শত শত পুলিশ এসে শুরু করলো সাঁড়াশি অভিযান। পাসপোর্ট কাগজপত্র ওয়ার্ক পারমিট সব তল্লাশি। গ্রেপ্তার করা হলো চারশ’রও বেশি প্রবাসী শ্রমিককে। অভিযান শেষ হওয়ার পরেও বহুক্ষণ অাতঙ্ক থাকলো বাংলাদেশিদের মধ্যে।
মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরের বুকিত বিনতাংয়ের যে হোটেলে অামাদের প্রোগ্রাম চলছে তার খুব কাছেই জালান অালোর ও জালান ছাংখাতে এই অভিযান চলে। পর্যটন এলাকা জালান আলো এবং জালান ছাংকাতের রেস্তোরাঁগুলোতে যারা কাজ করেন তাদের অধিকাংশেরও বেশি শ্রমিক বাংলাদেশি। তাদের ধরতেই এই অভিযান। জালান মানে সড়ক। অামাদের হোটেল থেকে এই দুই সড়ক কয়েক মিনিটের দূরত্ব। অামি সন্ধ্যায় বের হয়ে দেখি তখনও এই এলাকায় পুলিশের অানাগোনা।
অামার সাথে দেখা করতে অাসা এখানকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র অাবু সালেহ পুলিশের গতিবিধি দেখাতে দেখাতে বললো, বুকিত বিনতাং পর্যটন এলাকা। অাগে পুলিশ এসব এলাকায় অভিযান চালাতো না। কিন্তু এখন কোথাও ছাড় দিচ্ছে না। এতো বাংলাদেশি অবৈধভাবে কেন অাসছে অামার এমন প্রশ্ন শুনে সালেহ বললো ভাইয়া অাপনি তো সবই জানেন। দেশে কাজের খুব অভাব। অাবার বিদেশে যাবেন বেশিরভাগ বাজার বন্ধ। কিন্তু খুব সহজে অাসা যায় মালয়েশিয়ায়। তবে মালয়েশিয়ার কাজ ১০ সিন্ডিকেটের হাতে। তাদের মাধ্যমে এলে তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা লাগে। কিন্তু কেউ যদি ছাত্র বা পর্যটক সেজে কাজ করতে অাসে দেড় লাখ টাকায় সব হয়ে যায়। ফলে অনেকেই এই পথ ধরে এখানে অাসে। কিন্তু অবৈধ থাকে বলে পুলিশের অভিযানে ধরা পড়ে। অার মালয়েশিয়ার পুলিশ বাংলাদেশিদের সাথে কী বাজে ব্যবহার যে করে!
এক দশকের বেশি সময় ধরে এখানে অাছে অারেক বাংলাদেশি ছোট ভাই অাশরাফুল। অাইটির সাথে যুক্ত টুকটাক সাংবাদিকতাও করে। অামরা যে দোকানে বসে চা খাচ্ছিলাম ফোন দিয়ে সেখানে চলে এলো। অামি ওই দোকানে কাজ করা ইউসুফকে বললাম অামাদের চা দিও। ইউসুফের মতো অনেক বাংলাদেশি এখানে কাজ করে। তাদের অনেকেই অবৈধভাবে এসেছে। অাবার অনেকে বৈধভাবে এলেও নির্ধারিত সময়ে খরচের টাকা তুলতে পারেনি বলে অতিরিক্ত সময় থেকে গেছে। এখন অাবার তারা অবৈধ।
অাশরাফুল বললো, মালয়েশিয়ায় অবৈধ বাংলাদেশি যে কতো তার কোন হিসাব নেই। ফলে কোথাও অভিযান চলা মানে শত শত বাংলাদেশি অাটক। এদের দ্রুত সময়ে দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়ার কথা থাকলেও পাঠায় না। ফলে দিনের পর দিন তাদের জেলে থাকতে হয়। অার মালয়েশিয়ার পুলিশ বাংলাদেশি পেলে বাংলা বলে যে গালি দেয় সেই কথাগুলো বারবার বলছিলো।
বাংলাদেশিদের সাথে অালাপকালে তারা সবাই দেশ নিয়ে, গুম হত্যা নিয়ে হতাশার কথা বললেন। পাশাপাশি অাগামী নির্বাচন নিয়ে দুশ্চিন্তার কথা বললেন। প্রবাসের রাজনীতি, সাংবাদিকতা সব কীভাবে নষ্ট হচ্ছে সেসব কথা বললেন। জানালেন, এসব রাজনীতির কারণে পাল্টাপাল্টি রেস্টুরেন্ট থেকে শুরু করে নানা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে। হোয়াটস অ্যাপে নানা গ্রুপ জন্ম নিচ্ছে।
