ব্রিটিশরা আর সবার চেয়ে আলাদা। তাদের আভিজাত্য তুলনাহীন। অনেক ব্রিটিশই এটা মনে করেন। তাদের এই মনে করাটা যে অলীক নয়, তারই প্রমাণ পাওয়া গেল গণভোটের ফলাফলে। ইউরোপিয় ইউনিয়নে থাকছে না ব্রিটেন। গণভোটের রায়ে ৫২ শতাংশ ভোটার ইইউতে থাকার বিপক্ষে ভোট দেন। ৪৮ শতাংশ ভোটার পক্ষে ভোট দেন। এর ফলে ইউরোপিয় ইউনিয়নের সাথে ব্রিটেনের ৪৩ বছরের বন্ধন ছিন্ন হচ্ছে।
ইউরোপের ২৮টি দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জোট ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) যুক্তরাজ্য থাকবে কি থাকবে না—তা নিয়ে গত বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত গণভোটের রায় বের হওয়ার পর পরই ব্রিটেনের মুদ্রাবাজারেও প্রভাব পড়েছে। পাউন্ডের দাম কমে গেছে।
প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন ২০১৫ সালে পুনরায় নির্বাচিত হওয়ার আগে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তিনি নির্বাচিত হলে এ বিষয়টি নিয়ে একটি গণভোটের আয়োজন করবেন। কারণ ২০০৮ সালে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হলে তখনই ইইউ থেকে বের হয়ে যাওয়ার বিষয়টি সামনে চলে আসতে থাকে। ২০১২ সালে ক্যামরনের দলের এমপিরাই তাকে চাপ দিতে থাকেন একটি গণভোটের। সে কারণেই ক্যামেরন ২০১৩ সালে ঘোষণা দেন তিনি পুনর্নির্বাচিত হলে এ গণভোট করবেন।
উল্লেখ্য, ১৯৭৫ সালের ৫ জুন ইউরোপিয়ান ইকোনোমিক কমিউনিটিতে যোগ দেয়ার প্রশ্নে গণভোট অনুষ্ঠিত হয় ব্রিটেনে। ওই গণভোটে ৬৭ শতাংশ নাগরিক ইইসিতে থাকার পক্ষে ভোট দেয়। মূলত ১৯৭৩ সালে এ জোটে যোগ দেয় তারা। ২০১৬ সালের ২৩ জুনের গণভোট একই ইস্যুতে দ্বিতীয়বার।
ব্রিটেনের ইতিহাসে কোনো ইস্যুতে গণভোটের আয়োজন বিরল ঘটনা। দেশটিতে দ্বিতীয় গণভোট হয় ২০১১ সালে, বিকল্প ভোটিং ব্যবস্থা নিয়ে।
এই ভোটের নাম দেয়া হয় বেক্সিট ভোট। ‘ব্রেক্সিট’-এর অর্থ, ব্রিটেনের এক্সিট অর্থাৎ ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে আসা৷ দেখা গেছে, মধ্যবয়সি ও তরুণ প্রজন্ম প্রস্তাবের বিপক্ষে। অন্যদিকে, প্রবীণদের অধিকাংশই চেয়েছেন ব্রিটেনের স্বাতন্ত্র্য।
সাম্প্রতিক সময়ের অন্য যেকোন নির্বাচনের চেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ গণভোটে অংশ নিয়েছেন। কারণ এই গণভোটটিকে ব্রিটেনের রাজনৈতিক ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল এক সিদ্ধান্ত হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
চরম উত্তেজনার মধ্যে দিয়ে এই গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে। ব্রিটেনের নামী-দামী মানুষেরাও এই গণভোটকে ঘিরে দুই শিবিরে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথও ইউরোপিয় ইউনিয়ন ছেড়ে বেরিয়ে আসার পক্ষে। আবার কোনও মানুষ একা দ্বীপের মতো বাঁচতে পারে না বলে মন্তব্য করে ইউরোপিয় ইউনিয়নে থেকে যাওয়ার পক্ষেই মত দিয়েছেন জেমস বন্ডের ভূমিকায় অভিনয় করা ড্যানিয়েল ক্রেগ।
লন্ডনের প্রাক্তন মেয়র বরিস জনসনের দাবি, বৃহস্পতিবার ব্রিটেনের ‘স্বাধীনতা দিবস’৷ তাঁকে আক্রমণ করে ‘ব্রেক্সিট’ সমর্থকদের নাৎসি বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন। লেবার পার্টির এমপি ও প্রাক্তন মন্ত্রীকে টুইটারে ছেলে-মেয়ে এবং নাতি-নাতনিদের খুনের হুমকি পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে।
সেই পরিস্থিতিতে শেষ মুহূর্তেও দেশের মানুষের কাছে ব্রেক্সিট-এর বিপক্ষে ভোট দেওয়ার আবেদন জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন। তাঁর আবেদনের পক্ষে খোলা চিঠি লিখে সমর্থন জানিয়েছেন প্রায় ১২০০ শিল্পপতি ও শতাধিক নামী সংস্থা। তাতে তারা হুঁশিয়ারি দিয়েছে, ইইউ থেকে বেরিয়ে গেলে ব্রিটেনের অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে৷ আবার ছোট শিল্প সংস্থাগুলি অনেকে বেরিয়ে যাওয়ার পক্ষে।
