ফেসবুক স্ট্যাটাসের মাধ্যমে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে রংপুরের পাগলাপীর ঠাকুরপাড়ার কথিত টিটু রায়কে তথ্য প্রযুক্তি আইনে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নেওয়া হলেও এখনো উত্তর মেলেনি অনেক প্রশ্নের। ঘটনার শুরু থেকেই ফেসবুক আইডির টিটু এবং স্থানীয় টিটু রায়ের পরিচয় নিয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়; যা এখনও খোলাসা করতে পারেনি আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
এমডি টিটু (MD TITU) নামের একটি আইডি থেকে ‘ইসলাম ধর্ম অবমাননাকারী’ স্ট্যাটাস দেওয়ার অভিযোগে ঠাকুরপাড়ার হিন্দুদের বাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। অনেক ঘরবাড়ি ভস্মিভূত হওয়ার সাথে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে এক যুবক নিহতও হয়েছেন। এরপর পরিস্থিতি সামাল দিতে ‘উস্কানি দেওয়ার’ অভিযোগে টিটু রায়কে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নেওয়া হয়।
তবে স্থানীয় টিটু রায় এবং স্ট্যাটাস দেওয়া ‘মো. টিটু’ এক ব্যক্তি কি না, সেই প্রশ্নের সমাধান না মিললেও যে আইডির স্ট্যাটাস থেকে এত কাণ্ড সেই আইডিতে থাকা ছবি টিটু রায়ের বলেই শনাক্ত করেছে স্থানীয়রা।
টিটু রায় লেখাপড়া জানেন না বলে জানিয়েছেন তার পরিবারের সদস্যরা। সে কখনও স্কুলেও যায়নি বলেও জানান তার মা। এ কারণে যে ব্যক্তি লেখাপড়া জানে না, তার দ্বারা এমন স্ট্যাটাস দেওয়া কীভাবে সম্ভব সে প্রশ্নও আসছে।
ঠাকুরপাড়াবাসী এবং তার স্বজনদের কাছ থেকে জানা যায়: এই গ্রামের মৃত খগিন্দ্র চন্দ্রের ছেলে টিটু রায়৷ সে লেখাপড়া করেনি, কোনোমতে নিজের নামটা শুধু সাক্ষর করতে জানে৷ প্রায় সাত বছর আগে পাওনাদারের ভয়ে বাড়ি-ঘর ছেড়ে ঢাকায় চলে যায় টিটু৷
আবার কেউ কেউ বলছেন, এমডি টিটু নামের আইডি থেকে স্ট্যাটাস দেওয়া হয়নি, ওই আইডি থেকে অন্য একজনের স্ট্যাটাস শেয়ার করা হয়েছে।
রংপুরের স্থানীয় সাংবাদিক এবং প্রেস ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক লিয়াকত আলী বাদলের ভাষ্য: মো. টিটু (MD TITU) নামে দু’মাস আগে একটি অ্যাকাউন্ট খোলা হয়, টিটু রায় নয়৷ তবে আইডিতে রংপুর সদরের ঠাকুরপাড়া গ্রামের টিটু রায় ও তার পরিবারের ছবি রয়েছে৷ আর ওই আইডি থেকে স্ট্যাটাসটি শেয়ার করা হয়েছে৷ তবে যে ব্যক্তির স্ট্যাটাস শেয়ার করা হয়েছে, সেই ব্যক্তিকে চিনতে পারেননি স্থানীয়রা৷
ফেসবুকে টিটুর স্ট্যাটাস সম্পর্কে জেলা পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান জানান: ফেসবুকে তার দেওয়া ধর্ম অবমাননার স্ট্যাটাস খুঁজে পাওয়া যায়নি। এলাকায় বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে দিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িতে হামলা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটানো হয়েছে।