একটু একটু করে স্বপ্ন বুনে ঢাকাবাসীকে বিশাল এক স্বপ্নসমুদ্র উপহার দিয়েছিলেন মেয়র আনিসুল হক। সবাই নতুন করে স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিলো সাজানো গোছানো এক ঢাকার। বদলাতে শুরু করেছিলো অনেক চিত্রই, নড়েচড়ে বসেছিলো বিপথে চলা মানুষগুলোও। ঢাকাকে ভিন্নভাবে নাড়ানো সেই মেয়র টুকরো টুকরো স্বপ্ন বুনেই হয়ে উঠেছিলেন বিশাল।
তার ফেসবুক পেজের গত এক বছরের পোস্টগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সেখানে যেমন বুনে যাওয়া কিছু স্বপ্নের গল্প আছে, আছে নানান উদ্যোগের পথরেথা, ভালোবাসা আর প্রাণপ্রাচুর্যের এক মেলবন্ধন।
স্বপ্ন
আনিসুল হকের সঙ্গে নতুন স্বপ্ন নিয়ে শুরু হয়েছিলো ২০১৭ সাল। ১ জানুয়ারি ফেসবুকে এক পোস্টে তিনি তুলে ধরেছিলেন সেই স্বপ্নকথা। লিখেছিলেন, সবাইকে ইংরেজি নতুন বছরের শুভেচ্ছা। ২০১৭ সালে উত্তর সিটি করপোরেশনের ৮০ ভাগ রাস্তাঘাটের উন্নয়ন, ৫০ ভাগ রাস্তায় এলইডি লাইট স্থাপন, ৫০ ভাগ এলাকা সিসি ক্যামেরার আওতায় আনা এবং শতভাগ অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করার পরিকল্পনা আছে আমার। চলুন, বাসযোগ্য ঢাকা গড়ে তুলতে আমরা আজ থেকেই উদ্যোগী হই।
আনিসুল হক স্বপ্ন দেখেছিলেন এক সাজানো গোছানো পরিচ্ছন্ন নগরীর। তার সেসব স্বপ্নের কথাও উঠে এসেছে তার দেওয়া স্ট্যাটাসগুলোতে।
চীন সফরে গিয়ে তিনি জানিয়েছিলেন, ঢাকায় দুই হাজার দুইশত থেকে দুই হাজার পাঁচশত টনের মতো বর্জ্য উৎপন্ন হয় যা থেকে প্রায় ২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ তৈরি করা সম্ভব। চীন সফরে এসে এখানকার বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ তৈরির প্ল্যান্টগুলো পরিদর্শন করছি এবং ধারণা নিচ্ছি। আগামী দেড় থেকে দুই বছরের মধ্যে ঢাকার জন্য এরকম বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ শুরু করতে চাই। আমরা সফল হলে পাঁচ বছর পর আপনারা এই প্রকল্পের সুফল পাবেন।
ঢাকার রাস্তার যানজট আর যানবাহন নিয়েও ভাবনা ছিলো মেয়র আনিসুল হকের। সেকথা বলেছিলেন নির্বাচনের সময়ই। পরবর্তীতেও ভোলেননি সেটা। নিজেই আবার মনে করিয়ে দিয়েছিলেন নিজের প্রতিশ্রুতির কথা। লিখেছিলেন, মেয়র নির্বাচনের সময় রাজধানীর পরিবহন খাতের শৃংখলা ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি। এ লক্ষ্যে গত দুই বছরে পরিবহন সেক্টরের মালিক, শ্রমিক সংগঠন এবং সংশ্লিষ্ট সরকারি দফতর ও অধিদফতরের সঙ্গে অনেকগুলো সভা করেছি। প্রকল্পটি এখন একটি ভালো পর্যায়ে এসেছে। চলতি মাসে সংবাদ সম্মেলন করে নগরবাসীকে আরও কিছু ভাল খবর জানাতে পারব আশা করছি।
স্বপ্ন ছিলো জরাজীর্ণ ঢাকাকে বদলে দেওয়ার। সবুজ ও পরিচ্ছন্ন একটি নগরীর স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন তিনিই। ফেসবুকে লিখেছিলেন, ঢাকাকে বদলে দেওয়ার দায়িত্ব আমরা নিয়েছি। কিন্তু ঢাকাকে ক্লিন রাখার আগে আমাদের ডিএনসিসি অফিসকে ক্লিন করতে হবে। নগরবাসীকে ভালো সার্ভিস দিতে নিজেদের কাজকে দ্রুত এবং স্বচ্ছ রাখতে হবে।
