চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

জয়, করপোরেট সংস্কৃতির জয়!

করপোরেট বলতে যৌথ কিছুকে বোঝায়। আর কর্পোরেট চাকরি বলতে সাধারণত বড় কোম্পানি বা বহুজাতিক কোম্পানিতে চাকরি করাকে বোঝায়। বর্তমান বাণিজ্য-জগতে করপোরেট পুঁজি বিরাট ভূমিকা পালন করছে। এই করপোরেটওয়ালারা আস্তে আস্তে তাদের ব্যবসায়িক জাল বিস্তৃত করছে। এই কাজটি তারা করছে অত্যন্ত সুকৌশলে। করপোরেটওয়ালারা একেবারেই একটা আলাদা সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে। ঝকঝকে, তকতকে, উজ্জ্বল, আকর্ষণীয়, স্মার্ট। যা চুম্বকের মত কেবলই আকর্ষণ করে, কাছে টানে! করপোরেট সংস্কৃতি এক আশ্চর্য জাদু।

এখানে বলে রাখা ভালো যে, সংস্কৃতি মানুষের আচার-আচরণ সম্পর্কিত। ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব, নৃ-বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান একে যেভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে, তার সঙ্গে করপোরেট সংস্কৃতিকে মেলানো যাবে না। সমাজে বাস করতে গিয়ে মানুষ যা করে, তা সামাজিক মানুষ হিসেবে তার অর্জিত সংস্কৃতি। আর করপোরেট জীবনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে গিয়ে মানুষ যা আয়ত্ত করে কিংবা অভ্যস্ত হয়, সেটাই করপোরেট সংস্কৃতি। প্রত্নতত্ত্ব কিংবা নৃ-বিজ্ঞানের আঙ্গিকে লুই বিনফোর্ড সংস্কৃতির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, সংস্কৃতি অভিযোজনের দেহাতিরিক্ত মাধ্যম (Culture is the extra somatic means of Adaptation)। এক্ষেত্রে পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে গিয়ে মানুষ তার দেহের বাইরে যা কিছু অর্জন করে, তাই তার সংস্কৃতি। একজন মানুষ তার শিক্ষাজীবন শেষ করে যখন করপোরেট জীবনে প্রবেশ করে, তখন সেখানকার সবকিছু তার আয়ত্তে থাকে না। সময়ের চাহিদা মিটিয়ে নতুন জীবনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে একজন পেশাজীবী যা কিছু অর্জন করে, সেগুলোই করপোরেট সংস্কৃতির অংশ। আর নতুন কর্মজীবনে টিকে থাকার ক্ষেত্রে এ বিষয়গুলো অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

মানুষ প্রকৃতিতে বাস করতে গিয়ে তার দৈহিক সত্তার বাইরে অনেক কিছু অর্জন করেছে। যেমন মেরু অঞ্চলের মানুষ শীত থেকে বাঁচতে গায়ে জড়িয়েছে সাদা ভল্লুকের চামড়া, বাস করছে ইগলুতে আর শরীর উষ্ণ রাখতে খায় সিল মাছ থেকে প্রাপ্ত চর্বি। তেমনি দেখা যায়, একজন মানুষ পুরো জীবনে ট্রাউজার, স্লিপার, লুঙ্গি, পাঞ্জাবি, টি-শার্ট কিংবা শার্টে অভ্যস্ত। শুধু বর্ষ সমাপনী মৌখিক পরীক্ষার দিন বাদে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের পুরো পাঁচ-ছয় বছরে কোনো দিন জুতা-মোজা পায়ে পরেননি তিনি। কিন্তু চাকরি জীবনে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই বদলে গেছে সংস্কৃতি। তিনিও পরিস্থিতির দায় মেনে নিয়ে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেছেন অনেকটা। শেষ পর্যন্ত তিনিও কালো প্যান্ট আর আয়রন করা সাদা শার্টের সঙ্গে ম্যাচ করা একটা টাই ঝুলিয়েছেন গলায়; বেশ চকচক করছে পালিশ করা জুতাজোড়া।

