চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

জীবনের জিপিএ ফাইভ অন্য জিনিস!

প্রশ্নফাঁসের উৎসবের মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হওয়া এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হলো গত রোববার। ফলাফল নিয়ে নানা বিশ্লেষণ চলছে। নানা সাফল্যগাঁথা, ব্যর্থতার খবরও আমরা পাচ্ছি। সংবাদপত্রের তথ্য অনুযায়ী এখন পর্যন্ত পরীক্ষায় প্রত্যাশিত ফল না পাওয়ায় কিংবা অকৃতকার্য হওয়ায় চার জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। ১৯ শিক্ষার্থী আত্মহত্যার চেষ্টা চালিয়েছে। ধারণা করা যেতেই পারে, এই সংখ্যা আরো অনেক বেশি। এবং ফলাফল মন মতো না হওয়ায় মন খারাপ হয়েছে কিংবা বাবা-মায়ের বকুনি খেয়েছে, রাতের ঘুম নষ্ট হয়েছে, দুশ্চিন্তায় দুশ্চিন্তায় এক সময় মনে হয়েছে আমাকে দিয়ে কিছু হবে না- এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যাও কম নয়।

এই বিষয়ে বিস্তারিত বলার আগে, যারা প্রত্যাশিত ফলাফল পেয়েছে অর্থাৎ জিপিএ ৫ পেয়েছে তাদের উদ্দেশ্যে কিছু কথা বলে নেওয়া যাক।

এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রিয় শিক্ষার্থীরা, তোমাদের কৃতিত্বকে আমরা স্বীকার করে নিই। তোমাদের সাফল্যকে আমরা গৌরবের স্মারক বলে মনে করি। মনে করি বলেই মনে করিয়ে দিতে চাই- এই তোমাদের শুরু; শেষটা অনেক দূর। শুরুর সাফল্য তোমাদেরকে আনন্দিত করেছে, সন্দেহ নেই, কিন্তু সেই আনন্দের ঢেউ যেন শেষের উদ্দিষ্টকে প্লাবিত করে না ফেলে। শেষটা কোথায়? যেখানে দাঁড়িয়ে ক্ষুধামুক্ত আত্মনির্ভরশীল অপ্রতিরোধ্য এক বাংলাদেশ! তোমাদেরকে নিয়ে আমাদের স্বপ্নটা খুবই স্পষ্ট। দু’টি স্বপ্ন। প্রথমটি তোমরা অনেক বড় হবে। দ্বিতীয়টি তোমাদের এই ‘বড়ত্ব’ দিয়ে বাংলাদেশকে বড় করে তুলবে। দেশকে নিয়ে স্বপ্ন না দেখলে, দেশকে এবং দেশের মানুষকে ভাল না-বাসলে আর যা-ই হও, বড় হতে পারবে না। আমাদের স্বাধীনতার বয়স ৪৭ বছর। আমরা স্বাধীন হয়েছি কিন্তু ‘মুক্তি’ পাইনি। তোমাদেরকে নিয়ে সেই মুক্তির স্বপ্ন আমরা দেখতে চাই ।

যারা উত্তীর্ণ হতে পারোনি কিংবা প্রত্যাশিত জিপিএ ৫ পাওনি, তোমাদেরকে নিয়েও আমাদের স্বপ্ন আছে এবং সেটা ঐ একই স্বপ্ন! একটি পরীক্ষায় ভালো না-করা মানে জীবনে হেরে যাওয়া নয়। জীবন অনেক বড়! শ্রেণিকক্ষের তিন ঘণ্টার একটি উত্তরপত্র তোমার জীবনের আসল চিত্র নয়। বোর্ড থেকে পাওয়া একটি সার্টিফিকেট তোমার জীবনের সত্যিকারের বায়োডাটা নয়। একটি কাগজ এবং তাতে খোদাই করা কিছু শব্দ দিয়ে তোমার সৃজনশীলতাকে পরিমাপ করা সম্ভব নয়। বইয়ের পুঁথিগত বিদ্যায় উত্তীর্ণ না হতে পারর মানে এই নয় যে, তোমাকে দিয়ে কিছুই হবে না।

একথাগুলো তোমাদেরকে বলছি, কারণ তোমরা যারা পাস করেছ এবং যারা পাস করতে পারোনি, তোমাদের মধ্যেই হয়ত লুকিয়ে আছে আগামীর বাংলাদেশের রাষ্ট্রনায়ক। যে ছেলেটি বা মেয়েটি এ বছর পরীক্ষায় পাস করতে পারেনি, কে জানে, সে-ই হয়ত ২০৪৫ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হবে! তোমরা ব্রাজিলের নাম শুনেছ। বিশ্বকাপ ফুটবলে সবচেয়ে বেশি বার জয়ী দেশ। পেলের দেশ। সেই ব্রাজিলের সাবেক প্রেসিডেন্ট লুইস ইনাসিও লুলা দা সিলভা চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনা করতে পেরেছিলেন। তোমাদের মতো তাঁর বয়স যখন ১৪, তখন সে রাস্তার মোড়ে বসে থাকত রং পলিস নিয়ে। করত মুচির কাজ! এরপর জীবনের নানা ঘাত প্রতিঘাত সয়ে সয়ে উদ্বুদ্ধ হলেন জীবনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিতে। হার মানেননি। হলেন ব্রাজিলের প্রেডিসডেন্ট। প্রথমবার ২০০২ সালে। ২০০৬ এ দ্বিতীয়বার। হলেন টাইমস সাময়িকীর বিবেচনায় ২০১০ সালের সেরা রাজনৈতিক নেতা! এই হল থেমে না থাকার গল্প। মনে রাখবে- জীবনের কোনো ঘটনাই জীবনের চেয়ে বড় নয়।

ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জুকারবার্গের নাম তোমরা শুনেছো। বর্তমান বিশ্বের ৫ম সেরা ধনবান এই জুকারবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনা শেষ করতে পারেননি। বিশ্বের সেরা হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশুনা শেষ না করেই চলে এসেছিলেন। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিশ্বের সেরা ধনী বিল গেটস তাকে দিয়ে পড়াশুনা হবে না বুঝে বের হয়ে এসেছিলেন। তৈরি করে ফেললেন মাইক্রোসফট! এ্যাপলের প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবসের নামও তোমরা কেউ কেউ জানো। অর্থসংকটের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনা ছেড়ে দিয়েছিলেন। ছাড়েননি জীবন! জীবন এসব মানুষকে দু’হাত ভরে দিয়েছে। এমন এক একটা বিস্ময়কর জীবনের অধিকারী তোমরা প্রত্যেকে। পরীক্ষার ব্যর্থতা মানে জীবনের ব্যর্থতা নয়।

আবার এও ঠিক, যারা জিপিএ ৫ পেয়ে আনন্দিত হয়েছ, গৌরবের মুকুট মাথায় পড়েছ, তাদেরও করবার আছে অনেক কিছু। জিপিএ ৫ মানেই জীবনের সবটুকু সাফল্য নয়। জীবনের জিপিএ ৫ অন্য জিনিস! শুধু মেধা দিয়ে সাফল্যের দেখা মিললেও সার্থকতা অর্জন করতে না-পারলে মেধা মূল্যহীন। মেধার সাথে যদি নীতিবোধ না থাকে তাহলে সে-ই হয়ে ওঠে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। আমাদের সবচেয়ে বড় পরিচয় আমরা মানুষ। মানুষকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছে জ্ঞান। কিন্তু তাকে সত্যিকার অর্থেই ‘মানুষ’ করে তুলতে পারে নৈতিক মূল্যবোধ। একটি সুনির্দিষ্ট নৈতিক মূল্যবোধ আর তার যথার্থ অনুশীলন ছাড়া শুধু জ্ঞান ফলদায়ক নয়। আমরা ক্রমান্বয়ে সফলতার পেছনে ছুটছি। কিন্তু সফল হওয়ার চেয়ে সার্থক হওয়া বেশি জরুরি।

সার্থক জীবন কোন জীবন? যে জীবন মানবিক, যে জীবন অন্যের জন্য নিবেদিত, যে জীবন শ্রষ্টার আনুগত্যে নিয়োজিত। জিপিএ ৫ না পাওয়া কিংবা পরীক্ষায় ফেল করা একজন নৈতিক, সৎ, দেশপ্রেমিক শিক্ষার্থী এক হাজার জিপিএ ৫ পাওয়া অসৎ, স্বার্থপর শিক্ষার্থীর চেয়ে বেশি ভালো এবং দেশের জন্য বেশি দরকারি। এই দেশ যথেষ্ট দক্ষতা সম্পন্ন মানব সম্পদ তৈরি করেছে। কিন্তু সততার প্রশ্নে আমরা এখনো উত্তীর্ণ নই। না হলে ‘মুক্তিযুদ্ধ’ শব্দটিকে যে দেশের অধিকাংশ মানুষ প্রায় ধর্মানুভূতি নিয়ে উচ্চারণ করে, সেই দেশে কিছু মানুষ মুক্তিযুদ্ধের মিথ্যা সার্টিফিকেট নিয়ে প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায়ে দিনের পর দিন চাকরি করে যায় কীভাবে। যুদ্ধে সহায়তা করবার জন্য বিদেশি বন্ধুদের কৃতজ্ঞতা জানানোর স্বর্ণদণ্ডে স্বর্ণ উধাও হয়ে যায় এই দেশে! কতো যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার চিকিৎসা হয় না! ফুটপাতে খোলা আকাশের নিচে ঘুমিয়ে থাকে কতো ‘ভোটার’! একটি দেশ বিষের উপরে টিকে আছে। মানুষ প্রতিদিন টাকা দিয়ে বিষ কিনছে। এমন খাবার খুঁজে পাওয়া কঠিন, যাতে বিষ নেই। রুগী মরে গেলেও চিকিৎসার বিল পুরো পরিশোধ করার আগে মৃতদেহ হস্তান্তর করা হয় না এই দেশে। এসবের পরিবর্তন করাই আসল কাজ। তোমরাই হবে দিক পরিবর্তনের সেই বাতিঘর।

অন্যের জন্য কিছু করার মধ্যেই জীবনের সার্থকতা। নিজের কাজগুলো ঠিকঠাকভাবে করতে পারার মধ্যেই আনন্দ। একটি মানবিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখতে পারা, কোনো অবস্থাতেই অনৈতিক না হওয়া, সততার প্রশ্নে আপোষহীন হওয়া, মৃত্যুর পরেও মানুষ যেন তোমাকে মনে রাখে, মিস করে- এমন জীবন গঠন করার জন্যই তোমাকে জীবন দেওয়া হয়েছে। শুধুমাত্র পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পাওয়ার জন্য নয়!

তোমরা প্রত্যেকেই আমাদের কাছে এক একটি ঝিনুক। তাহলে ‘মুক্তো’ কী? মুক্তো হলো ভালো মন। এমন যেন না হয়, আমরা ঝিনুক পেয়েছি; মুক্তো পাইনি!

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)