টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপ ২০১৬ তে বাংলাদেশের আরো এক খেলা থাকলেও আসল যাত্রা থেমে গেছে। জাতীয় দলকে নিয়ে আপাততঃ থেমে গেছে মানুষের অনেক আশা-আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন। অফিস-আদালত-বাড়ি-রাস্তাঘাট, বিভিন্ন পেশার মানুষ- সবাই যেনো একরকম পাগলাটে হয়েছিলো বাংলাদেশের খেলা নিয়ে। কী রকম একটা উদ্দীপনা, ভাবতেই গা শিউরে উঠে। ক্রিকেটই যে আমাদের সবার ঐক্যের একমাত্র মিলনস্থল।
আরও থেমে গেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নব্য ক্রিকেট বিশ্লেষকদের নানা মত-দ্বিমত-তর্ক-কুতর্ক আর সমালোচনা। আবেগের দেশে আবেগী যুক্তি আর খেলোয়াড়দের ওপর কড়া নজরদারি যেনো এখন একটু হালকা। কেউ কেউ তো পারলে মাঠে নেমে চার-ছক্কা হাঁকাতে চেয়েছেন। পত্রপাঠ বিদায় জানাতে চেয়েছেন বাংলাদেশের ইতিহাসে সেরা অধিনায়ক, মাঠের সেরা উজ্জীবক, মাশরাফিকে।
কী পেলাম আর কী পেলাম না- এ নিয়ে কথার ফুলঝুড়ির অবসান হচ্ছে না সহজেই। আর কী করলে কী হতে পারতো, সে নিয়ে তো আক্ষেপের অভাব নেই। বাংলা-ইংরেজি ভাষার দক্ষতায় অসীম ভালোবাসা আর কট্টর কটুক্তিতে ভরে গেছে ফেসবুক নামক বিশ্বের জনপ্রিয়তম সোস্যাল মিডিয়া নেটওয়ার্ক। ট্রল আর পাল্টা ট্রলের দৌরাত্মও কম ছিলো না। আমাদের সেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান, মুশফিক- কারও বিরুদ্ধে কথা বলতে ছাড়িনি আমরা। কথার যতো মারপ্যাঁচ আছে তা দিয়ে জড়িয়ে ধরতে চেয়েছি বারংবার। কী উদ্দেশ্যে তা বলা মুশকিল। ওই যে বললাম, বড্ড আবেগী জাতি আমরা!
মুখ্য বিষয়টি হচ্ছে এই বিশ ওভারের সবচেয়ে বড় আসরে কী শিখলাম। এই নতুন ঘরানার ক্রিকেট খেলাটা কতোটা সামলাতে পারলাম। হ্যাঁ, পেশাদারিত্ব, মস্তিস্ক বরফের মতো ঠাণ্ডা রাখা- এই দুয়ের হয়তো বড়ই অভাব ছিলো পুরো টুর্নামেন্ট জুড়ে। সেটাও উতরে যাওয়া সম্ভব ছিলো।
তবে সময়টা হয়তো এখনো আসেনি। ভাগ্য হয়তো সুপ্রসন্ন ছিলো না আমাদের। আর একটু ধৈর্য আর উপস্থিত বুদ্ধির প্রয়োগ মাঠে ঘটাতে পারলে বাংলার বাঘের গর্জন এবার শুধু গর্জনে না থেকে শিকারে পরিণত হতো। হয়েছে উল্টো- বিশ ওভারের বিষে দংশন হয়েছে।
একটু পেছনে যদি ফিরে তাকাই, তাহলে প্রথমেই বলতে হয় আন্তর্জাতিক মোড়লদের কথা। মানসিকভাবে একটি দলকে পথিমধ্যে বিধ্বস্ত করার কোন ছবি এঁকেছিলো তারা? কেনোই বা তাদের এই নকশা-অংকন? তাসকিন-সানি দীর্ঘদিন যাবত এই দলটির সাথে খেলছে। হুট করেই তাদের পরীক্ষার মধ্যে ফেলে দেওয়া হলো। কলকাঠি কে নাড়লো তার অনুমানে গিয়ে খামোখা সময় নষ্ট।
