‘সোলাইমানির গুপ্তহত্যার প্রতিশোধ নিবে ইরান।’ ট্রাম্পের নির্দেশে ইরানি জেনারেল হত্যার ঘটনার পরে এমন মন্তব্য করেছে ইরানি কর্মকর্তারা। তাহলে কি দুই দেশের মধ্যে ছড়াবে উত্তেজনা? এমন প্রশ্ন এখন বিশ্ববাসীর মনে?
ইরানের বিপ্লবী গার্ডের শক্তিশালী কুদস ফোর্সের প্রধান জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে হত্যার পরে পেন্টাগন এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, মার্কিন প্রেসিডেন্টের নির্দেশে প্রবাসী মার্কিনীদের প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করতে এক অভিযানে জেনারেল সোলাইমানিকে হত্যা করেছে মার্কিন সেনাবাহিনী।
ইরানের সম্ভাব্য ভবিষ্যত হামলাকারী বিমানকে লক্ষ্য করে ড্রোন হামলা চালানো হয়েছে বলে বিবৃতিতে বলা হয়। পেন্টাগনের দাবি, বাগদাদের মার্কিন দূতাবাসে হামলার অনুমোদন দিয়েছিলেন জেনারেল সোলাইমানি।
এই দুই দেশের সম্পর্কের জটিলতা শুরু ১৯৫০ এর দশক থেকে। তখন দেশটির তেল সম্পদ সরকারি করতে চেয়েছিলেন ইরানের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদ্দেক। এর আগ পর্যন্ত যার বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করতো ব্রিটিশরা। আর ইরানিরা এর কোনো সুবিধা পেতো না। ফলে ছিলো জনরোষ। সমস্যা কমাতে ব্রিটিশ ও মার্কিনরা অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সরে যেতে হয় প্রধানমন্ত্রীকে।
এরপর যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে ক্ষমতায় আসেন মোহাম্মদ রেজা শাহ। সাভাক নামের গোপন পুলিশ দিয়ে তিনি দমন করেন বিরোধীদের। এই সময়ে ইসলামপন্থী নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনি হয়ে যান প্রধান প্রতিপক্ষ।তবে শাহের বিরোধিতা করার পর থেকেই নির্বাসনে যেতে হয় তাকে। এসবেই দেশের জনগণের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছিলো। তারা শাহের বিদায় চাইছিলো। ১৯৭৯ সালে খোমেনি প্যারিস থেকে ফিরলেই নির্বাসনে পাঠানো হয় শাহকে। শাহের নির্বাসন একটি বড় আঘাত ছিলো যুক্তরাষ্ট্রের জন্য।
সেই সময়ের পর থেকেই ইরান একটি ইসলামী প্রজাতন্ত্র। খোমেনি হয়ে উঠেন প্রধান নেতা। তখন যুক্তরাষ্ট্র বিরোধি মনোভাব ইরানে তুঙ্গে। ঠিক সেই সময়ে শাহ চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে গেলে জনগণের মধ্যে ক্ষোভ আরো তীব্র হয়।
এরই মধ্যে খোমেনিপন্থী ইরানি ছাত্ররা তেহরানের মার্কিন দূতাবাসে ঢুকে পড়ে। ৫২ জন আমেরিকানকে তারা ৪৪৪ দিনের জন্য জিম্মি করে রাখে। সেই প্রথম যুক্তরাষ্ট্র ইরানের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে।
দিন পেরোয়। আর ১৯৮০ সালে লেগে যায় ইরাক ইরান যুদ্ধ। যুদ্ধে ইরাককে সহায়তা দিতে থাকে যুক্তরাষ্ট্র। যুদ্ধে প্রায় ১০ লাখ মানুষ মারা যায়। আট বছর পর যুদ্ধ বিরতিতে সম্মত হন খোমেনি। কিন্তু ইরান আমেরিকা সম্পর্ক তিক্ত হতেই থাকে।
১৯৮৮ সালে ইরানের একটি বিমান গুলি করে নামায় আমেরিকার যুদ্ধজাহাজ। পরে এই ভুল স্বীকার করলেও ক্ষমা চায়নি যুক্তরাষ্ট্র। সম্পর্কের আরো বেশি অবনতি হতে থাকে যখন প্রেসিডেন্ট বুশ ইরাক, ইরান ও উত্তর কোরিয়াকে শয়তানের চক্র বলে মন্তব্য করেন ২০০২ সালে। তখন যুক্তরাষ্ট্রের নজর পড়ে ইরানের পারমানবিক কর্মসূচির উপর। ফলে দেশটির উপর ব্যাপক আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে ইরানের তেল রপ্তানি ও অর্থনীতি।
এরপর পারমানবিক চুক্তি নিয়েও দুই দেশের বিরোধ দেখা দেয়। ২০১৫ সালের এই চুক্তির পরে ইরানের উপর থেকে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হবে, এমন কথা থাকলেও ওই চুক্তির তিনবছর পরে চুক্তি থেকে বেরিয়ে যায় যুক্তরাষ্ট্র। বলা হয় ইরানের রেভুলিউশনারি গার্ড একটি সন্ত্রাসী গ্রুপ। এসবের পরিপ্রেক্ষিতেই সৃষ্টি বর্তমান পরিস্থিতির।
১৯৯৮ সাল থেকে মেজর জেনারেল কাসেম সোলাইমানি ইরানের কুদস ফোর্সের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ইরান রেভুলিউশনারি গার্ডসের এই অভিজাত বাহিনীটি দেশের বাইরে চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে থাকে।
ইরানি জেনারেলকে ইরানের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তি মনে করা হয়। তার এই হত্যাকাণ্ড যে দুই দেশের মধ্যে উত্তাপ আরো বাড়াতে পারে তা না বোঝার আর কোনো অবকাশ নেই।
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ যারিফ এই হামলাকে ‘আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী হামলা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। টুইটে তিনি জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের হঠকারিতার ফল ভোগ করবে।
যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র মজুদ থাকলেও ইরানের অস্ত্র মজুদও কম নয়। যদিও নতুন অস্ত্র ক্রয়ের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে ইরানের উপরে। তবে তা শেষ হবে ২০২০ সালের অক্টোবরে। ফলে মার্কিন-ইরান অবস্থান নিয়ে বিশ্ববাসীর মনে শঙ্কাতো আছেই।