মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানীর স্বীকৃতি ঘোষণা করলে উত্তাল হয়ে উঠে প্যালেস্টাইন। উত্তাপ ছড়ায় বিশ্বেও। প্রতিবাদ-প্রতিরোধে মুখর ফিলিস্তিনের তিনটি ছবি যেন হয়ে উঠেছে প্রতিরোধের প্রতীক।
প্যালেস্টাইনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রিয়াদ আল-মালকি সাম্প্রতিক সেই তিন ছবির প্রশংসা করেছেন। এগুলোকে প্যালেস্টাইন-ইসরায়েল সংগ্রামের প্রতীক বলে অভিহিত করেছেন তিনি।
বৃহস্পতিবার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের জরুরি বৈঠকে জেরুজালেম বিষয়ক মার্কিন সিদ্ধান্তের বিষয়ে বক্তব্যে আল-মালকি বলেন, নিজেদের ভূখণ্ডে আমাদের মানুষদের দৃঢ়তা কিংবদন্তীস্বরূপ। মুক্তি ও অখণ্ডতার জন্য তাদের আকাঙ্ক্ষা বৈধ। নিরাপত্তা, সন্তানদের আরও ভালো জীবনের জন্য তাদের প্রত্যাশা প্রতিদিনই নতুনতর হচ্ছে। কিন্তু ইসরাইলি হামলা ছিনিয়ে নিচ্ছে তাদের স্বপ্ন, ভবিষ্যত।
ফিলিস্তিনিদের তিনটি ছবির কথা উল্লেখ করেন তিনি। ছবিগুলো তোলা হয় অধিকৃত পশ্চিম তীর ও গাজায়। ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছিল তারা।
সম্প্রতি ট্রাম্প জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানীর স্বীকৃতি দেন। যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস তেল আবিব্ থেকে জেরুজালেম সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত জানান তিনি। এর পরিপ্রেক্ষিতে সাম্প্রতিক এই বিক্ষোভে এখন পর্যন্ত ১০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আটক করা হয়েছে ৫ শতাধিক ব্যক্তিকে।
সেই ছবিগুলোতে প্রকাশ হয়েছে: এক নিরস্ত্র শিশুকে ইসরাইলি বাহিনীর এক ব্যাটালিয়ন সেনার ঘিরে রাখা, গাজায় স্নাইপারের গুলিতে নিহত একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি এবং একজন সাহসী কিশোরীকে তার বাড়ি থেকে অপহরণের কথা।
নতুন প্রতীকি ছবি
জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী ঘোষনা করে ট্রাম্পের ঘোষণার পর পেরিয়েছে তিন সপ্তাহ। এরই মধ্যে তিনটি আইকোনিক ছবি বিপুল প্রচার পেয়েছে। ছবিগুলো হেবরন, গাজা এবং রামাল্লার কাছে নবী সালেহ গ্রাম থেকে তোলা। এই ছবির চরিত্রগুলোর দু’জন এখন ইসরাইলি কারাগারে, একজনকে হত্যা করা হয়েছে। এক ইসরাইলি স্নাইপারের গুলিতে সে নিহত হয়।
বিক্ষোভ-প্রতিরোধ ছড়িয়ে পড়ার খুব অল্প সময়ের মধ্যেই প্রথম ছবিটি প্রচার পায়। তা হেবরন থেকে তোলা। সেখানে দেখা যায়, একজন ১৬ বছর বয়সী বালককে কমপক্ষে ২০ জন ইসরাইলি সেনা ঘিরে রেখেছে। ছেলেটির হাতে হ্যান্ডকাফ পড়ানো, চোখ বাঁধা।
ফৌজি আল-জুনাইদি নামের সেই বালকটি এখন পাথর ছোড়ার মামলা মোকাবেলা করছে, বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ার কয়েকদিনের মধ্যেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এর কিছুদিন পরেই আরও একটি ছবি অনলাইনে ছড়িয়ে পড়ে। ইব্রাহিম আবু থুরায়াহ নামের ৩০ বছর বয়সী একজন ফিলিস্তিনি ২০০৮ সালে গাজায় ইসরাইলি হামলার সময় তার দুইটি পা হারিয়েছেন, এবার তার মাথায় গুলি করে হত্যা করা হয়। ডিসেম্বরের ১৫ তারিখ এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। মার্কিন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছিলেন তিনি।
তার সেই আলোচিত ছবিতে দেখা যা, হুইলচেয়ারে বসে ফিলিস্তিনি পতাকা উড়াচ্ছেন তিনি। কার্টুনিস্টরা প্রতিবাদের এই গল্পকে চিত্রায়িত করে। সেখানে ইসরাইলি নৃশংসতা দেখানোর পাশাপাশি আবু থুরায়াহকে দেখা যায়, পাখায় ভর দিয়ে স্বর্গের দিকে উড়ে যাচ্ছেন তিনি।
