ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশার পাশাপাশি রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে উঠেছে ঝাড়ু। ডেঙ্গু প্রতিরোধে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে সম্প্রতি তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদের নেতৃত্বে রাজপথ ঝাড়ু দিয়েছেন চলচ্চিত্রের তারকারা। আর তারপর থেকেই দেশে আলোচিত হয়ে উঠেছে ঝাড়ু।
ঝাড়ু নিয়ে কবিতা, প্রবন্ধ, ব্যঙ্গরচনা, ছড়া, কৌতুক, কার্টুন কত কী যে তৈরি হচ্ছে। বাংলার জনগণ তাদের সৃজনশীলতা ও সাধ্যের সবটুকু ঢেলে দিয়ে ঝাড়ু-বন্দনায় মেতে উঠেছেন!
ঝাড়ু অবশ্য আমাদের জীবনে একটি খুবই পরিচিত ও প্রয়োজনীয় জিনিস। ঝাড়ু একেক এলাকায় একেক নামে পরিচিত। কোথাও ঝাড়ুর নাম ‘ঝাঁটা’। কোথাও একে বলে ‘পিছা’। কোথাও এর নাম খাংরা। তবে ঝাড়ু নামটি সব জায়গাতেই সমানভাবে পরিচিত। অভিধানে ঝাড়ুর একটি খুব ভালো নাম আছে। তা হলো- সম্মার্জনী। এর অর্থ হলো- যা দিয়ে ঝাঁট দেওয়া হয়; যা দিয়ে পরিষ্কার করা হয়। আর সম্মার্জন মানে হলো- পরিষ্কারকরণ; সাফকরণ।
আমরা যারা গ্রামে শৈশব-কৌশোর কাটিয়েছি তাদের কাছে ঝাড়ুর আলাদা বিশেষত্ব আছে। আমরা দেখেছি ঝাড়ু নিয়ে নানা সংস্কার। ছোট বেলায় আমরা যদি কখনও শখ করে ঘর-দোর ঝাড় দিতাম বাড়ির প্রবীণরা বলে উঠত, এই তো আজ বাড়িতে অতিথি আসবে। আসলে বাড়িতে অতিথি আসার সঙ্গে ছোট ছেলেমেয়েদের ঘর-দোর ঝাড় দেওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই।
এরকম ঘটনা কখনো ঘটে থাকলে তা নিতান্তই কাকতালীয়। তাপরও গ্রামের মানুষেরা এই সংস্কারে বিশ্বাস রাখতেন। গৃহস্থ বাড়িতে সকালে উঠেই ঘর-দোর ঝাড় দেওয়ার নিয়ম। সকালে ঘর-দোর ঝাড় দেওয়া না হলে নাকি যাত্রা শুভ হয় না। আবার শুভ কাজে বের হওয়ার সময় ঝাড়ু দেখলে যাত্রা ভঙ্গ হয়। বলা হয়ে থাকে, কারো যাত্রা নষ্ট করতে চাও তো তাকে ঝাড়ু দেখাও। ঝাড়ু নিয়ে আমরা এমন অসংখ্য কুসংস্কার দেখে এসেছি। যেমন: যখন কেউ নতুন বাড়ি করবে তখন যেন পুরনো ঝাড়ু ব্যবহার না করে।
নতুন বাড়ির জন্য নতুন ঝাড়ু ব্যবহার শ্রেয়। ঝাড়ু সবসময় লুকিয়ে রাখতে হয়। ঝাড়ু পা দিয়ে সরাতে নেই। ঝাড়ু দাঁড় করিয়ে রাখতে নেই। পুরানো ঝাড়ু আগুনে পোড়াতে নেই। রান্না ঘর বা খাবারের জায়গায় ঝাড়ু রাখতে নেই। সূর্যাস্তের পর ঘরে ঝাড়ু দিতে নেই। ঝাড়ু সবসময় পরিস্কার করে রাখতে হয়। বেশি পুরানো ঝাড়ু রাখতে নেই। স্বপ্নে ঝাড়ু দেখা মানে আর্থিক লোকসান। নতুন ঝাড়ু সবসময় শনিবার বোনা উচিত। ঘরের ঝাড়ু দিয়ে নোংরা স্থান ঝাঁট দেওয়া উচিত নয়। পূজা ঘরের ও রান্না ঘরের ঝাড়ু সবসময় আলাদা করা উচিত। ঝাড়ু পুরানো হয়ে গেলে ময়লার গাড়িতে ফেলা যেতে পারে কিন্তু জলে ফেলে দিলে বেশি ভাল হবে। আরও কত কী!
হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে ঝাড়ু খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। দেবী লক্ষ্মীর সঙ্গে ঝাড়ুর একটা যোগ আছে। ধন-সম্পদ কে না চায়! কিন্তু চাইলেই তো হল না, চঞ্চলা লক্ষ্মীকে ঘরে আটকে রাখা যে বড় কঠিন। ঝাড়ু দিয়ে ঝাঁট দিয়ে ঘরের ধুলো-ময়লা অর্থাৎ অলক্ষ্মী দূর করা হয়। অলক্ষ্মী দূর না করলে কিন্তু লক্ষ্মীদেবী ঘরের ঢোকার পথ পান না। তাই ঘরে সম্পদ ও সমৃদ্ধির জন্য ঝাড়ুর গুরুত্ব অপরিসীম।
অন্য সব জিনিসের মতো ঝাড়ুর উৎপত্তি ও বিবর্তনেরও একটা ইতিহাস আছে। হাজার হাজার বছর আগে থেকেই মানুষ ঝাড়ু ব্যবহার করতে শেখে। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা থেকে জানা যায়, প্রাচীন মানুষেরা সারা দিন বনে-জঙ্গলে পশুপাখি শিকার করত। সন্ধ্যায় ডেরায় ফিরে আগুনে পুড়িয়ে সেগুলো খেত। ঝড়-বাতাসে গুহায় ধুলোবালি জমে যেত। ধুলোবালির মধ্যে ঘুমোনো যেত না। তাই হাতের কাছে যা কিছু পেত তাই দিয়ে ঘুমোনোর জায়গাটা পরিষ্কার করে নিত। আস্তে আস্তে পশুর চামড়া, পশম, লেজের চুল ইত্যাদি দিয়ে তৈরি করল নরম তুলি।
গুহার মানুষ এই তুলি ব্যবহার করত ধুলোবালি পরিষ্কার করার কাজে। পশুর চুল কাঠির আগায় শক্ত করে বেঁধে তুলি বানাত তারা। মানুষ আরও সভ্য হতে থাকল। অন্ধকার থেকে ধীরে ধীরে আলোর কাছাকাছি আসতে থাকে গুহা বা বনবাসি মানুষ। প্রতিদিনের কাজে ব্যবহার করার জিনিসগুলো দিনে দিনে উন্নত হতে থাকল। তুলির পাশাপাশি ঝাড়ু বানাতে শিখল তারা। কতগুলো শলা, কাঠি বা আঁশ একসাথে লাঠির আগায় বেঁধে তৈরি করল ঝাড়ু।
আমেরিকার বিভিন্ন আদিবাসি গোষ্ঠী এ ধরনের ঝাড়ুর ব্যবহর প্রথমে শুরু করে। এখনও তা ব্যবহার করা হয় মেঝে পরিষ্কার করার জন্য। ইউরোপের অনেক এলাকার মানুষ রাস্তা পরিষ্কার করার জন্য এই ঝাড়ু ব্যবহার করে। এরপর ঝাড়ু তৈরি করা শুরু হয় শস্যের শলা যেমন গমের গাছ, কাশফুলের গাছ, নারকেল পাতার শলা ইত্যাদি দিয়ে। রান্নাঘর, শোবার ঘর পরিষ্কার করার কাজে লাগে এই ঝাড়ু। আমেরিকার লোকেরা প্রথম শলার ঝাড়ু ব্যবহার করতে শুরু করে। এই ঝাড়ু নিয়ে সে দেশে একটি মজার কাহিনী চালু আছে। কাহিনীটা হল- সে সময় আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন। তার ছিল এক ভারতীয় বন্ধু। সেই বন্ধু তাকে একবার কাশফুলের তৈরি একটি ঝাড়– পাঠিয়েছিলেন।
হাতল ছোট অথচ সামনে লম্বা অনেকগুলো নরম খড়কুটো ইত্যাদি শক্ত করে বাঁধা। ফ্রাঙ্কলিন ওই কাশফুলের কতগুলো গাছ মাটিতে লাগালেন। তা থেকে চারা গজালো। চারাগুলো বড় হল। বাড়িতে এনে তা দিয়ে ঝাড়ু তৈরি করলেন। কয়েক বছরের মধ্যে ব্যাপক চাহিদা বেড়ে যেতে আরম্ভ করল এ ঝাড়ুর।