জার্মানি ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ডয়েচে ভেলের তথ্য অনুযায়ী, খুলনার এক মাওলানার ফেসবুক থেকে স্ট্যাটাসটি ছড়িয়ে পড়ে৷ খুলনার ‘মাওলানা আসাদুল্লাহ হামিদি’র ফেসবুকে একটি স্ক্রিনশট শেয়ার করা হয় ২৫শে অক্টোবর, তিনি অন্য একজনের ফেসবুক স্ট্যাটাস শেয়ার করেছিলেন৷ একই স্ট্যাটাস আবার ‘বাংলাদেশি টিনএজার’ নামে একটি গ্রুপের সাথে শেয়ার করতে দেখা গেছে৷ রংপুরের ওই এলাকার স্থানীয় সূত্র জানায়, এলাকাবাসীকে একই ফেসবুক স্ট্যাটাসের ছবি দেখানো হয়েছে৷ তাতে দেখা যায় টিটুর ছবি দিয়ে একটি আইডি৷ কিন্তু ফেসবুক আইডি’র নাম এমডি টিটু৷
মাওলানা আসাদুল্লাহ হামিদি ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশ-এর খুলনার দিঘলিয়া উপজেলার সভাপতি এবং খুলনা জেলা শাখার সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি জানান: আমি সংবাদ মাধ্যমে জেনেছি যে, আমি যে স্ট্যাটাস শেয়ার করেছি তা নিয়ে রংপুরে হিন্দুদের ওপর হামলা হয়েছে৷ কিন্তু আমি যে স্ক্রিনশট শেয়ার করেছি তা টিটু নামের কেউ দেয়নি। দিয়েছে আরেকজন৷ সে আমার ফেসবুক বন্ধু না৷ আর ওই আইডি আসল নাকি নকল তাও আমি জানি না৷ তবে আমি শুনেছি, যে ব্যক্তি ওই স্ট্যাটাস দিয়েছিল সিলেট থেকে অনেক আগেই গ্রেপ্তার হয়েছে সে৷
তবে বুধবার টিটু রায়কে আদালতে হাজির করা হলে তার পক্ষে কোন আইনজীবীও দাঁড়াননি। নীলফামারি থেকে দুর্বৃত্তদের দেয়া আগুনে ঘরপোড়া টিটু রায়কে গ্রেপ্তারের পর রংপুর ডিবি পুলিশ টিটুকে আদালতে তুলে ১০ দিনের রিমান্ড চাইলে, বুধবার চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে আদালত। কিন্তু এসময় টিটুর পক্ষে কোন আইনজীবী ছিলেন না।
টিটু রায়ের পক্ষে কোনো আইনজীবী না দাঁড়ানোর ব্যাপারটিকে অস্বাভাবিক হিসেবে উল্লেখ করে আইন বিশেষজ্ঞ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: আইনী সহায়তা পাওয়া যেকোন নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার।অভিযোগ প্রমাণ হওয়ার আগে কাউকে দোষী বলা যায় না। অভিযোগ যত গুরুতরই হোক, বিচার পাওয়ার অধিকার তার আছে। তাকে আইনি সহায়তা দেওয়া এখন রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
সাম্প্রদায়িক উস্কানি দাতা যে বা যারাই হোক যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে তাদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার বিকল্প নেই বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
গত শুক্রবার কয়েক হাজার মানুষ ওই গ্রামের হিন্দুবাড়িতে হামলা চালিয়ে কয়েকটি বাড়িঘরে আগুন দেয়। এসময় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে হাবিবুর রহমান নামে একজন মারা যান। আহত হন আরও অন্তত ১১ জন।
এ ঘটনায় গঙ্গাচড়া থানার এসআই রেজাউল করিম ও কোতোয়ালি থানায় এসআই রফিকুল ইসলাম বাদী হয়ে দুটি মামলা করেছেন। এসব মামলায় দুই হাজারের বেশি লোককে আসামি করা হয়েছে। পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে ১২৪ জনকে। আর জেলা প্রশাসন গঠন করেছে একটি তদন্ত কমিটি।