সাংবাদিক জামাল খাশোগিকে তুরস্কে সৌদি কনস্যুলেটের ভেতরে হত্যার খবরটি শুরুর দিকে গুঞ্জন থাকলেও এখন তুরস্ক বলছে যে, তাকে কনস্যুলেটের ভেতরে নির্যাতন ও হত্যার তথ্যপ্রমাণ তাদের হাতে রয়েছে। শুধু তাই নয়, এই ঘটনার কিছু অডিও-ভিডিও তাদের হাতে আছে বলে দাবি করেছে তুরস্ক। বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় চলছে সারা দুনিয়ায়। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও প্রতিদিনই শিরোনামে থাকছেন এই প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
১৯৫৮ সালে সৌদি আরবের মদিনায় জন্মগ্রহণকারী জামাল আহমাদ খাশোগি তার নিজ দেশের বাইরেও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যম যেমন এমবিসি, বিবিসি, আল-জাজিরা এবং দুবাই টেলিভিশনের রাজনৈতিক ভাষ্যকার ছিলেন। আল আরব নিউজ চ্যানেলের এই সাবেক প্রধান সম্পাদক সৌদি সংবাদপত্র আল ওয়াতানেরও সম্পাদক ছিলেন। ১৯৯৯ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত তিনি সৌদি আরবের প্রভাবশালী ইংরেজি দৈনিক আরব নিউজের ডেপুটি এডিটর ইন চিফ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ছিলেন সৌদি রাজতন্ত্রের একজন কট্টর সমালোচক।
মূলত ইয়েমেনে সৌদি হস্তক্ষেপ এবং কাতারের ওপর অবরোধ ইস্যুতে তিনি সৌদি সরকারের কড়া সমালোচনা করেন। সম্প্রতি কানাডার সাথে সৌদি আরবের যে কূটনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয়, সেই ইস্যুতেও তিনি সৌদি আরবের নীতির সমালোচনা করেন। ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের বসতি স্থাপন এবং ইসরায়েলের ধ্বংসযজ্ঞেরও সমালোচক ছিলেন খাশোগি। ফলে এ বিষয়ে এখন কারো সংশয় নেই যে, এই ভিন্নমতের কারণেই তিনি সৌদি সরকার এবং অন্যদের টার্গেট হয়েছেন এবং আরেকটি দেশে গিয়ে খুন হয়েছেন। নানাবিধ হুমকির মুখে ২০১৭ সালে তিনি দেশ ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান।
তুরস্ক সরকার দাবি করেছে, তাদের কাছে অডিও–ভিডিও ফুটেজের রেকর্ডিং আছে, যাতে তারা প্রমাণ করতে পারবে, সৌদি দূতাবাসের ভেতরেই গত ২ অক্টোবর জামাল খাশোগিকে হত্যা করা হয়েছে। মার্কিন তদন্তকারী কর্মকর্তাদেরও এই তথ্য জানানো হয়েছে। তুরস্কের দাবি, তাদের কাছে যে ভিডিও ফুটেজ এসেছে, তাতে দেখা গেছে দূতাবাসে ঢোকার পর কিছুক্ষণ পরই জামালকে সৌদির গোয়েন্দারা খুন করে এবং তারপর তার দেহ টুকরো টুকরো করে ফেলে। আর অডিও ফুটেজে শোনা গেছে, দূতাবাসের ভেতরে ঢোকার পরে তাকে আরবি ভাষায় জেরা করা হচ্ছে। এমনকি অডিও রেকর্ডিংয়ে তাকে মারধরের আওয়াজ, তার আর্তনাদও স্পষ্ট শোনা গেছে।
যদিও এখনও খাশোগির মরদেহের কোনো হদিস মেলেনি। সৌদি আরব শুরু থেকেই তাকে নির্যাতন বা হত্যার অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। বরং সৌদি কনস্যুলেট কর্তৃপক্ষের দাবি, মি. খাশোগি কাজ শেষ করে কনস্যুলেটের পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেছেন। তিনি একজনকে বিয়ে করার জন্য কিছু কাগজ সংগ্রহের জন্য তুরস্কে অবস্থিত সৌদি কনস্যুলেটে ঢুকেছিলেন সামনের দরজা দিয়ে এবং গেটের বাইরে অবস্থান করছিলেন তার প্রেমিকা। সুতরাং কাজ শেষ করে তিনি কেন পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাবেন, সেটি একটি প্রশ্ন। তার মানে সৌদি কর্তৃপক্ষ যে সত্য আড়াল করছে, তা মোটামুটি পরিষ্কার। আর তুরস্ক যেখানে বেশ জোর দিয়েই বলছে যে, খাশোগিকে হত্যা করার যাবতীয় প্রমাণ তাদের হাতে রয়েছে এবং ১৫ সদস্যের একটি দল তাকে হত্যা করেছে—যাদের মধ্যে সাবেক কূটনীতিক এবং ফরেনসিক বিশেষজ্ঞও ছিলেন—তখন মনে হয় না, খাশোগি আর বেঁচে আছেন। বরং তাকে হয়তো কনুস্যলেটের ভেতরেই কোথাও কবর দেয়া হয়েছে। অথবা অন্য কোথাও মরদেহ লুকিয়ে ফেলা হয়েছে।