এতোক্ষণ যেসব কথা হলো সেই রাজনীতি, দালাল, অবৈধ বাংলাদেশি, দূতাবাসের বিরুদ্ধে অবহেলার অভিযোগ সবই অামার জানা। সাংবাদিক হিসেবে এসব নিয়ে অনেক নিউজ করেছি। অার শুধু মালয়েশিয়া নয় বিদেশের সব জায়গায় অামাদের লোকজন এই রাজনীতি করে। তবে হোয়াটস অ্যাপের গ্রুপটা ঠিক বুঝলাম না। পরে এখানকার বিডিনিউজের সাংবাদিক রফিক ভাই জানালেন, এখানে বাঙালিদের ব্যবসা বাণিজ্য, দোকান, অর্ডার অনেক কিছুই হোয়াটসঅ্যাপে হয়। সেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর নানা গ্রুপ। সব বার্তা হোয়াটস অ্যাপে যায়। হোয়াটস অ্যাপে মারামারিও নাকি হয়। অামি শুনে হাসবো না কাঁদবো বুঝতে পারি না। তার সাথে চায়না মার্কেটে ঘুরতে ঘুরতে একেকজন বাঙালির কষ্টগাঁথা দেখি। কোন একজন পর্যটক অাসছে তারা ডেকে ডেকে তাদের দোকানে অানার চেষ্টা করছে। চায়না মার্কেটের এসব দোকানে ব্যাগ, জুতো থেকে শুরু করে এমন কিছু নেই যা পাওয়া যায় না। তবে সবই অরিজিনাল ব্র্যান্ডের কপি। দামে সস্তা বলে প্রচুর লোকজন অাসে। তবে এসব দোকানে যারা কাজ করে তারা সবাই হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে। এরপর গাদাগাদি করে থাকে, ঘুমায়। বহু কষ্ট কেরে দেশে টাকা পাঠায় তারা।তবে ক্রিকেট খেলা হলে দলবেধে যায় দেখতে।
অভিবাসন বিষয়ক দুই দিনের যে সম্মেলনে এসেছি সেখানে এই প্রবাসীদের অসুস্থতা, মৃত্যু, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা নানা বিষয় নিয়ে অালোচনা হচ্ছিল। মনে মনে ভাবছিলাম অাদর্শ অবস্থা থেকে কতটা দূরে অাছি। মন খারাপ থেকে বের হতে রাস্তায় বেরিয়ে ফুটপাতে এক কিশোরির গান শুনছিলাম। তার সাথে যারা বাজাচ্ছিল সবাই অন্ধ।
রাতে রুমে ফিরে নেটে ঢুকতেই বিকেলের অভিযানের নিউজটা দেখলাম। শিরোনাম ‘440 illegal immigrants rounded up in Jalan Alor and Jalan Changkat’। সংবাদে মালয়েশিয়ার অভিবাসন পুলিশ বিভাগের মহাপরিচালক মুস্তাফার আলী অভিযানের বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, পুলিশ বিকেলে এই অভিযান চালায়। অভিযান চলাকালে অন্তত ১ হাজার জনকে তল্লাশি করা হয়। ২শ’ ৬৭ জন পুলিশ অভিযানে অংশ নেয়। বৈধ কাগজ দেখাতে না পারায় তারা ৪শ’ ৪০ জনকে আটক করে। এদের বেশিরভাগই বাংলাদেশি। এছাড়া ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ার কিছু অাছে।
নিউজটা পড়তে পড়তে অার নিউজের সাথে অসহায় বাংলাদেশিদের অসহায় মুখগুলো দেখতে দেখতে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে যায়। রুমের পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকাতেই টুইন টাওয়ারের অালো চোখে পড়ছিলো। সেই অালো দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিলো কতো কতো প্রবাসী বাংলাদেশির কষ্ট অার শ্রম অাছে এই শহরে তার হিসাব কখনো কি কেউ করেছে! টুইন টাওয়ারের মতো উচু নয় বলে, মাটির সাথে থাকে বলে এদের কথা কেউ ভাবে না। অার মালয়েশিয়ার পুলিশ না হয় বাংলা বলে অামাদের গাল দেয়, এইসব শ্রমিকের নিজ দেশ অামাদের বাংলাদেশই বা কতটো তাদের মর্যাদা দেয়। বহু বছর অাগে করা একটা নিউজের শিরোনাম মনে পড়লো। প্রবাসীরা রাষ্ট্রকে শুধু দিচ্ছেন, পাচ্ছেন না কিছুই।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিতমতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)