ব্রাজিলিয়ান কার্টুনিস্ট কার্লোস লাতুফ সামাজিক মাধ্যমে তার ৭১ হাজার অনুসারীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, নিহত এই নতুন ফিলিস্তিনি আইকনের চিত্রটি তার পরিবারের কাছে পৌঁছে দিতে।
এর কিছুদিন পরেই প্রচারে আসে তৃতীয় ছবিটি। ১৬ বছর বয়সী এক ফিলিস্তিনি বালিকাকে ইসরাইলি সেনাদের সামনে দাড়িয়ে প্রতিবাদ করতে দেখা যায়। সেনারা তার বাসা তছনছ করে এবং তার এক কাজিনের মাথায় রাবার বুলেট ছুঁড়ে। এতেই মেয়েটি প্রতিবাদে সোচ্চার হয়। এই ঘটনার ভিডিওতে দেখা যায় ইসরাইলি সেনাদের সে বিদ্রুপ করছে এবং চিৎকার করে তাদের চলে যেতে বলছে, তাদের লাথি মারছে।
এসময় সেই সেনারা অনেকটাই নিষ্ক্রিয় থাকে, খবরটি প্রধান প্রধান গণমাধ্যমের শিরোনাম হলে সেনাদের নীরবতার এই চিত্র ইসরাইলিদের কাছে অপমানকর বলে বিবেচিত হয়।
ইসরাইলে সেনারা দ্রুতই প্রতিক্রিয়া জানায়, আহেদ তামিমিকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেয়, ডিসেম্বরের ১৯ তারিখের শুরুতে তাকে তার বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। আটকাবস্থায় থাকা তামিমিকে দেখতে গেলে তার মাকেও গ্রেপ্তার করা হয়।
এরপর দ্রুতই নায়ক বনে যান তামিমি। কার্টুনে চিত্রায়িত হয় তার ছবি। তাকে নিয়ে ইংলিশ ও আরবি ভাষায়য় শর্ট ভিডিও হয়। জর্দানের প্রিন্স আলি বিন হুসেইন তার টুইটার অ্যাকাউন্টে এই ফিলিস্তিনি কিশোরীর প্রশংসা করেছেন।
প্রথম ও দ্বিতীয় ইন্তিফাদা
এর আগেও এমন কিছু আলোড়ন তোলা চিত্রে ইসরাইলী দখলদারিত্বের অধীনে ফিলিস্তিনি মানুষের দুর্দশার প্রকট রূপ প্রকাশিত হয়েছিল। প্রথম ফিলিস্তিনি ইন্তিফাদার (গণঅভ্যুত্থান) সময় সবচেয়ে শক্তিশালী ছবিটি প্রচারের আলোয় এনেছিলো একটি আমেরিকান টেলিভিশন নেটওয়ার্ক। এর ক্যামেরাম্যান একটি লং লেন্স ব্যবহার করে তা ধারণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সেখানে দেখা যায়, ইসরাইলি সেনারা নাম অজানা একজন ফিলিস্তিনির হাড় ভেঙ্গে দিচ্ছে। লোকটি বিক্ষোভ জানাতে সেনাদের প্রতি পাথর ছুঁড়ে মেরেছিল।
ইসরাইলি ক্যামেরাম্যান মোশে অ্যালপার্ট তখন আমেরিকান চ্যানেল সিবিএস নিউজে কাজ করতেন। ১৯৮৮ সালে তিনি সেই চিত্রটি ধারণ করেন। ইসরায়েলের তৎকালীন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী আইজাক রবিন ফিলিস্তিনিদের বিক্ষোভ প্রতিহত করতে হাড় ভেঙ্গে দেওয়ার নীতি বাস্তবায়ন করেছিলেন। তার এই নির্দেশনাই অনুসরণ করতে দেখা যায় চিত্রের চার ইসরাইলি সেনাকে।
দ্বিতীয় ইন্তিফাদার সময়, ভাইরাল হয়ে উঠা ছবিটিতে আক্রান্ত হয়েছিল মোহাম্মদ আল-দুররাহ নামের ১২ বছর বয়সী একজন ফিলিস্তিনি বালক। গাজায় ইসরাইলি গুলিবর্ষণে সে মারা যায়। ওই ছবিতে দেখা যায়, গোলাগুলি থেকে ছেলেকে বাঁচাতে মরিয়া বাবা, বুকে জড়িয়ে আড়াল করে রেখেছে সন্তানকে। এই ফুটেজটি ধারণ করেছিলেন ফ্রেঞ্চ টিএফ২ স্ট্যাশনের তালাল আবু রাহমেহ।আবু রাহমেহ আল-মনিটর নিউজ ওয়েবসাইটকে জানায়, তার ফ্রেঞ্চ বস ইউটিউবে পুরো র ফুটেজটা পোস্ট করেছে। কারণ অনেকেরই অভিযোগ ছিলো যে ফুটেজটা বানানো।আল-দুররাহ এর এই ফুটেজটি আলোড়ন তুলেছিলো। কারণ ছবিটি মানবিক আবেগ ধারণ করেছিল। তিনি বলেন, ছবিটা বিশ্বকে ও যেই তা দেখেছে, তাকে আলোড়িত করেছিলো। কারণ এখানে ছেলেকে রক্ষায় বাবার ব্যর্থ চেষ্টা, খাঁটি মানবিক আবেগ ফুটিয়ে তুলেছে।