জামাল খাশোগির জন্ম মদিনার একটি ধনী, প্রভাবশালী ও স্বনামখ্যাত পরিবারে। তার দাদা মুহাম্মদ খাশোগি সৌদি আরবের কিং আব্দুল আজিজ আল সৌদের ব্যক্তিগত চিকিৎসক ছিলেন। সৌদি আরবের প্রভাবশালী অস্ত্র ব্যবসায়ী আদনান খাশোগিরও নিকটাত্মীয় তিনি। ব্রিটেনের প্রিন্সেস ডায়ানার প্রেমিক দোদি ফায়েদও (সড়ক দুর্ঘটনায় ডায়ানার সাথে নিহত) ছিলেন জামালের চাচাত ভাই। ফলে পেশা হিসেবে সাংবাদিকতাকে বেছে নিয়ে তিনি রাজতান্ত্রিক সৌদি আরবের বিভিন্ন নীতির যে সমালোচনা করেছেন, সেখানে এই পারিবারিক পরিচয় ও ক্ষমতা তাকে সাহস জুগিয়েছে বলে মনে করা হয়।
১৯৯১ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত তিনি আফগানিস্তান, আলজেরিয়া, কুয়েত, সুদান এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে গণমাধ্যমের বিদেশ প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছেন। শোনা যায়, তিনি সৌদি গোয়েন্দা বাহিনী এবং সম্ভবত আফগানিস্তানে থাকাকালীন যুক্তরাষ্ট্রের হয়েও কাজ করেছেন। উল্লেখ্য, জামাল খাশোগির নিখোঁজ হওয়ার পর খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হুমকি দিয়েছেন, যদি মি. খাশোগিকে হত্যার প্রমাণ মেলে তাহলে সৌদি আরবকে চরম মূল্য দিতে হবে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট যখন কোনো একজন সাংবাদিকের ব্যাপারে এরকম দৃঢ় অবস্থান নেন, তখন বুঝতে হয় যে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তার একটা যোগাযোগ ছিল বৈকি। সর্বশেষ তিনি গত বছরের সেপ্টেম্বরে ওয়াশিংটন পোস্টের জন্য লেখা শুরু করেছিলেন।
তুরস্কের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা আনাদোলুর খবর বলছে, খাশোগির হত্যাকাণ্ডের ঘটনা তদন্তের জন্য রিয়াদ থেকে একটি প্রতিনিধিদল তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারায় পৌঁছেছে। কিন্তু সত্যিই যদি তাকে কনস্যুলেটের ভেতরে হত্যা করা হয়, তাহলে ধরে নিতে হবে এটি রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত অথবা গোয়েন্দা বাহিনীর। আবার সরকারের উচ্চ পর্যায়ের অনুমতি ছাড়া গোয়েন্দা বাহিনী এরকম একজন প্রভাবশালী সাংবাদিককে অন্য একটি দেশে হত্যা করবে—তাও ভাবা যায় না। সুতরাং সত্যিই যদি এই হত্যাকাণ্ডের সাথে সৌদি সরকারের সম্পৃক্ততা থাকে, তাহলে তদন্তকারী দল আসলে তুরেস্ক গিয়ে কী করবে—সেটি একটি প্রশ্ন। কেননা, সৌদি আরবে ভিন্ন মতাবলম্বীদের যে কী করুণ পরিণতি বরণ করতে হয়, তার আরও অনেক উদাহরণ আছে।
তবে এটা ঠিক, জামাল খাশোগি গণমাধ্যম ও বাক স্বাধীনতার ইতিহাসে বিচ্ছিন্ন কোনো চরিত্র নন। ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাবানদের বিরুদ্ধে কলম ধরলে তার আঙুল কেটে নেয়ার ঘটনা পৃথিবীতে যুগে যুগে ঘটেছে। কখনো মিথ্যা মামলা, কখনো গোয়েন্দা বাহিনী দিয়ে হয়রানি, কখনো পরিবারের উপর চাপ প্রয়োগ, কখনো আর্থিক হিসাব নিকাশ পরীক্ষার নামে নাজেহাল করা এমনকি নির্যাতন এবং সর্বশেষ হত্যা। ফলে আমরা যখন একজন সৌদি সাংবাদিকের নিখোঁজ (খুন) হওয়া নিয়ে কথা বলি—তখন আমাদের নিজেদের বাস্তবতা তথা আমাদের গণমাধ্যম ও নাগরিকের বাক স্বাধীনতার বিষয়টিও মাথায় রাখতে হয়।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)