স্বপ্ন ছিলো দখল হয়ে পড়া ফুটপাতগুলো নিয়েও। জানিয়েছিলেন, আগামী এক বছরের মধ্যেই উত্তরের ফুটপাত এমনভাবে গড়া হবে যেন অন্ধজনও সহজে চলতে পারেন। মোটরসাইকেল ফুটপাতে উঠলেই তাকে ধরে পুলিশে দিন। অনেক প্রাইভেটকার ফুটপাতে চাকা তুলে দেয়। এমন দেখলেও পুলিশে দিন। এখন থেকে আর এসব চলতে দেয়া হবে না। এ জন্য সবাইকে সচেতন হতে হবে।
উদ্যোগ
শুধু স্বপ্নের ফুলঝুড়িই নয়, ছিলো তাৎক্ষণিক সব উদ্যোগও। একটু পেছনে ফেরা যাক, এ বছরের বর্ষাকালে ঢাকাবাসীর জন্য এক প্রবল নাকালের নাম ছিলো বৃষ্টি। বৃষ্টি মানেই জলাবদ্ধতা। ঢাকাবাসীর জন্য তখন একবার স্বস্তির শ্বাস নিয়ে এসেছিলো আনিসুল হকের একটি স্ট্যাটাস। সেখানে তিনি লিখেছিলেন, ‘কিছু ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অদূরদর্শিতা বা ভুল সিদ্ধান্ত নগরে জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ। নগরে আর কোথাও এমন প্রতিবন্ধকতা দেখলে আমাদেরকে জানান।’ এই স্ট্যাটাসে হয়তো সমস্যার সমাধান আসবে না। কিন্তু ঢাকাবাসী ভেবেছিলো, নিজেদের সমস্যার কথা জানানোর জন্য তারা অন্তত একজনকে পেয়েছেন।
নির্মাণকাজের জন্য দীর্ঘ সময় ঢাকার অলিগলির কোনো রাস্তা বন্ধ রাখার চিত্রও সকলের নজরে আসে প্রতিনিয়ত। সেটা নিয়েও ভাবনা ছিলো মেয়র আনিসুল হকের। ফেসবুকে তিনি লিখেছিলেন, আমি জানি আপনারা আমাকে সাহায্য করতে চান। আপনাদের সহযোগী মনোভাবই আমার আসল শক্তি। কিন্তু যদি আমাকে ঠিকভাবে সাহায্য না করেন তাহলে আপনাদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়, আপনাদের সাহায্য আমার কাজে আসে না। গতকাল আমি বলেছি, আপনাদের এলাকায় ফুটপাত, রাস্তাঘাট, ড্রেন ইত্যাদি নির্মাণকাজে কোনো ধরনের অবহেলা, অতিরিক্ত সময় নেয়া বা গুণগত মানের ঘাটতি আপনাদের চোখে পড়লে সেই কাজের স্থান, এলাকার ঠিকানা বিস্তারিত উল্লেখ করে ছবিসহ কমেন্ট করে আমাকে জানাতে। আবারও বলছি, ছবিসহ কমেন্ট করার চেষ্টা করুন। অপ্রয়োজনীয় অপ্রাসঙ্গিক কমেন্ট করা থেকে বিরত থাকুন।
ছিলো সবুজ ঢাকা গড়ার উদ্যোগও। লিখেছিলেন, রাজধানীর ৪০টি স্কুলে এক লাখ বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির উদ্বোধন করলাম মনিপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে। তবে শুধু একটা গাছ লাগানো নয়, প্রতিদিন একটা ভালো ইচ্ছে করি, একটা ভলো কাজ করি, একটা ভালো কথা বলি, একটা ভালো চিন্তা করি, এভাবে যদি নিজেকে বদলাই, তাহলে পৃথিবী বদলে যাবে।
কর্ম
কাজে হাতও লাগিয়েছিলেন মেয়র আনিসুল হক। সেসবের বেশিরভাগ তিনি শেষ করে যেতে পারেন নি। তবে তার শুরু করা কাজগুলোর চিত্র দেখা যায় তার ফেসবুকে। জানিয়েছিলেন, ডিএনসিসি ঢাকা উত্তরের অনেক স্থানে নর্দমা পরিষ্কার করতে গিয়ে দেখতে পাচ্ছে ভয়াবহ চিত্র। এমন কোনো কিছু নেই যা নর্দমায় ফেলা হচ্ছে না। ফলে সেগুলো পয়নিষ্কাশনের ক্ষমতা হারাচ্ছে। বাসযোগ্য ঢাকা গড়ার জন্য দিনরাত কাজ করছে ডিএনসিসির কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। কিন্তু ঢাকা তো আমাদের সবার। আসুন আমরা নিজেদের স্বার্থেই নর্দমায় যেকোনো কঠিন বর্জ্য ফেলা থেকে বিরত হই।