যে চামড়া শিল্পে ভর করে এক সময় রপ্তানিতে জৌলুশের দেখা পেয়েছিল বাংলাদেশ, গত ৮ বছর ধরে তা কমতে কমতে একেবারে শূন্যের কোঠায় ঠেকেছে। এই কয়েক বছরে চামড়ার দাম কমেছে ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ।
দেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাকের পরই অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ খাত হিসেবে বিবেচিত চামড়া শিল্পের কাঁচামালের দাম অবিশ্বাস্য রকম কমে যাওয়ায় লাখ লাখ পশুর চামড়া রাস্তাঘাটে ফেলে দিতে হয়েছে।
এই খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার চাহিদা একেবারেই কমে গেছে। ফলে দাম তলানিতে এসে ঠেকছে। এর মধ্যে আবার ‘মরার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে এসেছে করোনাভাইরাস। এ কারণে সরকার নির্ধারিত দামের চেয়েও অনেক কম দামে চামড়া বিক্রিতে বাধ্য হয়েছে বিক্রেতারা।
তবে সংশ্লিষ্টদের দাবি, প্রয়োজনীয় আইন এবং কিছু নতুন উদ্যোগ নেয়া হলে ২/১ বছরের মধ্যে চামড়া শিল্প তার হারানো জৌলুশ ফিরে পাবে।
হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব টিপু সুলতান চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সংকটের কারণে চামড়ার দামে এমন বিপর্যয় ঘটেছে। দেশেও চামড়ার চাহিদা কমেছে। ফলে দিন দিন কাঁচা চামড়ার দাম কমে যাচ্ছে। গত ৮ বছরে প্রায় ৬৫ থেকে ৭৫ শতাংশ দাম কমেছে। এ কারণে হাজার হাজার পিচ চামড় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
৮ বছর আগে ২০১৩ সালে রাজধানীতে যেখানে লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দাম ছিল প্রতি বর্গফুট ৮৫ থেকে ৯০ টাকা, সেখানে এ বছর এই চামড়ার দাম ৩৫ থেকে ৪০ টাকায় নেমে এসেছে। আর ঢাকার বাইরে ধরা হয় প্রতি বর্গফুট ২৮ থেকে ৩২ টাকা।
অর্থাৎ তিন ভাগের দুই ভাগ দামই কমে গেছে। একই সময় খাসির চামড়ার দাম ছিল প্রতি বর্গফুট ৫০ থেকে ৫৫ টাকা। প্রায় ৪ ভাগ কমে এ বছরে এর দাম নেমে এসেছে ১৩ থেকে ১৫ টাকায়।
সিন্ডিকেটের কারণে চামড়ার দাম কমছে বলে যে অভিযোগ রয়েছে সেই বিষয়ে টিপু সুলতান বলেন, সিন্ডিকেট করে দাম কমানো হয় বলে অনেকেই অভিযোগ করে থাকেন। কিন্তু এটি সঠিক নয়। কারণ যেখানে চামড়া কেনার অর্থের সংকট সেখানে সিন্ডিকেট হয় কিভাবে?
‘‘গত ২/৩ বছর ধরে চামড়ার দাম সর্বনিম্ন পর্যায়ে চলে এসেছে। এর চেয়ে কমার আর সুযোগ নেই। তবে এই শিল্পের পরিবেশগত উন্নয়ন ও প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া হলে অচিরেই চামড়া খাত তার হারানো জৌলুশ ফিরে পাবে। কারণ তখন আন্তর্জাতিক ক্রেতারা ফিরে আসবে।’’
বাংলাদেশের ট্যানারিগুলোর পরিবেশ দূষণের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়া রপ্তানি কমে গেছে জানিয়ে এই কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ী বলেন, সাভারে ট্যানারি শিল্প স্থানান্তর, ট্যানারিপল্লীতে সিইটিপি সমস্যা, অবকাঠামোগত সমস্যা ও সঠিক পরিকল্পনার অভাবসহ নানা কারণে চামড়া শিল্পের উন্নয়ন হচ্ছে না।
“চামড়া শিল্পের উন্নয়নে একটা যুগোপযোগী সঠিক নীতিমালা অত্যাবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ খাতের উন্নয়নে কিছু উদ্যোগ নেয়া হলে চামড়া শিল্পে বিপ্লব ঘটবে। যা হবে বর্তমান সরকারের অনেক বড় অর্জন। এ বিষয়ে সরকারকে সব ধরনের সহযোগিতা করতে ব্যবসায়ীরা প্রস্তুত।”