সময়ের সঙ্গে মিল রেখে তার জীবনের এই যে পরিবর্তন, নতুন যেসব অর্জন, সেগুলোকেই বলা যেতে পারে করপোরেট সংস্কৃতি (বর্তমানে আওয়ামী লীগও এক ধরনের ‘করপোরেট সংষ্কৃতি’র চর্চা করছে। অন্তরে যাই হোক, মুখে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বঙ্গবন্ধু ও জননেত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে ফেনা তুলতে হবে। মুজিব কোট গায়ে দিলেই হবে না, কে, কোথায়, কীভাবে বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করছেন, এই ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণের মধ্য দিয়ে অনুভূতিতে আঘাত হানছে, সে ব্যাপারে সজাগ-সতর্ক থাকাই নব্য আওয়ামী কর্মীদের প্রথম কর্তব্য। প্রয়োজনে মামলা করতে হবে। ৫৭ ধারায় মামলা। সরকারি কর্মকর্তা, আইনজীবী- কাউকেই ছাড়া যাবে না। ভয় দেখানো, ঘায়েল করাটাই আসল কাজ। সবাই তটস্থ থাকবে, পদানত থাকবে। এটাই নয়া জমানার নয়া ‘করপোরেট সংষ্কৃতি’) ।

পদের দিক থেকে কনিষ্ঠ একজন কর্মকর্তা কিংবা কর্মচারী তার জ্যেষ্ঠতম কিংবা অপেক্ষাকৃত জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে কী ধরনের আচরণ করবেন, হাঁটাচলা করবেন কীভাবে, তার বেশভূষা কেমন হবে, তিনি খাওয়ার সময় কাদের সঙ্গে বসবেন, ধূমপায়ী হলে সেটাও কাদের সঙ্গে এবং কোথায় করবেন, আড্ডাবাজি ও আনন্দ-ফুর্তিতে যোগ দিলে সেটাইবা কাদের সঙ্গে করবেন— এ ধরনের বিষয়গুলোও করপোরেট সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। করপোরেটওয়ালারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করবেন, কী ধরনের মন্তব্য করবেন, সেদিকেও সতর্কতা অবলম্বন করেন।

বর্তমান জমানায় করপোরেটদের দাপট দিন দিন বেড়েই চলেছে। রাষ্ট্র-রাজনীতি-সংস্কৃতি সবখানেই করপোরেটদের দাপট, তাদেরই প্রভাব। নতুন প্রজন্ম করপোরেটের টানে এক ‘অন্য জগতে’ হারিয়ে যাচ্ছে। সেই চিরচেনা দেশীয় ভাবধারার কিশোর-কিশোরীরা ক্রমেই আন্তর্জাতিক ও করপোরেট হয়ে উঠছে। একই সমাজে বেড়ে উঠছে দুই প্রজন্ম-একদল করপোরেট, আরেকদল বারোয়ারি। করপোরেট দুনিয়ার মানুষ এক আজব চিজ। প্রশিক্ষিত আর্মির চেয়েও এরা সুশৃঙ্খল। এবং সমস্ত করপোরেট সেকশেনের প্রতিটি টাইলসের ফাঁকে ফাঁকে দাঁড়িয়ে হাসে আর হাসে কেউ হাসলেও এরা হাসে কেউ কামড়ালেও এরা হাসে! এদের উপর দাঁড়িয়ে থাকে আমাদের ব্রান্ডেড করপোরেট (যারা এদের সার্ভিস নেয় তারা এদের ঘৃণা করে। কারণ? ওরা জানে এই ‘কাকতাড়ুয়া’গুলো যা কিছু করে, কেবল বেতন ও ক্যারিয়ারে জন্য করে। এদের হাসি, ভদ্রতা, ধন্যবাদ জানানো পুরোটাই কৃত্রিম! এরা যেন এক একটি দম দেয়া পুতুল! মানুষরূপী এই যন্ত্রগুলোকে-কেই-বা ভালোবাসবে)!

সাধারণভাবে যিনি প্রতি দিন সকাল নয়টা-দশটায় ঘুম থেকে ওঠেন, বারোটায় অফিসে যান, সন্ধে ছটা অব্দি আড্ডা মারেন, রাত বারোটা পর্যন্ত মাস্তি করে বাড়ি ফেরেন, কাজ করেন পরের দিন, তিনিই করপোরেট। করপোরেটরা পানির বদলে কোক পান করেন, ধর্মগ্রন্থের বদলে ম্যানেজমেন্ট, সরকারি বুরোক্র্যাসিকে তুলাধুনা আর ম্যানেজ করার নামে সোজা কাজকে জটিল করেন। তিনি সারা দিন ফেসবুক-টুইটার-ম্যাসেঞ্জার-ইমো-ভাইবারে নাকানিচোবানি, সন্ধ্যায় ক্লায়েন্টের কাছে ঝাঁটাপেটা, রাতে বিয়ারে হাবুডুবু খান আর বৌয়ের কাছে দিবারাত্র মুখঝামটা। অফিসে গরমকালে টাই পরেন, ঘামতে-ঘামতে সুট, শোবার ঘরে জুতো পরেন, মল-এ হাফপ্যান্ট। গুলিয়ে গেলে ‘ইউ নো’ বলেন, আনন্দকে ওয়াও, মলত্যাগের স্থানকে রেস্টরুম বলেন, দুঃখকে শিট্। কনফিডেন্স নিয়ে সুইট ইংলিশ বলেন, ক্রেডিট কার্ড নিয়ে শপিংমলে যান, লোন নিয়ে গাড়ি কেনেন, ইনক্রিমেন্ট দিয়ে ল্যাপটপ, আইফোন। তাঁরা মুখ খুললেই ম্যানেজমেন্টের বাণী বেরিয়ে আসে, স্মার্টফোন খুললেই শেয়ার-বাজারের গোপন খবর!

