চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

জীবন মানে আর কিছু নয়, জীবন তো উৎসব !

শান্তি, সৌহার্দ্য আর আনন্দের বার্তা নিয়ে সারাদেশে পালিত হচ্ছে ঈদ-উৎসব। ঈদ মানে আনন্দ। ঈদ মানে খুশি। তার ওপর এটি যদি হয়, ঈদ উল ফিতর তবে তো আর কথাই নেই। আনন্দ আর খুশির মাত্রা বেড়ে যায় বহুগুণ। কারণ দীর্ঘ এক মাসের ত্যাগ ও সংযম সাধনার পর ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা এই দিনটি খুব আনন্দের সঙ্গে পালন করে থাকে।

বাংলাদেশের মানুষের জন্য ঈদ উল ফিতর হলো একটি অন্যতম বৃহত্তম বাৎসরিক উৎসব। জাতি-বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে দেশের প্রতিটি মানুষ ঈদের এই আনন্দে সামিল হয়। সবার মুখে আনন্দের হাসি। সকল দুঃখ-কষ্ট ভুলে অন্তত ঈদের দিনে যে যার সাধ্য মতো খুশিতে মেতে উঠে। তবে এই দিনটি সবচেয়ে বেশি আনন্দের বার্তা বয়ে আনে শিশুদের জন্য। তারা ঈদের নতুন জামা-কাপড় পড়ে সকাল থেকে শুরু করে সারাটা দিন প্রজাপতির মতো ঘুরে বেড়ায়। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধবের বাড়ি যায়, এটা-ওটা খায়। আনন্দ-আর খুশিতে মেতে উঠে।

আমরা যারা ভিন্ন ধর্মাবলম্বী ছিলাম, ছোটবেলায় আমরাও এই বিশেষ দিনটির জন্য অপেক্ষা করতাম। ভালো জামাকাপড় পড়ে অপেক্ষা করতাম কখন, ঈদের নামাজ শেষ হয়। নামাজ শেষ হওয়া মাত্র আমরাও উৎসবে সামিল হয়ে যেতাম। সবাই খুশি মনে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে কোলাকুলি করতাম। তারপর শুরু হতো বাড়ি বাড়ি গিয়ে সেমাই খাওয়ার পালা। দুপুরে পোলাও-মাংসের জন্যও আমরা অপেক্ষা করতাম।

আমাদের সময় গ্রামে ঈদে বিশেষ খেলাধুলার আয়োজন হতো। বসতো মেলা এসব অনুষ্ঠানে ছিল উপচে পরা দর্শক। ধনী-গরিব, জাত-ধর্ম নির্বিশেষে সবাই সেই উৎসবে যোগ দিত। যে যেখানেই চাকরি, লেখাপড়া কিংবা অন্য যে কোন কারণেই অবস্থান করুক না কেন, ঈদে সবাই বাড়ি যেত। ঈদের দিনটা পরিণত হতো মিলন মেলায়। গল্প-আড্ডা, খাওয়া-ঘুড়ে বেড়ানো, সিনেমা দেখা, আর রাতে বাংলাদেশ টেলিভিশনে ঈদের বিশেষ নাটক আর আনন্দমেলা ছিল আমাদের কৈশোর ও যৌবনে সেরা আকর্ষণ।

আমাদের কৈশোরে ঘরে ঘরে টেলিভিশন ছিল না। আমরা আমাদের বড়লোক কোন বন্ধুর বাড়ি দল বেঁধে যেতাম টেলিভিশন দেখার জন্য। সেখানে গাদাগাদি করে বসে টেলিভিশন দেখতে হতো। আর ছিল লোডশেডিং আতংক। ঈদের বিশেষ নাটক কিংবা আনন্দমেলা চলাকালে বিদ্যুৎ থাকবে কি-না এটাই ছিল আমাদের সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তার বিষয়।

আমাদের ছোট বেলার ঈদ আনন্দের আরেকটি উপকরণ ছিল ঈদের সালামি কিংবা ঈদি সংগ্রহ করা। বড়দের সঙ্গে ছোটদের এই ভালোবাসার লেনদেন সম্পর্ককে করে তুলতো আরও মধুর। ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী, বাবা-মা সবাই কেউই এই সেলামি থেকে বাদ যেত না। টাকার অংকে যাই হোক, সেলামি দিতে হবে, নিতে হবে। ঈদের দিন কেউ পা ছুঁয়ে সালাম করলে স্নেহ নিয়ে পাঞ্জাবির পকেট কিংবা শাড়ির আঁচল থেকে থেকে এক টাকা, দুই টাকা কিংবা পাঁচ টাকার একটা নোট বের করে দিতেন। সেলামকারীর বয়স একটু বেশি হলে মাঝে মধ্যে ৫০ টাকাও মিলত। নতুন পোশাক পড়ে বড়দের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে তারপরই ঈদের সালামি নেয়ার প্রথা চলে আসছে বহুবছর ধরে।

