বাংলা ভাষার সবচেয়ে গর্বের দিনে মাতৃভাষা উর্দু হলেও এই গৌরবের সৌরভ ছুঁয়ে যায় নিজেদের আটকে পড়া পাকিস্তানি হিসেবে পরিচয় দেয়া বিহারিদের মনে। কারণ, যে দেশে তাদের ফেরার কথা ছিল সেদেশ তাদের গ্রহণ করছে না। তাই বাস্তবতা মেনে নিয়ে এদেশ-সংস্কৃতি এবং সংস্কৃতির শেকড় ভাষাকে আন্তরিকতার সঙ্গে বরণ করছেন তারা। ৮ ফুটের ছোট্ট ঘরগুলোর ভেতরে তারা এখনো উর্দু বললেও বাইরে বাংলাতেই কথা বলেন স্বাচ্ছন্দ্যে।
৪৭ বছর ধরে পাকিস্তানে ফিরে যাওয়া কিংবা দেশেই নাগরিক সুবিধার আশায় ঢাকার আশেপাশে পুনবার্সিত হওয়ার অপেক্ষায় থাকাদের বড় একটি অংশের বসবাস রাজধানীর জেনেভা ক্যাম্পে।
২১ ফেব্রুয়ারি সকালে এই ক্যাম্পের অলিগলিতে গিয়ে চোখে পড়লো কয়েকটি উর্দু শব্দের সাইনবোর্ড, বাংলা ও ইংরেজি শব্দতো আছেই। চায়ের দোকানে, সেলাই মেশিনের দোকানে কিংবা ছোট ছোট ঘরগুলোর ভেতর নিজেদের মধ্যে উর্দুতে কথা বলছিলেন ক্যাম্পের বাসিন্দারা।
জেনেভা ক্যাম্পের ‘মসজিদ-এ-বেলাল (রাঃ)’ মসজিদের সরু গলি দিয়ে ঢুকে কথা হয় মোহাম্মদ সোহেল, মোহাম্মদ সোলাইমানদের সঙ্গে। পাশাপাশি ঘরে তাদের বসবাস।তারা জানান, বাইরের সমাজের সঙ্গে মিশতে বাংলায় কথা বলতে একটুও অস্বস্তি নেই তাদের মনে বরং ভাষার জন্য জীবন দেয়ার দিনটিকে তারাও শ্রদ্ধা জানান নিজেদের মতো করে।
সোহেল বলেন: আজকের দিনটিকে বাংলা ভাষায় কথা বলা লোকজন,আপনারা গর্বের সঙ্গে উদযাপন করছেন। আমরা ক্যাম্পের বাইরের আর সবার মতো স্বচ্ছল নই, কালো পোশাকে ফুল দিতে যাই না। কিন্তু ক্যাম্পের ভেতরে আমরাও নিজেদের মতো করে স্বল্প পরিসরে দিনটিকে পালন করি।
১৯৭১ সালের পর সম্পূর্ণ উর্দুতে কথা বলা বাবা-মায়ের সন্তানরা এখন উর্দু-বাংলার মিশেলে কথা বলেন। ক্যাম্পের মধ্য বয়সীদের ছেলে-মেয়েরা স্কুলে বাংলা পড়ছে, মিশছে বাংলা বলা সহপাঠীদের সঙ্গে, বাংলাতেই অভ্যস্ত হচ্ছে।মোহাম্মদ সোলাইমান বলেন: আস্তে আস্তে আমাদের ভাষায় পরিবর্তন আসছে। আগে আমাদের বাবা-মা উর্দু বলতো, এখন আমরা চাকুরি-ব্যবসাসহ কর্মসংস্থানের জন্য বাংলা বলি। আমাদের ছেলে-মেয়েরা স্কুলে বাংলা পড়ছে, ২১ ফেব্রুয়ারিতে স্কুলের আয়োজনে যাচ্ছে। আমাদের বাবা-মায়েরা উর্দুতে বলতো, আমরা তাদের কাছে শিখেছি। এখন আমাদের ছেলে-মেয়েরা বাংলাতেই কথা বলছে। ছেলে-মেয়েদের সঙ্গেও বাংলায় কথা বলতে হয়। আমাদের বাবা-চাচারা যা করে গেছে সেটা আলাদা ব্যাপার।
সোহেল,সোলাইমানদের ঘরের একটু দূরে দু’টো পুরি হাতে এক মগ চায়ের অপেক্ষায় দাঁড়িয়েছিলেন ষাটোর্ধ্ব জোহরা। চায়ের দোকানীর সঙ্গে উর্দুতে কথোপকথনে ব্যস্ত জোহরাকে বাংলা ভাষা সম্পর্কে কিছু বলতে বলায়, তিনি বলেন: ঘরে আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে আমরা উর্দু কথা বলি। আগে পাকিস্তান ছিলো, এখন বাংলাদেশে আছি।
‘বাংলা ভাষাতেও আমরা কথা বলতে পারি, ছোট থেকে বাংলাও শিখেছি। আমাদের ছেলে-মেয়ে, তাদের ছেলে-মেয়েদের স্কুলে পাঠিয়েছি, তারা বাংলা পড়ছে। আমরা না চাইলে এটা হতো না।’
