন আদর্শ টেস্ট ক্রিকেটার হওয়া সম্ভব, মাশরাফী ভাবেন এভাবেই।
বড় দৈর্ঘ্যের ক্রিকেট নিয়ে বাংলাদেশের উঠতি ক্রিকেটারদের প্রতি তাই মাশরাফীর পরামর্শ, টেস্ট ক্রিকেটার হতে হলে আগে স্বপ্নটা দেখতে হবে। লম্বা রেসের ঘোড়া হতে চাইলে স্বপ্নটা চাই-ই চাই।
মাশরাফী বিন মোর্ত্তজার নিজের স্বপ্ন ছিল একজন আদর্শ টেস্ট ক্রিকেটার হবেন। স্বপ্ন পূরণের উজ্জ্বল সম্ভাবনাও ছিল। কিন্তু বারবার হাঁটুর চোট আর সাতবার অস্ত্রোপচারের ধকল সেই স্বপ্ন পূরণ হতে দেয়নি। ২০০১ সালে টেস্ট শুরু করে এই ডানহাতি পেসারের সাদা পোশাকের ক্যারিয়ার থমকে আছে মাত্র ৩৬ টেস্টে। ২০০৯ সালের পর আর কখনও ক্রিকেটের এই অভিজাত ফরম্যাটে নামা না হলেও খেলাটার প্রতি একটুও মমতা কমেনি ম্যাশের। ভালোবাসা বরং বহুগুণ বেড়েছেই।
টেস্টে নির্বাসিত থাকতে হলেও একদিনের ক্রিকেটে দাপটের সঙ্গেই খেলে যাচ্ছেন মাশরাফী। ওয়ানডের নেতৃত্বও তার কাঁধে। কিন্তু টেস্টের ঝুঁকি নিতে পারছেন না। আরেকবার চোট পেলেই যে একেবারে থেমে যাবে ক্রিকেট ক্যারিয়ারটাই!
ঘরের মাঠে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ২০০১ সালের নভেম্বরে টেস্ট অভিষেক হয় মাশরাফীর। দুই ম্যাচের সিরিজে নেন ৮ উইকেট। নড়াইল, চিত্রা নদী আর বন্ধুদের আড্ডায় ডুবে থাকার সেই সময়ের কিশোর মাশরাফী জানতেন না স্বপ্ন কী। আবার স্বপ্নের খোঁজটা পেয়ে যান দ্রুতই। ডিসেম্বরেই যখন নিউজিল্যান্ড সফরের দলে থেকে গেলেন। বাংলাদেশের হয়ে খেলতে প্রথম বিদেশ যাত্রার বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে ওঠার আগেই ম্যাশের মানসপটে ধরা দেয় নতুন এক স্বপ্নের পৃথিবী।
‘অভিষেক সিরিজের প্রথম দুই টেস্টে আট উইকেট পাই। তখনও অতকিছু বুঝিনি। নিউজিল্যান্ডে গিয়ে প্রথম টেস্টে পাই তিন উইকেট। তারপর থেকে আমার ধারণা বদলাতে শুরু করে। আদর্শ টেস্ট ক্রিকেটার হতে চাওয়ার স্বপ্নটা আসে তখনই।’
আদর্শ টেস্ট ক্রিকেটার হওয়ার সেই স্বপ্নটার পেছনেও আছে একটা গল্পও। যে গল্পের নায়ক নিউজিল্যান্ডের সাবেক পেস-অলরাউন্ডার রিচার্ড হ্যাডলি। মাশরাফী নিউজিল্যান্ডে গিয়ে দেখলেন হ্যাডলিকে লোকে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করে। কিশোর মাশরাফীর মনে তখন প্রশ্ন— ক্রিকেটারকে কেন স্যার বলা হয়! তখনও তার জানা ছিল না, হ্যাডলিই হলেন টেস্টে ৪০০ উইকেট নেয়া প্রথম বোলার, ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা অলরাউন্ডারদের একজন। জেনে তো চক্ষু চড়কগাছ!