এখন অবশ্য সেভাবে সালাম করার প্রথা এক হিসেবে বিলুপ্তির পথে। কেউ আর এখন আগের মত বড়দের সালাম করে না, কিন্তু সেলামি ঠিকই চায়। পাশাপাশি সেলামি দেওয়ার নিয়মটাও গেছে পাল্টে। এখন সেলামি দেওয়া হচ্ছে মোবাইল ব্যাংকিং কিংবা মোবাইল রিচার্জের মাধ্যমে। এমনকি সেলামিদাতা এবং সেলামি গ্রহীতার সামনাসামনি আসারও প্রয়োজন পড়ে না।

ঈদ মানে উৎসব আর উৎসবের মর্মকথাই হল প্রাণের মিলন, জীবনে জীবন যোগ করা। ধর্মের অর্থ যদি ধারণ করা হয়, তাহলে ছোট-বড়, ধনবান-নির্ধন সবাইকে সমভাবে গ্রহণ করে একটি সুখী ও সহযোগিতামূলক সমাজ গঠনই ছিল ধর্মের তাগিদ। প্রতি রমজানে এবং রমজানের ঈদেও এই তাগিদটি আমাদের কাছে আসে। কিন্তু উৎসব যখন প্রথা হয়ে দাঁড়ায়, তখন তার অন্তর্নিহিত মানবতাবোধ হ্রাস পায়। শ্রেণী-বৈষম্যটি বাহ্যিক কোলাকুলির আড়ালে ঢাকা পড়ে বটে, কিন্তু আড়ম্বর ও উৎসবের পার্থক্য ধনী ও গরিবের উৎসবের পার্থক্যটিও বুঝিয়ে দেয়।

ধর্মের মর্মবাণী সম্পর্কে কবি নজরুল বলেছেন, ইসলাম বলে সকলের তরে মোরা সবাই, সুখ-দুঃখ সমভাগ করে নেব সকলে ভাই। এই মর্মবাণী কি আমাদের ধর্মবোধে এখনও টিকে আছে? আমরা কি সুখ-দুঃখ সমানভাবে ভাগ করে নেই? নিলে যে সামাজিক শক্তি তৈরি হতো তা আজ আমাদের মধ্যে কোথায়? সমাজ আজ শ্রেণী বিভক্ত। মানুষে মানুষে ধন বৈষম্যের আকার আজ পর্বত সমান। এখন পবিত্র রমজান মাসে এবং ঈদের দিনেও হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠনসহ তাবৎ সন্ত্রাসী কাজকর্মের খবর পাওয়া যায়। অর্থাৎ ধর্মের অন্তর্নিহিত মানবতার তাগিদ আজ মানুষের কাছে বিস্মৃত। সমাজ অধঃপতিত।

কিছুদিন আগে সিলেটে রাজন নামে যে ছোট্ট শিশুকে নির্মভাবে মেরে ফেলা হলো-এই ঘটনা আমাদের মানবিক চেতনাকে ভীষণ ভাবে নাড়া দিয়ে যায়। আমরা মর্মাহত হই। আমাদের অন্তরাত্মা রাজনের জন্য কেঁদে উঠে। এই ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয় প্রথানির্ভর কোনো ধর্মীয় উৎসবই মানুষের মনে মানবতার আলো জ্বালাতে পারছে না। ব্যক্তি পর্যায়ে এবং সমষ্টিগতভাবে মনুষত্বের সাধনা আজ বড় বেশি প্রয়োজন।

‘প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্র দীন একাকী’ কিন্তু উৎসবের দিনে মানুষ বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মানুষের সঙ্গে একত্র হইয়া বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করিয়া মহৎ’ কথাগুলো রবীন্দ্রনাথের। উৎসবের সম্মিলনে আমরা অর্জন করি ‘আমরা’ হবার বোধ-উপলব্ধি! উৎসব তাই সবার জন্যই সতত সুখের এবং আনন্দের। এ এক মহৎ হবার সাধনা, বৃহৎ হওয়ার সংকল্প। উৎসব হচ্ছে সবার মিলন। সবাইকে যুক্ত করার মধ্যেই উৎসবের সার্থকতা। সবার সঙ্গে মিলে মিশে উৎসব পালনের মধ্যে নিশ্চয় আনন্দ অনেক বেশি। দারিদ্র্য ও বৈষম্য-বঞ্চনা ঘুচে গিয়ে এ আনন্দ সবার জন্য যদি সত্য হয় তবে তার মূল্য অপরিমেয়।