বাড়িঘর পরিষ্কার করার জন্য ঝাড়ুর আমূল পরিবর্তন আসে ১৭৯৭ সালে। সেসময় লেভি ডিকেনসন নামের এক কৃষক বাস করতেন ম্যাসাচুয়েট্স-এর হ্যাডলি শহরে। তিনি যে খাদ্যশস্য চাষ করতেন তা তৈরি হয় শিশুখাদ্য সেরিলাক। এই খাদ্যশস্যের গাছ দিয়ে তিনি ঝাড়ু তৈরি করতেন। তার ঝাড়ুর মতো অমন সুন্দর ঝাড়ু আর কারও হতো না। লেভির ঝাড়ুর গুণের কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। লোকেরা বায়না ধরল, তাদের জন্য একটি করে ঝাড়ু তৈরি করে দিতে। ঝাড়ুর চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়ে গেল। লেভি ঝাড়ু বানানোর জন্য খাদ্যশস্যের চাষ বাড়িয়ে দিলেন। তিনি তা দিয়ে ঝাড়ু বানানো শুরু করলেন। আর তা বিক্রি হতে লাগল মুড়িমুড়কির মতো। লেভি তার এই ঝাড়ু নিয়ে খুব যে খুশি তা কিন্তু নয়। তার ভাবনা, কিভাবে এই ঝাড়ুকে আরও বেশি সুন্দর করে তোলা যায়। কাজেও লাগানো যায় ভালোভাবে। একটি যন্ত্র আবিষ্কার করলেন তিনি। এটি তাকে আরও সুন্দর ঝাড়ু বানাতে সাহায্য করল। পাওয়া গেল অল্প সময়ে অধিক ঝাড়ু তৈরির কৌশল।
১৮১০ সালে পায়ে চালানো ঝাড়ু তৈরির যন্ত্র আবিষ্কার করা হল। ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের সময় যে সব যন্ত্র আবিষ্কৃত হয় তার মধ্যে ঝাড়ু তৈরির এই অভিনব যন্ত্রটি ছিল অন্যতম। পরে এই যন্ত্রটিকে আরও উন্নত করে তাতে হাতল লাগানো হয়।
১৮২০ সালের দিকে ঝাড়ুতে নানান পরিবর্তন এল। আস্তে আস্তে ১৮৩০ সালে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে গেল ঝাড়ুর ব্যবহার। দুই একজন লোক তখন ঝাড়ুর দোকান দেয়া শুরু করল। কারখানা প্রতিষ্ঠা হল। সেখানে বছরে প্রায় ৬০ হাজার ঝাড়ু উৎপাদিত হতে থাকল।
ঝাড়ুর ব্যবহার বেড়ে গেল। রপ্তানিও শুরু হল পৃথিবীর নানা দেশে।বাংলা ভাষায় ঝাড়ু নিয়ে অনেক প্রবাদ প্রবচন আছে। যেমন-‘শ্বশুরবাড়ি মধুর হাড়ি,/নিত্য গেলে ঝাঁটার বাড়ি।এর অর্থ হলো শ্বশুরবাড়ি বেশি বেশি গেলে বা বেশি দিন থাকলে আদর-যত্ন পাওয়া যায় না। তাই শ্বশুরবাড়ি বেশি বেশি যেতে নেই, বেশি দিন থাকতেও নেই। এই প্রবাদের ঝাঁটা কিন্তু ঝাড়ুরই একটি প্রতিশব্দ।
আবার কাউকে তাড়াতে হলে বলা হয়, ঝেঁটিয়ে বিদায় কর। এই ঝেঁটিয়ে বিদায় করার অর্থ হলো ঝাঁটা দিয়ে পিটিয়ে তাড়ানো। কাউকে একই সঙ্গে অপমান ও শাস্তি দিতে হলে তাকে ঝাঁটাপেটা করা হয়। ঝেঁটিয়ে বিদায় করার কাজটি করা হয় ঝাড়ু দিয়ে। কাউকে অপমান করতে চাইলেও তাকে ঝাড়ু দেখানো হয়। আবার দাবি-দাওয়া আদায়ের জন্য, ব্যর্থ প্রশাসন বা সরকার তাড়াতেও ঝাড়ু মিছিল বের করা হয়।
তবে এক ক্ষ্যাপা কবি মারাত্মক এক কবিতা লিখেছিলেন: ‘বাঙালি মানুষ যদি পশু কারে কয়/বুকে মার শত লাথি মুখে মার শত ঝাঁটা/ তবু অনায়াসে সয়! হ্যাঁ, নিত্যদিন আমরা তো তা-ই সইছি! না হলে ডেঙ্গু তাড়ানোর নামে এমন প্রহসনের কেউ সাহস পায়?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)