জয়া আহসান। তাকে চিনি দূর থেকে। দেখেছি টেলিভিশনে, সিনেমায়। অভিনয় করেন। গুণী অভিনেত্রী হিসেবে ক্রমাগত নিজেকে ছাড়িয়ে যাচ্ছেন- এমনটাই শুনছি। বছর দুই বা তিন হবে। জয়ার একটা লেখা পেলাম প্রথম আলোর ঈদ সংখ্যায়। পড়ে দেখলাম, জয়া লেখেনও খুব ভালো। মুখস্থ কথা বলেন না। চিন্তা করেন খুব ভিতর থেকে। অনুভবের খুব গভীর থেকে কথা বলেন তিনি। ওই লেখাপড়ার পর থেকেই জয়ার ব্যাপারে আমার আগ্রহ আরও বাড়ে। বাড়ে প্রত্যাশাও।
এইরকম সময়ে তার একটা নতুন খবর পেলাম, জয়া সরকারি অনুদান পেয়েছেন। চলচ্চিত্র বানাবেন। প্রযোজক তিনি।
জয়া দেবী বানাবেন। দেবী হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস। পড়িনি। তবে ভেবে রাখলাম, দেখব ছবিটা। মুক্তির আগে মাসখানেক ধরে বিরতিহীনভাবে জয়া দেবী-র খবর দিচ্ছিলেন। ভেবে রাখলাম, দেখবো।
১৯ অক্টোবর, ২০১৮ মুক্তি পেল জয়ার দেবী। দ্বিতীয় দিনেই দেখে ফেললাম। দেখার পর থেকে ভাবছি দেবী নিয়ে। এখন লিখতে বসেছি।
দেবীর রানু খুব ভাগ্যবান। ওর মানসিক অসুখ। কঠিন অসুখ। একা থাকলে গায়েবী সে কথা শোনে, অশরীরী জনের দেখা পায়। অশরীরীর সাথে কথা বলে। শরীরী জীবনে রানুকে তার স্বামী ভালোবাসে, পাগল তকমা দিয়ে দুরে সরায়নি। রানু এতিম, রানু মানসিক রোগী। কিন্তু রানু ভালোবাসা পেয়ে এবং দিয়ে সুন্দর সংসার জীবন কাটায়। ব্যস্ত শহরে সংসারের বাজার করে। ঠিকঠাক গুছিয়ে সংসার করে। আর ক্রমাগত তার লড়াই চলে দুরারোগ্য মনের অসুখটার সাথে। অশরীরী জনের কথায় ব্যতিব্যস্ত হওয়াটাই দেবীকে দেবী হয়ে উঠতে সহায় হয়েছে।
দেবী চলচ্চিত্র হিসেবে সুন্দর। প্রেক্ষাগৃহে পুরোটা সময় মনোযোগ ধরে রেখেছে। মনে গেঁথে আছে সুচিন্তিত পোশাক ভাবনা, সুন্দর সেট, চোখে না পড়া অসাধারণ মেকাপ, সুবিন্যাস্ত কম্পোজিশন, চোখে না-পড়ার মতো করে করা সম্পাদনা- সব, সবই তো ভালো, অনেক ভালো। তবুও কেন মনের মধ্যে কিন্তু কিন্তু একটা অস্বস্তি কাজ করছে?
উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেখি ওটা লুকিয়ে আছে চিত্রনাট্যে, রানু চরিত্রের পরিকল্পনায়। রানুর মানসিক অসুখ। এই অসুখ বিষয়ে বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা আমরা পেয়েছি বিজ্ঞানীদের কাছ থেকে। মনোচিকিৎসাবিজ্ঞানে এই অসুখটার নাম সিজোফ্রেনিয়া। রানুর চরিত্র নির্মাণে সিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণগুলোকেই খুঁটি হিসেবে চিত্রনাট্যকার ব্যবহার করেছেন। দেবীর পর্দায় তাই সিজোফ্রেনিয়ায় ভোগা রানুই কলকাঠি নেড়েছে। রানুকে ঘিরে দেবী চলচ্চিত্রের সিকোয়েন্সগুলো পর পর এগোয়, গল্পটাকে পরিণতির দিকে নিয়ে যায়, গল্পের মানুষগুলোর জীবন চেনায়। দেবীর পর্দায় আমরা ২০১৮ সালে বাংলাদেশের নগর ঢাকায় মধ্যবিত্তের জীবনের কিছুটা দেখি। এটা দেখাতে দর্শকের মনোযোগ ধরে রাখতে পেরেছেন দেবী-এর নির্মাণ কুশলীরা।