তৈরি পোশাকের পর চামড়াই দ্বিতীয় বড় রপ্তানি খাত উল্লেখ করে তিনি বলেন, সম্ভাবনাময় এ খাতের সুনির্দিষ্ট নীতিমালার অভাবে রপ্তানিও কমছে। বিশ্বে ২৪০ বিলিয়ন ডলারের চামড়া শিল্পের বাজার রয়েছে। কিন্তু এই বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি খুবই কম। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাতীয় পণ্যের রপ্তানি আয় ছিল প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু ২০১৯-২০ অর্থবছরে এর পরিমাণ কমে দাঁড়িয়েছে ৮০ কোটি ডলারে।
চামড়ার দাম কমে যাওয়ায় চামড়াজাতীয় পণ্যের দাম অনেক কমে যাওয়া উচিত বলে মনে করেন ক্রেতারা।
এ প্রসঙ্গে টিপু সুলতান বলেন, এখনো চামড়ার জুতার দাম ৬/৭ হাজার টাকা। ভাল মানের সু’র দাম ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা। কিন্তু বিদেশ থেকে জুতা, ব্যাগ অর্থাৎ চামড়াজাতীয় পণ্য তৈরি করার কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। তাই উৎপাদন ব্যয় বেশি লাগে। তবুও এই উচ্চ দাম যৌক্তিক নয় বলে মনে করি।
গত বছর বাংলাদেশে সব মিলিয়ে প্রায় ১ কোটি ১৫ লাখ গরু, ছাগল, মহিষ কোরবানি হয়েছে৷ এবার করোনার কারণে তার চেয়ে ৩৫ থেকে ৪০ ভাগ কম হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে৷ তারপরও চামড়ার চাহিদা নেই৷
কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির মহাসচিব বলেন, আমাদের হাতে টাকা ছিল না, তাই তেমন কিনতে পারিনি৷ চাহিদা কম থাকায় চামড়ার দাম এতটা কমে গেছে৷
এ বছর চামড়ার ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে সরকার মনিটরিং সেল গঠন ও কাঁচা চামড়া রপ্তানির সুযোগ দিয়েছে। তারপরও বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের মত এবারও দাম না পাওয়ায় হাজার হাজার পিচ চামড়া নষ্ট হয়ে গেছে।
সাধারণত সারা বছরের প্রয়োজনীয় চামড়ার ৬০ শতাংশই সংগ্রহ করা হয় কোরবানির সময়। কিন্তু গত বছরের ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ চামড়া এখনো অবিক্রীত অবস্থায় রয়ে গেছে বলে জানান এ খাতের ব্যবসায়ীরা।
চামড়ার দাম কেন কমছে? জানতে চাইলে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. সাখাওয়াত উল্লাহ চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ীদের বার বার বলা হয়েছে কোরবানির পরেরদিন চামড়া আনলে তা নষ্ট হয়ে যায়। তবুও তারা এনেছে। অনেকেই চামড়ায় লবণ দিতে পারেনি। তাই নষ্ট হয়ে গেছে অনেক চামড়া।
তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং সেল গঠনের কারণে গতবারের চেয়ে চামড়া কম নষ্ট হয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
এই ট্যানারি মালিক আরও বলেন, গত বছরের চামড়ার ৬০ ভাগ এখনো বিক্রি করতে পারিনি৷ চামড়ার প্রধান বাজার চীন৷ করোনার শুরুতে তারা চামড়া নেয়া বন্ধ করে দেয়৷ দেশটি প্রায় ৩শ কন্টিনেয়ার চামড়া রপ্তানির আদেশ বাতিল করেছে। নতুন কোনো অর্ডার নেই বললেই চলে। যদিও কোনো অর্ডার আসে দাম বলে অর্ধেক। এই দামে রপ্তানি করলে কেমিক্যালের খরচও উঠে না।
পানির দরে চামড়া বিক্রি হলেও চামড়াজাতীয় পণ্যের দাম আকাশচুম্বী কেন- এমন প্রশ্নের জবাবে সাখাওয়াত হোসেন বলেন, জুতার শোরুমে বিক্রি নেই বললেই চলে। কোনো কোনো শোরুমে গত ৫/৬ মাসে ২/৪ জোড়া জুতা বিক্রি হয়েছে। যা খুবই কম। কিন্তু বিক্রয়কর্মীর বেতন, শোরুম ভাড়া, বিদ্যুৎবিলসহ অন্যান্য খরচ বহন করতে হয়েছে।
জুতার দাম অনেক কমে গেছে দাবি করে তিনি বলেন, আগের চেয়ে জুতার দাম বর্তমানে অনেক কম। এখন দুই থেকে আড়াই হাজার টাকায় ভাল মানের সু জুতা পাওয়া যায়।
এছাড়াও আর্টিফিশিয়াল চামড়ার কারণে মূল চামড়ার দাম কমেছে। চীনারা আর্টিফিশিয়াল চামড়া দিয়ে নানা ধরণের পণ্য তৈরি করে। যা তুলনামূলক অনেক কম দামে পাওয়া যায়। এ কারণে অরজিনাল চামড়ার পণ্যের দাম কমছে বলেও জানান তিনি।