কথা হচ্ছে, এই গুরুত্বপূর্ণ গভার্নিং বডি কি ক্রিকেটারদের উন্নয়নে কাজ করছে নাকি উদীয়মান দলগুলোকে গুম করে দেওয়ার চেষ্টা করছে? চেষ্টা করছে একটি দলকে কী করে পঙ্গু বানানো যায় যেনো আন্তর্জাতিক মোড়লেরাই শুধু ভালো থাকে, ভালো খায়, আর ভালো খেলে? সাম্প্রতিক সময়ে যেসব বোলাররা নিষিদ্ধ হয়েছেন তারা কি ফিরে আসতে পেরেছেন? শোয়েব আখতার আর ইয়ান চ্যাপেলের কথায় কী-ই বা যায় আসে? তারা শুধু বলেছেন আইসিসি কাজটা ঠিক করেনি। ব্যাস, ওখানেই সব শেষ।
ধর্মশালায় কড়া ঠাণ্ডার ভেতর বাছাই পর্বে বাংলাদেশ দলকে খেলানো। সেই আবহাওয়ায় খাপ খাওয়ানো মোটেও সহজ কাজ ছিলো না। বাংলাদেশ তা সফলভাবে পেরেছে। তামিম বাংলাদেশের জন্য ইতিহাস গড়ে প্রথম টি-টুয়েন্টি সেঞ্চুরি এনে দিয়েছেন। গৌরবান্বিত হয়েছে বাংলাদেশ।
এরপরও দলের ভেতরে একটা সুর বাজছিলো। তাসকিন আর সানি হয়তো থাকছেন না। সেই আধা-আস্থা নিয়ে পাকিস্তানের সাথে খেলতে নামা এবং সে খেলায় খাটো লেংথের বল, ওয়াইড আউটসাইড অফ স্টাম্প বোলিং, ডেথ ওভারে বোলিং অদক্ষতা আর মিসফিল্ডিংয়ে বড় স্কোর গড়ে পাকিস্তান।
কোনোভাবেই সে ম্যাচে আর ঘুরে দাঁড়ানো গেলো না। আর ইডেনে পাকিস্তান সমর্থনতো আমাদেরসহ পুরো বিশ্বকে বিস্মিত করেছে। তাসকিন-সানি সে ম্যাচে খেললেও মনের ভেতর একটা খুঁতখুঁত কাজ করেছে। কখন যেনো আইসিসি তাদের ফাঁসিকাষ্ঠে দাঁড় করায়। সেই ভয় তাদেরকে প্রাণ উজাড় করে খেলতে দেয়নি। মৃত্যু পরোয়ানা তো জারি হয়েই ছিলো। শুধু দিনক্ষণ ছিলো বাকি।
এরপর তো আইসিসির মূল নাটক মঞ্চায়িত হলো বিশ্ব দরবারে। পরিচালনা করলো ক্রিকেট বিশ্বের মোড়লেরা। তাসকিন আর সানি বাদ পড়লেন। ম্যাশ চোখের পানি ধরে রাখতে পারলেন না প্রেস কনফারেন্সে। দলের মনোবল কমে গেলো আরও একটু। আরও একটু গ্রাস করা হলো বাংলার ছেলেদের আস্থা। অশ্রুসিক্ত হলেন তাসকিনের বাবা-মা পরিবার। কাঁদলো গোটা বাংলাদেশ।
অস্ট্রেলিয়ার সাথে পুরো বাংলাদেশ দলটি দুর্দান্ত খেললেও শেষ দিকে সাকলায়েন সজীবের ওভারে ম্যাচের ভাগ্য বদলে যায়। তামিম শরীর খারাপ থাকায় খেলতে পারলেন না। তবে সাকিব আল হাসান আবারও বোঝালেন জাত কি জিনিস। শুধু ওই একটি ওভার বাদ দিলে বাংলাদেশ অল্পের জন্য হারলো। সেদিনের খেলায় বাংলাদেশ দলের ছিলো না কোনো দেহভাষা। ছিলো না রসায়ন। এর পেছনে একটা বড় কারণ সেই আইসিসি। তারা ধীরে ধীরে যে আমাদের দলটির মনোবল পুরো গিলে ফেলতে চাইছিলো।
ভারতের সাথে ম্যাচটিতে আমরা ইচ্ছে করেই মনে হয় হেরে গেলাম। সিঙ্গেলস নিয়ে নিশ্চিত জেতা ম্যাচটি গ্ল্যামার শটে থমকে গেলো। শেষ হলো সব স্বপ্ন। মাঠে সেটেল্ড ব্যাটসম্যানরা পার্টনারশিপ গড়তে পারলেন না। স্কুলবয় ক্রিকেট খেলে ভারতের কাছে হারতে হলো। নির্বাচক কোনো না কোনো এক অদ্ভুত কারণে খেলিয়ে চললেন মিথুনকে। আর নাসির ডাগ-আউটে বসে ব্যাটসম্যানদের গ্রিপ ঠিক করে দিলো। সহযোদ্ধারা চার-ছয় মারলে জোরে হাততালি মারলো।