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়েও ছিলো তার ভাবনা, বাড্ডায় চালু হলো ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) ৫১তম সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন। বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ডিএনসিসি’র এ উদ্যোগের ফলে ওই এলাকার গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যস্ততম সড়ক প্রগতি সরণীর বিভিন্ন পয়েন্টে বিদ্যমান আবর্জনার স্তুপ আর দেখা যাবে না।
তার চাপে দখলকারী প্রতিষ্ঠান নিজেরাই তাদের স্থাপনা সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়। সেকথাও সবাইকে জানান স্বপ্নদ্রষ্টা আনিসুল হক। লিখেন, দখলকারী প্রতিষ্ঠান নিজেরাই সরিয়ে নিচ্ছে অবৈধ স্থাপনা। গুলশান, বনানী ও বারিধারা এলাকার সড়ক, ফুটপাত ও ড্রেনেজ-ব্যবস্থার উন্নয়নে ডিএনসিসির কাজ চলছে। ফুটপাত মাপতে গিয়ে ডিএনসিসির কর্মকর্তারা ফুটপাতে অবৈধ দখল চিহ্নিত করেন ও সরিয়ে ফেলার জন্য সময় বেঁধে দিয়ে আসেন। সময়ের মধ্যে দখলকারীরা এসব স্থাপনা সরিয়ে নিচ্ছেন।
এসব কাজ করতে গিয়ে নানান প্রতিকূলতার মধ্যেও পড়েন তিনি। কখনো কখনো তৈরি হয় ভয়াবহ পরিবেশ। কিছু মহল হয়ে ওঠে প্রতিপক্ষ। সেকথা জানিয়ে আনিসুল হক লিখেন, প্রতিনিয়ত ঢাকাকে শুধু বাসযোগ্য করতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন ডিএনসিসির কর্মকর্তারা। শত শত দখলকৃত জায়গা পুনরুদ্ধার করতে গিয়ে গুটিকয়েক মহলের প্রতিপক্ষ হয়ে উঠছে প্রতিষ্ঠানটি। শহরের বিভিন্ন স্থানে অনবরত আগুন লাগছে, যা একটি অশনিসংকেত। প্রতিটি বাড়ি, প্রতিটি কর্মস্থলকে নিরাপদ করতে হবে। গুলশান-১এর ডিএনসিসি মার্কেটে ঘটে যাওয়া অগ্নিকাণ্ডের তদন্ত পরবর্তী পদক্ষেপের অংশ হিসেবে ডিএনসিসি ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের পাশে থেকে শহরবাসীর স্বার্থরক্ষা করে যাবে।
ভিন্ন এক আনিসুল হক
প্রাণপ্রাচুর্যতাও টের পাওয়া যায় তার কথায়, তার আচরণে। ১৪ই এপ্রিল পয়লা বৈশাখ একটি ঘুড়ি ওড়ানোর ছবি ফেসবুকে সবার সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিয়েছিলেন তিনি। লিখেছিলেন পয়লা বৈশাখে, ঘুড়ি উৎসবে।
শুধু স্বপ্ন আর উদ্যোগের কেন্দ্রবিন্দুই নয়, আনিসুল হক ছিলেন ভালোবাসারও ঝর্ণাধারা। তার মমতা টের পাওয়া যায় হকারদের নিয়ে দেওয়া তার একটি স্ট্যাটাসে। সেখানে তিনি লিখেছিলেন, ঢাকার হকারদের শুধু উচ্ছেদ করলেই হবে না। এতোগুলো মানুষের পরিবারের বিষয়টিও চিন্তা করতে হবে। তাই তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। তবে এসবই সময় সাপেক্ষ যা আমাদের পরিকল্পনায় রয়েছে।
সঙ্গীতশিল্পী লাকী আখান্দকে নিয়ে ছোট্ট একটা পোস্টে পাওয়া গিয়েছিল বন্ধুর জন্য হাহাকার। বন্ধু লাকীর মৃত্যুর পরে ফেসবুকে একটি ছবি দিয়ে তিনি লিখেছিলেন, বন্ধু, তোমাকে ফেরানো গেল না। ভাল থেকো।
ঢাকাবাসীও আজ বলছে, মেয়র আপনাকে ফেরানো গেল না। ভালো থাকুন, আনিসুল হক।