১৯৪৬ সালের ১৪ অক্টোবর লন্ডনে বিশ্বের ২৫টি দেশের প্রতিনিধিরা বিশ্বব্যাপী পণ্য-সেবার মান বজায় রাখার জন্য একটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মান নির্ধারক সংস্থার বিষয়ে ঐকমত্য পোষন করেন। পরের বছর থেকে তাদের কার্যক্রম শুরু হয়। এর পর থেকে প্রতি বছর ১৪ অক্টোবর আন্তর্জাতিকভাবে ‘মান দিবস’ উদযাপিত হয়ে আসছে। বিশ্বের ৩টি আন্তর্জাতিক মান সংস্থা আইএসও, আইইসি, আইটিইউর উদ্যোগে বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর এ দিবস পালিত হয়। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয় ‘Standards-the world’s common language’ (‘বিশ্বব্যাপী সার্বজনীন ভাষা-মান’)।
মানের ভূমিকা আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে নিরাপদ ও টেকসই বিশ্ব গড়তে ‘মান’-এর বিকল্প নেই। এ জন্য আমাদের পণ্য ও সেবা খাতে আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ‘জাতীয় মান’ নির্ধারণ সময়ের দাবি। দেশের পণ্যের গুণগত মান নিয়ন্ত্রণকারী একমাত্র সংস্থা বিএসটিআই।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএসটিআইকে সকল ক্ষেত্রে জাতীয় মান প্রণয়ন ও এর ব্যবহার নিশ্চিত করতে আরও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের আহবান জানিয়েছেন। এতে বাংলাদেশের জনগণের জীবনমানের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে প্রত্যাশা ব্যাক্ত করেন তিনি ।প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, মানুষের উন্নত জীবন নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক মান সংস্থাসমূহ নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এ সংস্থাসমূহের আওতায় উন্নত এবং উন্নয়নশীল বিভিন্ন দেশের খ্যাতনামা বৈজ্ঞানিক, প্রযুক্তিবিদ এবং সুশীল সমাজের নাগরিকগণ তাঁদের গবেষণালব্ধ জ্ঞান কাজে লাগিয়ে সেবাকর্ম, খাদ্যপণ্য, ভোগ্যপণ্য এবং অন্যান্য কার্যক্রমের ওপর আন্তর্জাতিক মান ও নীতিমালা প্রণয়ন করে তা বিশ্বব্যাপী প্রকাশ করেছেন। এ সকল মানের যথাযথ বাস্তবায়নই প্রত্যাশা অনুযায়ী মানুষের প্রতিটি চাহিদা পূরণ করতে পারে।
আইএসও এই দিনটি পালন করে আসছে ১৯৭০ সাল থেকে। বিশ্বায়নের যুগে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে গুণগত মানসম্পন্ন পণ্য বা সেবা উৎপাদনের বিকল্প নেই। যে কোনো পণ্য বা সেবা ক্রয়-বিক্রয়, বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রে মান আস্থার প্রতীক হিসেবে কাজ করে। পণ্যের মান ভালো হলে জনগণের আস্থা বাড়ে। পণ্যটির চাহিদাও বৃদ্ধি পায়।
পণ্য বা সেবার বাজার সম্প্রসারণে মানের গুরুত্ব সর্বাধিক। পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণে বিএসটিআই এখনো বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে পারছে না। দেশে উৎপাদিত পণ্য ও সেবা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে সম্প্রসারণে উদ্যোক্তাদের মান বজায় রাখার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটিকে আরো শক্তিশালী করতে হবে।
আন্তর্জাতিক তিনটি সংস্থার পাশাপাশি বিএসটিআইও দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করে থাকে। প্রতিষ্ঠানটি দেশীয় ও আমদানীকৃত পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণে ১৯৬৯ সাল থেকে কাজ করে আসছে। সে হিসেবে বাংলাদেশ আজ ৪৬তম বিশ্ব মান দিবস পালন করবে। আর্ন্তজাতিক মানের মাধ্যমে পরিচালিত বিশ্ব বাণিজ্যে ব্যবসায়ী ও ক্রেতা উভয়-ই সর্বোচ্চ স্বার্থ রক্ষা করতে পারে। বিশ্ব মান সম্পন্ন পণ্যের মাধ্যমে দেশে দেশে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ব বাজার পৃথিবীর সকল দেশকে একটি অবিচ্ছেদ্য মানব গোষ্ঠীতে পরিণত করতে পারে। জাতিতে জাতিতে ভেদাভেদ ভুলিয়ে বিশ্ব মান ডাক দেয় বিশ্ব শান্তি ও বিশ্বভাতৃত্বের।