আমরা হারালাম একজন অ্যাগ্রেসিভ ব্যাটসম্যান, অ্যাটাকিং ফিল্ডার আর একজন কনট্রোলড বোলারকে। অনেক মার খাওয়ার পরও বুমরা ঠিকই মারাত্মক কামব্যাক করলো। এটাই হলো পেশাদারিত্ব। ফুল টসে আউট হলেন সৌম্য আর মাহমুদুল্লাহ। মুশফিক দুটো বাউন্ডারি মারার পর তুলে মারতে গিয়ে আউট। এটা অপেশাদরিত্ব।
অন্যদিকে, মাহমুদুল্লাহকে বোলিংয়ে খুব কম ব্যবহার করলেন অধিনায়ক। ভারতের বিরুদ্ধে শুভাগত হোম আর অস্ট্রেলিয়ার সাথে সাকলায়েন সজীবের জায়গায় মাহমুদুল্লাহকে সেভাবে ব্যবহার করা হলো না। একইভাবে যেভাবে তাকে বলই দেওয়া হলো না পাকিস্তানের সাথে প্রথম ম্যাচটিতে। সুদূরপ্রসারী চিন্তা কোথায় যেনো আটকে গেলো।
শেষ হলো বাংলাদেশের এবারের টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপের স্বপ্ন। মূলত একটি দল যখন বারবার প্রতিবন্ধকতার সামনে পড়েছে, সেই দলটির কাছ থেকে এর চেয়ে বেশি কিছু আশা করাটা নেহায়েত অন্যায় হবে। অনেকেই আইসিসির বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছেন। বিসিবির পক্ষ থেকেও এরকম একটা কর্মসূচি আশা করেছিলাম। বিসিবির ক্রিকেট ডিপ্লোম্যাসিটা হয়তো আরও একটু বুঝতে হবে। আইনি লড়াইটা চালাতে হবে জোরেসোরে এবং সেটা হতে হবে আন্তর্জাতিক মানের।
আর নির্বাচকেরা যখন একজনকে সিলেক্ট করবেন তখন তিনি খারাপ খেললেও ঘাড় বাঁকা করে তাকেই খেলিয়ে যেতে হবে এটা কোন কিতাবে বর্ণিত, তা বোঝা যাচ্ছে না। এর পেছনে একটা বড় ‘কিন্তু’ আছে।
সবশেষে বলতে চাই, একটা সময় আসবে যখন সাকিব, মাশরাফি, মুশফিক, তামিম আর নাসির- এই গোল্ডেন ফাইভ আর দলে থাকবেন না। সে সময়টা ভবিষ্যতে হলেও ওই সময়টা বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসে একটি খরার যুগ হবে।
তাই এখন থেকেই তিন ফরম্যাটের ক্রিকেটে স্পেশালিস্ট প্লেয়ার তৈরির কাজে মনোনিবেশ করতে হবে বোর্ডকে। যারা শুধু টি-টুয়েন্টি, বা শুধু ওয়ানডে বা টেস্ট এবং ওয়ানডে খেলতে পারবেন একসাথে বিশেষ মেধাগুণে। এখন থেকে ভাবা না হলে কবে নাগাদ আমরা আবার একজন সাকিব, একজন মাশরাফি, একজন মুশফিক, একজন তামিম আর একজন নাসিরকে পাবো?
কিউইদের সাথে এখনো একটা খেলা বাকি। এই বিশ্বকাপে যা আমাদের শেষ খেলা। আশা করি ছেলেরা ভালো খেলার প্রত্যয়ে মাঠে নামবে এবং ইতিবাচকভাবে শেষ করবে এবারের বিশ্বকাপ। অবশ্যই তাদের সাথে থাকবে ষোল কোটি মানুষের ভালোবাসা, শ্রদ্ধা আর সমর্থন। সর্বোচ্চ শুভকামনা থাকলো লাল-সবুজের বাংলাদেশের জন্য।