সবাইকে নিয়ে যে উৎসব তা জীবনকে নতুন তাৎপর্য দান করে। সব সংকীর্ণতা ও ভেদাভেদ ভুলে একে অপরের সঙ্গে মিলিত হওয়ার শক্তি দান করে। পরস্পরের বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী হয়ে ওঠার এক মহান উপলক্ষ হচ্ছে বিভিন্ন উৎসব, যেমন-ঈদ, পূজা, বড়দিন, প্রবারণা পূর্ণিমা। ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানকে ছাপিয়ে এসব উৎসব তাই এখন ঘোষণা করে মানুষে মানুষে মিলনের আহবান।

উৎসবের সঙ্গে শান্তির গভীর যোগসূত্র আছে। শান্তির কমতি থাকলে উৎসবের আনন্দেও ভাটা পড়ে। এই শান্তির জন্য চাই অনুকূল পরিবেশ। পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সম্মান ও সহমর্মিতা থেকে যে সামাজিক শান্তির পরিবেশ সৃষ্টি হয় তা উৎসবের আনন্দকে অনেকগুণ বাড়িয়ে দেয়।

আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের গতানুগতিকতার ব্যত্যয় ঘটিয়ে উৎসব জীবনকে রসালো, আনন্দঘন এবং প্রাণবন্ত করে তোলে। তাই উৎসব আমাদের কাছে এত কাঙ্ক্ষিত। প্রতিদিন অবশ্য উৎসব আশা করা যায় না, এলে ভালোও লাগবে না। বাস্তÍব জগতে কর্মই ধর্ম, কর্মই কাম্য। তবে দীর্ঘ সময়ব্যাপী কর্মের ফলে জীবনে ক্লান্তিকর একঘেয়েমি সৃষ্টি হয়। এর হাত থেকে মুক্তি পেতে একটি বিরতির দরকার হয়। বিরতির সময়টুকু বিনোদনের মাধ্যমে নবআনন্দে জেগে ওঠার সুযোগ করে দেয়।

ধর্মীয় উৎসব কিংবা অন্য যে কোনো সামাজিক সাংস্কৃতিক উৎসবের মূলে রয়েছে কল্যাণকামনা এবং শুভবোধ। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমরা উচ্চারণ করি শুভ, সত্য, সুন্দর এবং কল্যাণের মন্ত্র। সেই মন্ত্রের বলে আমরা যেন অশুভ শক্তি বিনাশের মাধ্যমে সবার হৃদয়ে মানবধর্ম এবং মানবিক মূল্যবোধের উদ্বোধন ঘটাতে পারি, আজকের দিনে আমাদের সেটাই হোক প্রার্থনা। সভ্যতার অগ্রযাত্রা সুর বা শুভ, সত্য এবং সুন্দর প্রতিষ্ঠার সাধনা ছাড়া আর কিছুই নয়।

যে ঐক্য ও শান্তি আমরা উৎসবের দিনগুলোয় দেখাতে পারি, তাকে কেন নিত্যদিনের বিষয়ে পরিণত করতে পারব না? যদি ছোট পরিসরে পারি, তো বড় পরিসরে, জাতীয় জীবনে একই আচরণ করতে না পারার তো কোনো কারণ থাকতে পারে না। ঈদ, পূজা, বড়দিন, প্রবারণা পূর্ণিমা, নববর্ষ ইত্যাদি বিভিন্ন অনুষ্ঠান আমাদের সামষ্টিক জীবনে শুভবোধ চর্চার যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে, তা সঞ্চারিত হোক সবার প্রতিদিনের জীবনযাপনে-আসুন আমরা সবাই মিলে সেই সাধনা করি।

বাঙালির জীবনে উৎসবের আনন্দে মুখরিত হোক। আমরা সম্মিলিত চেষ্টায় ফিরিয়ে আনি সেই সব ঐতিহ্যবাহী উসব-অনুষ্ঠানের, যেগুলোর সঙ্গে আমাদের প্রাণের এবং বহুমানুষের মিলনের যোগ আছে। আসুন আমরা উদাত্ত কণ্ঠে বলি, সবাই সুখী হোক, সবার প্রাণ ভরে উঠুক সুখানুভবে। উৎসবের আনন্দ সবার জন্যই সমান হোক, উৎসব হোক সর্বজনীন, সবার।

সবাইকে ঈদ মোবারক!