নিরাপত্তা, সন্ত্রাসদমন ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইউরোপিয় ইউনিয়নে থাকলেই ব্রিটেন লাভবান হবে বলে সওয়াল করেছেন ক্যামেরন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ওবামা বারবার আবেদন করেছেন, ভোটাররা যেন ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে যাওয়ার রায় না দেন। তিনি বলেছেন, এতে ব্রিটেন অন্যদের চেয়ে পেছনে পড়ে যাবে। এ সিদ্ধান্ত হঠকারিতা বলেও তিনি মন্তব্য করেছেন।
কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ ব্রিটিশ জনগণ ‘নিজের বুদ্ধিকে শ্রেষ্ঠ বিবেচনা’ করে ইইউ-থেকে বের হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। গণভোটের এই ফলে ইউরোপের ছবিটাই পাল্টে যেতে পারে। বদলে যেতে পারে মহাদেশের আর্থিক ও রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ। এই আবহে ইতালি, ডেনমার্ক, ফ্রান্স ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকা আরও কয়েকটি দেশের জাতীয়তাবাদী দলগুলি গণভোটের দাবি তুলেছে। এই দেশগুলিও যদি ব্রিটেনের পথ অনুসরণ করে তাহলে ইউরোপের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক চালচিত্র অনেকটাই বদলে যাবে।
ঐতিহাসিক এই সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রথম থেকেই দ্বিধাবিভক্ত ব্রিটেন। লড়াই হয়েছে হাড্ডাহাড্ডি। শেষ পর্যন্ত অল্প সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ব্রিটিশরা ইইউ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পক্ষে রায় ঘোষণা করল। ব্রিটেনই প্রথম দেশ, যারা ইইউ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে প্রথম সিদ্ধান্ত নিল। চাকরি-বাকরিসহ নানা ক্ষেত্রে ভবিষ্যৎ সুবিধা বিবেচনায় বাংলাদেশ ভারতসহ তৃতীয় বিশ্বের অভিবাসীরা ইইউ-তে ব্রিটেনকে রেখে দেওয়ার পক্ষে ছিলেন। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এমপি টিউলিপ সিদ্দিকি এবং রোশেনারা আলি এ ব্যাপারে প্রচারণাও চালিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশদের ‘স্বাতন্ত্র্যের আভিজাত্যে’ই জয়ী হলো!
ইউরোপিয় ইউনিয়ন থেকে সরে আসার এই ব্রিটিশ সিদ্ধান্ত অভিবাসন, অর্থনৈতিক সংকট এবং বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদের হুমকিতে থাকা ইউরোপের জন্য নিঃসন্দেহে একটি অশনি সংকেত। শুধু তাই নয় তাতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সৃষ্টি হওয়া ঐক্যবদ্ধ ইউরোপের স্বপ্নে চিড় ধরবে। যুক্তরাজ্য ইইউ ছাড়ার এই সিদ্ধান্তের পর কোনো সংকটে পড়লে তা থেকে উত্তরণে কোনো অভিন্ন সমাধানে পৌঁছাতে বেগ পেতে হবে।
ইউরোপের আরও দুই বড় শক্তি ফ্রান্স ও জার্মানি এই গণভোটের পর ‘ইউরোপব্যাপী উদ্যোগের’ ঘোষণা দিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে যুক্তরাজ্য ইইউ ত্যাগ করার পর ইইউভুক্ত অন্য দেশে কাজ করতে গেলে যুক্তরাজ্যের নাগরিকদের কি বিশেষ অনুমতির দরকার হবে? এর উত্তর হলো, বের হয়ে যাওয়ার পর ইইউর সঙ্গে যুক্তরাজ্যের নতুন চুক্তির ওপরই তা নির্ভর করছে। যদি একক বাজারব্যবস্থা টিকে থাকে, তবে নিশ্চিতভাবেই যুক্তরাজ্যের নাগরিকেরা অন্য দেশগুলোতে সরাসরি যেতে পারবেন।
আবার বিপরীত দিকে ইইউভুক্ত অন্য দেশের নাগরিকেরাও কাজ করতে যুক্তরাজ্যে আসতে পারবেন কি না, তাও নির্ভর করবে সম্ভাব্য চুক্তির পর। তবে বিশ্লেষকদের মতে, এখনি বড় বেশি দুশ্চিন্তার কিছু নেই। কারণ যুক্তরাজ্যের ইইউ ত্যাগের সিদ্ধান্ত কার্যকর হতে অন্তত দুই বছর সময় লাগবে। এ সময়ে যুক্তরাজ্য ইইউর নীতিমালা ও আইন মেনে চলবে। তবে এ জোটের কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় থাকবে না দেশটি।
এ গণভোটের ফলে আগামী দিনে ব্রিটেনের রাজনীতি ও সমাজে কী প্রভাব পড়বে, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কীভাবে পরিস্থিতি সামল দেবেন-সেটা জানতে আমাদের আরও অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু এই নির্বাচনে ব্রিটিশরা আবারও প্রমাণ করল-জনগণই সব ক্ষমতার উৎস। জনগণের ওপর কারও হাত নেই। এই নির্বাচনে আপাতত জয়ী হলো জনগণের ইচ্ছে, গণতন্ত্র আর মতপ্রকাশের স্বাধীনতা!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল
আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)