টাইটানিক ডুবে যাওয়ার তিন দিন পরে বেঁচে যাওয়া ৭০০ জনকে নিউ ইয়র্কে পৌঁছে দেয়া হয় কার্পেথিয়া নামের একটি জাহাজে করে। অনেকেই প্রিয়জনকে পেয়ে আবেগ আপ্লুত ছিলেন সেদিন। অসুস্থদেরকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল হাসপাতালে। কিন্তু জাহাজ থেকে সেদিন ছয় জনের নামার অনুমতি ছিল না।
যেই ছয়জন সেদিন জাহাজ থেকে নামার অনুমতি পাননি তারা ছিলেন চীনের নাবিক লি বিং, ফ্যাং ল্যাং, চাং চিপ, আহ লাম, চুং ফু এবং লিং হি। যুক্তরাষ্ট্রের অ্যান্টি-ইমিগ্রেশন আইনের ‘চাইনিজ এক্সক্লুশন অ্যাক্ট’-এ চীনের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে ঢোকার অনুমতি ছিল না। পরের দিন ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা তাদেরকে কড়া নিরাপত্তায় ম্যানহাটনে নিয়ে যান এবং একটি কার্গো শিপে করে কিউবা পাঠিয়ে দেন।
সেই সময়ে বহু ব্রিটিশ নাবিক প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগ দেওয়ায় নাবিক সংকট চলছিল যুক্তরাজ্যে। তাই কিউবা থেকে তারা যুক্তরাজ্যে যাওয়ার উপায় খুঁজে পান।
টাইটানিক দুর্ঘটনার দিন থেকেই প্রচণ্ড ঠাণ্ডার কারণে চ্যাং চিপ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রে বেঁচে ফেরা অন্যদের চিকিৎসা দেয়া হলেও চীনা নাগরিক হওয়ায় চিকিৎসা পাননি চ্যাং চিপ। তিনি ১৯১৪ সালে নিউমোনিয়ায় মারা যান। তাকে লন্ডনে সমাহিত করা হয়। তবে কোথায় সমাহিত করা হয়েছে, তা সবার অজানা।
১৯২০ সাল পর্যন্ত বাকি ৫ জন একসাথেই ব্রিটেনে কাজ করেন। যুদ্ধের পরে অভিবাসীদের প্রতি বিদ্বেষ ও বৈষম্য তখন চরম অবস্থা ধারণ করেছিল। এরপর আহ লাম চলে আসেন হংকং-এ। লিং হি একটা স্টিমবোটে চড়ে ভারতের কলকাতায় রওনা দেন। লি বিং কানাডায় অভিবাসিত হন, আর ফাং লাং কয়েক বছর ব্রিটেন-হংকং ঘুরে শেষপর্যন্ত নাগরিক হন আমেরিকার।
দেড় হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন টাইটানিক দুর্ঘটনায়। এই ঘটনা নিয়ে তৈরি হয়েছে বহু ছবি, তথ্যচিত্র। কিন্তু এই ছয়জনের গল্প অজানাই থেকে গেছে বিশ্বের কাছে। টাইটানিকের ঘটনার ১০৯ বছর পর তাদের নিয়ে তৈরি হচ্ছে একটি তথ্যচিত্র। ‘দ্য সিক্স’ নামের তথ্যচিত্রটি চীনে মুক্তি পাওয়ার পর অংশ নেবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে। বেঁচে যাওয়া ছয় চীনা নাগরিকের জীবনে কী ঘটেছিল, সেই ঘটনা দেখানো হবে তথ্যচিত্রটিতে।
সিনেমার প্রধান গবেষক স্টিভেন শোয়ানকের্ট এক সাক্ষাতকারে বলেছেন, ‘ভেবেছি এই ছয়জনের কেউ না কেউ তো বিয়ে করেছেন, সন্তান হয়েছে, কাউকে না কাউকে তো বলেছেন ঘটনাগুলো।’
১০৯ বছর আগে চীনের ছয় নাগরিক যেই বৈষম্যের শিকার হয়েছেন, একবিংশ শতাব্দীতে এসেও প্রেক্ষাপট তেমন একটা বদলায়নি। এই প্রসঙ্গে স্টিভেন শোয়ানকের্ট বলেন, ‘জাতিগত বিদ্বেষ এমন একটি সমস্যা যা ১০০ বছর আগেও ছিল।’
‘দ্য সিক্স’ নির্মাণের জন্য গবেষকরা পুরো চীন সহ বিশ্বের নানা স্থান ঘুরে বেঁচে যাওয়া ছয় জনের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেছেন।
ছয় নাবিকের গল্প চীনের জনগণেরও অজানা। তবে ১৯৯৭ সালে জেমস ক্যামেরনের ‘টাইটানিক’ মুক্তি পাওয়ার পর টাইটানিক ডুবে যাওয়ার ঘটনা সম্পর্কে ধারণা হয়েছে তাদের। চীনের একটি থিম পার্কে টাইটানিকের আদলে একটি জাহাজের রেপ্লিকাও তৈরি করা হয়েছে। ‘দ্য সিক্স’ এর ট্রেলার যখন ওয়েইবো-তে মুক্তি দেয়া হয়, খুব দ্রুত এর ভিউ মিলিয়ন ছাড়িয়ে যায়। অনেক পরিবেশকই ছবিটি পুরো চীন জুড়ে সিনেমা হলে মুক্তি দেয়ার প্রস্তাব দেন।