বিশ্ব বাণিজ্য পণ্য প্রবাহে অযথা বাঁধা কাটিয়ে ওঠার জন্য বিশ্ব মান অনুসরনে এই চুক্তিতে সরকার সমূহকে আহ্বান জানানো হয়েছে। ১৯৭৯ সালে গৃহীত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার “কোড অফ গড প্র্যাকটিস ফর দি প্রিপারেশন এডোপশন এ্যান্ড এপ্লিকেশন অফ স্ট্যান্ডার্স” এ ৪০টি দেশ স্বাক্ষর করেছিল। চুক্তির নতুন সংস্করণ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ১৩০টি সদস্যের ওপর-ই প্রয়োগ করা হয়েছে। উল্লেখ্য যে, গ্যার্টি চুক্তি স্বাক্ষরের পর মুক্ত বাজার অর্থনীতি চালু হয়। এ বাজারে চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশগুলো ইচ্ছেমতো অংশ নেয়ার যোগ্যতা অর্জন করে। কিন্তু বাজার মুক্ত হওয়ার প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য পণ্যের গুণগত মান বজায় রাখতে পারাটাই জরুরী।
আর্ন্তজাতিক বাজারে টিকে থাকার জন্য নিরবিচ্ছিন্ন উচ্চ মান, উৎপাদন ব্যয় হ্রাস এবং প্রতিযোগিতামূলক বাজারে সাফল্য অর্জন এর লক্ষ্যে বাংলাদেশকেও বিশ্ব মান দিবসে অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হয় যে, এই মুক্ত বাজার অর্থনীতির যুগে বিশ্ব বাণিজ্যের সঠিক পরিচালনার জন্য সকলের স্বার্থ রক্ষার্থে এক ও অভিন্ন তথা বিশ্ব মান প্রণয়ন করবে। চলমান বিশ্ব-পরিবহন, মানুষ, জ্বালানী, পণ্য এবং ডাটার সাহায্যার্থে আর্ন্তজাতিক মান নিশ্চিত হওয়া খুবই জরুরী।
শান্তি ও সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ গড়তে বিশ্ব মান দিবসের ভূমিকা বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। খাদ্য ও ভোগ্যপণ্য, সেবা কার্যক্রম এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন সংশ্লিষ্ট সকল কর্মকাণ্ড মানুষের চাহিদা অনুযায়ী লাভ করার ক্ষেত্রে মান এর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক মান সংস্থাগুলো তাদের গবেষণালব্ধ জ্ঞান কাজে লাগিয়ে যথাযথ মানের পণ্য উৎপাদন এবং সেবা প্রদানের সঠিক দিকনির্দেশনা প্রদান করে থাকে।
এসব মানের যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমেই মানুষের চাহিদা প্রত্যাশা অনুযায়ী পূরণ হতে পারে। বাংলাদেশের জাতীয় মান সংস্থা বিএসটিআই সব ক্ষেত্রে জাতীয় মান প্রণয়ন করে পণ্যের গুণগতমান বজায় রেখে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে পারে। এ ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। অন্যদিকে ভোক্তাদের সচেতনতা বৃদ্ধি করাও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
অবশ্য ভোক্তার দায়ও কম নয়। ভোক্তারা যদি সচেতন হন,তাহলে কোনো পণ্য কেনার আগে অবশ্যই এর গায়ে বিএসটিআইয়ের লোগো আছে কিনা তা দেখে নিতে হবে। ভোক্তারা যে পণ্য ভোগ করছে সে সম্পর্কে সচেতন এবং কোম্পানির দিক থেকে উদ্যোক্তাও পণ্য মান বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর হলে তবেই দিবসটি পালনের যথার্থতা রক্ষিত হয়। ভোক্তা-কোম্পানি নির্বিশেষে সবাইকে দিবসটির গুরুত্ব বুঝতে হবে।
বাংলাদেশের জাতীয় মান সংস্থা বিএসটিআই সকল ক্ষেত্রে জাতীয় মান প্রণয়ন করে পণ্যের গুণগত মানের সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে তার সেবা দেশের জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেবে এবং বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আরও আধুনিক, কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন ও দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির লক্ষ্যে দেশের জাতীয় মান সংস্থা বিএসটিআই সকল ক্ষেত্রে জাতীয় মান প্রণয়ন ও মান এর ব্যবহার নিশ্চত করবে-এটাই আমাদের প্রত্যাশা।