‘যখন জানলাম এতো কম ম্যাচে ৪৩১ উইকেট (৮৬ টেস্টে), তখনই আমি স্বপ্নটা দেখতে শুরু করি যে, আমিও তার মতো বড় টেস্ট ক্রিকেটার হব। তাকে দেখেই সত্যিকার অর্থে আমার স্বপ্ন দেখা শুরু হয়।’
স্বপ্নের খোঁজটা পাওয়ার সময় অনেককিছুই মাশরাফীর নাগালে ছিল না। ইন্টারনেট, স্যাটেলাইট, টেলিভিশনও- হাতের নাগালে পাননি অনেককিছুই। টেস্ট ক্রিকেট কী, টেস্ট ক্রিকেটাররা কী হতে পারেন, সেই স্বপ্নটা দেখতে তাই একটু দেরিই হয়ে যায় ম্যাশের।
‘আমি যখন ক্রিকেট শুরু করি, তখন ক্রিকেট এরকম ছিল না। স্কুলে পড়ার সময়টাতে, ১৯৯৭ সালে, আকরাম ভাইরা আইসিসি ট্রফি জিতল। তখন তো বিশ্বকাপ ছাড়া কিছুই দেখার সুযোগ ছিল না। পাকিস্তান-ইন্ডিয়ার ম্যাচই বা কয়টা হত। বেড়ে ওঠার ওই সময়ে সব খেলাই খেলেছি; ক্রিকেট, ফুটবল, টেনিস— সবই। ওই সময়টা থেকে ক্রিকেটটা মোটামুটি খেলি; তবে অতটা সিরিয়াস না। ভাল লাগতো তাই খেলতাম।’
জাতীয় দলে ঢোকার পরও নাকি ক্রিকেটের গুরুত্বটা ঠিক বুঝতে পারতেন না মাশরাফী! কে জানে, রিচার্ড হ্যাডলিকে না দেখলে হয়ত ক্রিকেট আভিজাত্যের খোঁজই পেতেন না তিনি।
‘বাংলাদেশ টিমে সুযোগ পাওয়ার পরও আমার কাছে ক্রিকেটার হওয়ার তেমন গুরুত্ব ছিল না। আমার নড়াইলে থাকতে ইচ্ছে করতো। তারপরও খেলে গেছি, কেবল বাসা থেকে জোরাজুরির কারণে। বাংলাদেশ টিমে খেলছি এটা অনুভবই করতে পারিনি তখনও। ভাল লাগতো তাই শুধু খেলে যেতাম।’
নিজের স্বপ্নের খোঁজ পেতে, ক্রিকেট নিয়ে সিরিয়াস হতে দেরি হলেও মাশরাফীর এখন চান এসময়ের ক্রিকেটাররা দ্রুত পেয়ে যাক তাদের স্বপ্নের ছোঁয়া। অবদান রাখুক বাংলাদেশ দলে।
‘এখন কিন্তু লংগার ভার্সনে দুইটা লিগ হচ্ছে, এনসিএল ও বিসিএল। প্লেয়ারদের দায়িত্ব মন দিয়ে খেলা। মাঠে এসে উন্নতি করতে না চাইলে কাজটা কঠিন হয়ে যাবে। এজন্যই সব সময় বলি, লংগার ভার্সন ক্রিকেটের প্রতি মমত্ববোধ থাকতে হবে। এটা ছাড়া সম্ভব না। আসলেন, খেললেন, চলে গেলেন— তাহলে হবে না। এভাবে টেস্ট প্লেয়ার হওয়া যায় না। এখনকার খেলোয়াড়রা বছরে ১২-১৪টা প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলার সুযোগ পায়। কেউ যদি মৌসুমে ২০০০ রান করতে পারে, তখন মানসিকতা বদলাতে শুরু করবে। মমত্ববোধ থাকতে হবে, ধৈর্য্য থাকতে হবে, ধৈর্য্য নিয়ে মাঠে আসতে হবে। ধারাবাহিকভাবে ভাল খেলে যেতে হবে। তখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে গিয়ে কিছু ফিডব্যাক পাবে।’
টেস্ট ক্রিকেটে উন্নতি শুরু করছে বাংলাদেশ। আরও একধাপ উপরে উঠতে হলে কী করতে হবে মাশরাফী সেটিও বলে দিলেন, ‘এখান থেকে এক ধাপ এগিয়ে যেতে হলে নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা বাড়াতে হবে। প্লেয়ারদেরই দায়িত্ব প্রতিযোগিতা বাড়ানোর। টেস্ট ক্রিকেটার হতে এই চাওয়া-পাওয়াটা থাকতে হবে যে, বাংলাদেশকে লিড করতে চাই এবং টেস্টে ৪৫-৫০ গড়ে রান করতে চাই। স্বপ্নটা থাকলে আরও প্লেয়ার উঠে আসবে। ব্যাকআপ প্লেয়ার তৈরি হবে। প্রতিযোগিতা বাড়বে। উন্নতিটা হতে থাকবে।’