করপোরেটরা নানা ধরনের। তাঁরা ছোটবেলায় ম্যানেজার থাকেন, বড় হলে ডিরেক্টর, চুল পাকলে ভিপি হন, ল্যাজ গজালে সিইও। মিড-লেভেল ম্যানেজারে কোম্পানি ভুঁড়িওয়ালা হয়, ডিরেক্টরে মাথাভারী, ভিপিতে পুচ্ছধারী, সিইও-তে বৃহল্লাঙ্গুল। ম্যানেজাররা সর্ব ক্ষণ ভুঁড়ি কমানোর ভয়ে থাকেন, কোলেস্টেরলের ভয়ে তেলছাড়া তেলেভাজা খান, হার্ট অ্যাটাকের ভয়ে জলছাড়া সরবিট্রেট। আর ল্যাজবিশিষ্টরা স্লিম-ট্রিম-ফিট। তাঁদের হাতিশালে হাতি থাকে, হেলিপ্যাডে ঘোড়া, জেটিতে প্রাইভেট টাইটানিক। তাঁরা ডায়বেটিস সামলাতে মর্নিং ওয়াক করেন, ওবেসিটি সামলাতে জিম। কাজ সামলাতে সুন্দরী সেক্রেটারি রাখেন, আর স্ট্রেস সামলাতে ইয়োগা ইনস্ট্রাক্টর। নিজের প্যাশনে গল্ফ খেলেন, কোম্পানির পয়সায় শেয়ার নিয়ে লোপালুপি। লস হলে গাদা লোকের চাকরি খান, প্রফিট হলে স্কচ। বিজনেস ডিলের নামে পাঁচতারায় যান, বিজনেস টুরে মালয়েশিয়া-সিঙ্গাপুর, স্ট্রেস সামলাতে ট্রেডমিলে যান, ক্রিসমাসে বাহামা ক্রুজ। তাঁরা সুখের দিনে বোনাস পান, মন্দার দিনে মোটা পেনশন। তেজির দিনে লালফিতের মুণ্ডপাত ও ফ্রি-মার্কেটের জয়ধ্বনি করেন, সরকারকে সাদা-হাতি, ভর্তুকিকে মধ্যযুগীয়, প্রতিযোগিতাকে এফিশিয়েন্ট এবং কর্মসংস্কৃতিকে ইন থিং বলেন, আর কোম্পানি লালবাতি জ্বাললে দেশ ও দশের কল্যাণার্থে সরকারের কাছেই হাত পাতেন। এই বহুমুখী কৌশলের সুবাদেই রিসেশন এঁদের মারতে পারে না, লে-অফ পোড়াতে পারে না, বিবর্তনকে কাঁচকলা দেখিয়ে এঁরা নানা কায়দায় টিকে থাকেন। তাঁরা পাঁকে পড়লে, সরকারও তাঁদের টাকা উপুড় করে দেয়। তারা ঋণখেলাপি হলেও সম্মানিত। লাইসেন্স-রাজের পিন্ডি চটকে ও মুক্তবাজারের জয়পতাকা তুলে ধরে পাবলিকের পয়সায় করপোরেটরা তখন দেশোদ্ধার করে। এই অভূতপূর্ব কর্মসংস্কৃতির জন্যই তাঁরা পড়শির ঈর্ষা হলেও আমাদের গর্ব।
এরাই ব্যবসায়ী, এরাই অর্থনীতির নিয়ামক, এরাই ঈশ্বর। আসুন আমরা সমস্বরে বলি, জয়, করপোরেটের জয়, জয় করপোরেট সংস্কৃতির জয়!

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)