টাইম বর্ষসেরা ব্যক্তিত্বের স্বীকৃতি পেলেন নিপীড়িত সাংবাদিকরা
শ্রদ্ধা জানাতে একই সংখ্যার চারটি প্রচ্ছদ
সত্য প্রকাশের ‘অপরাধে’ গুম, খুন, কারাবন্দী আর নির্যাতনের শিকার সাংবাদিকদের এ বছরের বর্ষসেরা ব্যক্তিত্বের স্বীকৃতি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী সাপ্তাহিক টাইম ম্যাগাজিন। তাদের ‘দ্য গার্ডিয়ানস’ নাম দিয়েছে বিশ্বখ্যাত এই সাময়িকী।
যেসব সাংবাদিকরা নিজ পেশার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বিভিন্ন দেশের সরকারসহ প্রতিপক্ষের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছেন, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এবার টাইম ম্যাগাজিন চারটি ভিন্ন ভিন্ন প্রচ্ছদ ছাপিয়েছে।
জামাল খাশোগি
চারটি প্রচ্ছদের একটিতে আছেন ওয়াশিংটন পোস্টের সাংবাদিক জামাল খাশোগি। তুরস্কের ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটের ভেতর গত ২ অক্টোবর যাকে হত্যা করা হয়েছিল। সৌদি আরবের এই সাংবাদিক ছিলেন দেশের রাজতন্ত্রের কট্টর সমালোচক।
এই হত্যাকাণ্ডের কথা সৌদি সরকার প্রথমে বারবার অস্বীকার করলেও তুর্কি সরকার তাদের কাছে থাকা প্রমাণ একের পর এক প্রকাশ করতে থাকলে এক পর্যায়ে বেরিয়ে আসে যে, খাশোগিকে কন্যুলেটের ভেতরেই হত্যা করে লাশ গুম করে ফেলা হয়েছিল।
হত্যাকাণ্ডটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং পরিকল্পিত ছিল এবং রাজপরিবারের নির্দেশে এটি ঘটানো হয়েছে – এমনটাও বেরিয়ে আসে তুর্কি সরকার ও সিআইএ’র তদন্তে। এমনকি সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান এতে জড়িত ছিলেন বলেও জানায় সিআইএ।
ক্যাপিটাল গেজেট
দ্বিতীয় প্রচ্ছদে আছেন মার্কিন দৈনিক ক্যাপিটাল গেজেটের সংবাদকর্মীরা। এদের মধ্যে পাঁচজনকে দায়িত্ব পালন করার কারণে হত্যা করা হয়েছিল।
গত ২৮ জুলাই ম্যারিল্যান্ডের অ্যানাপলিসে ক্যাপিটাল গেজেটের কার্যালয়ে এক বন্দুকধারী অতর্কিতে হামলা চালিয়ে সম্পাদনা পর্ষদের পাঁচজনকে হত্যা করে। তদন্তে জানা যায়, ২০১২ সালে পত্রিকাটির বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করে হেরে যাওয়ার ক্ষোভ এতদিন পুষে রেখে সন্দেহভাজন হামলাকারী এভাবে প্রতিশোধ নিয়েছে।
এ ঘটনার দিন থেকে পুলিশ অফিসে কর্মীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ রাখার পর ভবনের কারপার্কেই পরদিনের সংস্করণের কাজ শুরু করেন বাকিরা। নিহত সহকর্মীদের জন্য শোকবার্তা প্রকাশের পাশাপাশি পরদিনের পত্রিকার সম্পাদকীয় পাতাটা খালি রাখা হয়েছিল। সেখানে শুধু একটি ছোট নোট দেয়া ছিল: ‘আমরা বাকরুদ্ধ’।
ওয়া লোন, কিয়াও সোয়ে
তৃতীয়টিতে আছেন রোহিঙ্গা নির্যাতন কাভার করতে গিয়ে মিয়ানমারে কারাবন্দী রয়টার্সের সাংবাদিক ওয়া লোন এবং কিয়াও সোয়ের ছবি হাতে তাদের স্ত্রী। দু’জন সাংবাদিকই মিয়ানমারের নাগরিক।
২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে এই দু’জন রাখাইন রাজ্যের ইন দিন গ্রামে ১০ রোহিঙ্গাকে হত্যা ও গণকবরের ঘটনাটি তদন্ত করছিলেন। অনুসন্ধানের জন্য স্থানীয় দুই পুলিশ কর্মকর্তা তাদেরকে কিছু সরকারি কাগজপত্র দিয়েছিলেন।
কিন্তু ওই বছরের ডিসেম্বরে লোন এবং সোয়েকে রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। অভিযোগ করা হয়, তাদের কাছে থাকা কাগজপত্র তারা বেআইনিভাবে যোগাড় করেছেন।
মামলার রায়ে দোষী সাব্যস্ত করে তাদের প্রত্যেককে ৭ বছর করে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।
মারিয়া রেসা ও তার র্যাপলার
চতুর্থ প্রচ্ছদে সম্মাননা জানানো হয়েছে ফিলিপিন্সের সাংবাদিক মারিয়া রেসাকে, যিনি টানা ৩৩ বছর যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুপক্ষের হামলা থেকে প্রাণ বাঁচিয়ে রিপোর্টিং করে এসেছেন। কিন্তু এখন মাদকবিরোধী অভিযানের নামে প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতের্তে ও তার সরকারের বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং সরকারবিরোধী কণ্ঠরোধের প্রতিবাদ করতে গিয়ে জীবনের ঝুঁকিতে আছেন।
সিএনএনের এই সাবেক রিপোর্টার ২০১২ সালে ফিলিপিন্সে নিজস্ব অনলাইন নিউজ সাইট র্যাপলার চালু করেন। অল্প সময়েই সাইটটি অনমনীয়, সত্যনির্ভর অনুসন্ধানী সংবাদ প্রকাশের সুখ্যাতি পেয়ে গেল।
পোর্টালটি শুরু থেকেই খোলাখুলি দুতের্তে, তার প্রকাশ্য বক্তব্য এবং মাদক নির্মূলে তার মারাত্মক ব্যবস্থাপনার সমালোচনা করে আসছে। এমনকি ২০১৬ সালের নির্বাচনের কয়েকমাস পরই র্যাপলার বিস্তারিত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করল যেখানে অভিযোগ করা হয়েছে কীভাবে নির্বাচনের আগে অটোমেটেড বট এবং ভুয়া ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে সামাজিক মাধ্যমে দুতের্তেপন্থি বার্তা ছড়ানো হয়েছিল।
সরকার অবশ্য এ দাবি অস্বীকার করেছে। দুতের্তে র্যাপলারের বিরুদ্ধে ‘সত্য বিকৃতি’র অভিযোগ এনে প্রেসিডেন্টের কার্যালয়ে এর রাজনৈতিক রিপোর্টারের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে র্যাপলারের লাইসেন্স বাতিল করা হয় এবং গত নভেম্বরে রেসা ও তার পোর্টালের বিরুদ্ধে কর ফাঁকির অভিযোগও আনা হয়।
টাইম কর্তৃপক্ষের ভাষায়, ‘তারা এই সাংবাদিকদের বেছে নিয়েছে ‘সত্যকে বের করে আনতে প্রতিনিয়ত তাদের বড় বড় ঝুঁকি নেয়ার জন্য, সঠিক তথ্য সন্ধানের ত্রুটিপূর্ণ, তবুও অত্যাবশ্যক অভিযানে নামার জন্য, আওয়াজ তোলার জন্য এবং সবাইকে জানানোর জন্য।’