পান যোগ্য পানি এবং নাগরিক সুবিধা পেলে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে আপন করে নিতে তারা সম্পূর্ণ প্রস্তুত বলে জানান আটকে পড়া পাকিস্তানিদের সংগঠন ‘স্ট্র্যান্ডেড পাকিস্তানিজ জেনারেল রিপ্যাট্রিয়েশন কমিটির (এসপিজিআরসি) সভাপতি আব্দুল জব্বার খান।
ক্যাম্পে এসপিজিআরসি’র প্রধান কার্যালয়ে চ্যানেল আই অনলাইনকে জব্বার খান বলেন: আমরা প্রধানমন্ত্রীকে বলেছি আমরা যাবো না, আমরা এখানে থাকবো। ওখানে গিয়ে আবার নতুন কোন সংকটে পড়তে আমরা চাই না। আমাদের ছেলে-মেয়ে এখানে বাংলাতে পড়ছে, ওখানে গিয়ে তারা কী করবে? আমার তিন ছেলে দুই মেয়ে মাস্টার্স করেছে, তারা বাংলায় পড়েছে, বাংলাতে লিখেছে। যারা ঢাকাইয়া আছে তারা কোথাকার, কোন ভাষায় কথা বলে? এইদেশে চাকমারা চাকমা ভাষায় বাড়িতে কথা বলে। সবার সঙ্গে কথা বলতে বাংলা বলতে তো কোন আপত্তি নেই।
তাহলে কেন পাকিস্তানে যেতে চেয়েছিলেন? এই প্রশ্নের জবাবে জব্বার বলেন: আমরা কি যেতে চেয়েছিলাম? ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর পরই আমাদের পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেয়ার কথা তুলেছিলেন ড. কামাল হোসেন। বেশ কিছু পরিবারকে পাঠিয়ে দেয়া হলো। যার আত্মীয়রা পাকিস্তান চলে গেছে তারা এখানে একা পড়ে গেল। তারা তখন কী করবে? চুক্তি হয়েছিলো ৩ বছরের মধ্যে সব বিহারীদের পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেয়া হবে। অথচ আজ এতোগুলো বছর হয়ে গেলো। এখন আর আমরা যেতে চাই না। আমরা চাই এদেশেই রাজধানীর আশেপাশে কোথাও আমাদের নাগরিক সুবিধা পাওয়ার মতো জায়গায় পুনবার্সিত করা হোক।
তিনি আরও বলেন: পাকিস্তানের জন্মের সময় আমাদের লোকেরা রক্ত দিয়েছে। অথচ ভারত থেকে পাকিস্তানে আসা বিহারীদের সরকারি চাকরির বড় কোন পর্যায়ে যেতে দেয়নি খোদ পাকিস্তান। কারণ মুনিম খান, আইয়ুব খান সরকার ধারণা করতো আমাদের মধ্যে ভারতের চর আছে । সরকারি চাকরিতে তাদের ‘সান অব সয়েল’ নীতির কারণে ভারত থেকে আসা বিহারিরা বাদ পড়ে যায়। পাকিস্তান শুধু সুযোগ মতো বিহারিদের ব্যবহার করে স্বার্থ হাসিল করেছে। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেয়াটা ছিলো পাকিস্তানি নেতাদের ভুল। কারণ এখানে পশ্চিম পাকিস্তানের সংস্কৃতি-ভাষার সঙ্গে বিশাল ভিন্নতা ছিলো। ওনাদের জানা উচিৎ ছিলো এখানে ভাষায় আঘাত করলে পাল্টা আঘাত আসবে। স্কুল-কলেজে আমাদের সঙ্গে বাঙালিদের বিভেদ আরও বাড়িয়ে দেয়া হলো। আমাদের মধ্যে শত্রুতা, অবিশ্বাস আরও বাড়িয়ে দেয়া হলো।
এদেশ, সংস্কৃতি, ভাষার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে কোন আপত্তি নেই জানিয়ে জব্বার বলেন: ১৯৭১ সালে আমাদের কাছে থাকা বহু মূল্যবান উর্দু বই আমরা পুড়িয়ে দিয়েছিলাম। সেটা ভয় থেকে হোক, কিংবা টিকে থাকতেই হোক। উর্দুর সঙ্গে অতি ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ইতি টানতে আমরা তো সেগুলো ভেবে-চিন্তেই পুড়িয়েছিলাম। রিশতা (পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক) শেষ। এখন ঘর থেকে বের হলে বাংলা বলি, আমার ছেলের বন্ধুরা সব বাঙালি।