কিন্তু, আমার কিন্তু ওই ওইখানে- যেখানে রানুর চরিত্র চিত্রায়নে ব্যাখ্যাতীত কিছু বিষয়কে তারা ভর করেন। রানু অবলীলায় ভবিষ্যতে ঘটবে এমন কোনো কোনো ঘটনা ঠিকঠাক অনুমান করতে পারে। কিছু গোপন কথা অবলীলায় বলতে পারে। এমনকি অন্য জায়গায় ঘটছে এমন ঘটনাও রানু নিজের শোবার ঘরে বসে অবিকল দেখতে পায়। এইসব ব্যাখ্যাতীত ঘটনা বেশ ঘটা করে দেবীতে জায়গা পায়। দেবী চলচ্চিত্রকে পরিণতির দিকে নিয়ে যায়। এই রহস্যময়তা সিনেমার কাটতি বাড়াতে প্রযোজককে সাহায্য করবে। কিন্তু এই একুশ শতকে বিজ্ঞানে ব্যাখ্যা করা যায় না এমনকিছুকে চিত্রনাট্যে এতবেশি প্রভাবক হয়ে উঠাকে মেনে নিতে অস্বস্তি বোধ করছি। দেবীর এই অকারণ অবৈজ্ঞানিক রহস্যময়তা আমাকে পরিচ্ছন্ন, রুচিশীল বিনোদনের চলচ্চিত্র দেবীতে পুরোপুরি মগ্ন হতে দেয় না।
কিন্তু দেবীর শেষ না দেখে মিলনায়তন থেকে বেরোই না। বেরোই না বলেই দেখতে পাই চিত্রগ্রাহক খসরু দেবীতে আরো নিপুণ হয়েছেন। প্রপস এবং চরিত্রের অবস্থান ও মুভমেন্ট, দু’চার সময় ক্যামেরারও মুভমেন্ট- সবমিলিয়ে রঙের সুসমন্বিত বিন্যাস চোখ থেকে আমার মনের ভিতরে দেবীকে নিয়ে গেছে খসরুর মুন্সিয়ানা। তবে শট থেকে শটে বিউটিফিকেশনের মোহে পড়েছেন কি তিনি? না হলে একই সিকোয়েন্সে আলোর ধারাবাহিকতা রক্ষায় তো খসরুর ভুল হওয়ার কথা নয়। খুব বেশি হয়নি, তবে ওটাও না হলে দর্শক হিসেবে আরো আনন্দ হতো আমার। দু/তিনটি জায়গায় লঙ শট নিজের অজান্তেই প্রত্যাশা করেছি। পাইনি। পাইনি বলে চরিত্র ও ঘটনাগুলো পরিপার্শ্বের অনিবার্য অংশ না হয়ে একটু বিচ্ছিন্ন হয়। এটা এক রকমের আবদ্ধ অনুভব দেয়। ‘আবদ্ধ’ অনুভব দেবী দৃশ্যায়নের বৈশিষ্ট্য হতে পারত। কিন্তু এর নির্মাণকুশলীরা সেটা চাননি। আবার লঙ শট ব্যবহারে কিঞ্চিত কার্পণ্য করেছেন। অল্প কয়েকটি লঙ শটের ব্যবহার দেবীর মানুষ ও ঘটনাকে আরো ব্যাপ্ত গভীর করে তুলতো বোধহয়।
কোনো নৈঃশব্দ নেই- ‘দেবী’ খুব লাউড। কেন? অথচ আমার কান ‘দেবী’কে আরও একটু নীরব চাইছিল।
দেবীতে অনেক চরিত্র নেই, যারা আছে খুব ঠিকঠাক মতন করে আছে। কোনো চরিত্রকে বাড়তি, অপ্রয়োজনীয় লাগেনি। সবগুলো চরিত্র ‘দেবী’র রানুকে বুঝতে, জানতে আমাদের সহায় হয়েছে। চরিত্রাভিনয়ে কাউকেই মনে হয়নি- অভিনয় করছেন। চলচ্চিত্রের অভিনয় যেমন হওয়া দরকার তেমনটাই করেছেন সবাই। তবে রানুরূপী জয়া ব্যতিক্রম। তিনি যেনবা একটু বেশি অভিনয় করেছেন। অনেককাল ধরে জয়া আহসানের অভিনয় দেখছি। ঢাকা কিংবা কলকাতা- যে ছবিতেই তিনি কাজ করেন সেটা আমি দেখি। কারণ, জয়া ভালো ছবির ভালো অভিনেত্রী হিসেবেই। দেবীতে গুণীমানুষ জয়াকে রানুরূপে দেখে মনে হলো- এই অভিনয় তিনি অনেকদিন ধরে করছেন। জিরো ফ্যাট ফিগারের জয়ার মুখটা ক্যামেরায় ভীষণ সুন্দর লাগে। ভরাট সুন্দর এই মুখে জয়ার অভিব্যক্তিগুলো খুব কি বেশি চেনা হয়ে গেল আমার?
নিত্য নতুন চ্যালেঞ্জ জয় করতে চান যে জয়া আহসান- তিনি কি ভাববেন ব্যাপারটা?
প্রযোজক জয়া আহসান ও পরিচালক অনম বিশ্বাস, যার কাজ দেখিনি আগে- আপনাদের দু’জনের জন্য অভিনন্দন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)