‘পরিশ্রম করলে সাফল্য আসবেই’ -কথাটা পুরোপুরি খেটে যায় শামসুর রহমান শুভর বেলায়। গত দুই বছর একাকী অনুশীলনে যে ঘাম ঝরিয়েছেন, ফলাফল দারুণভাবেই পেতে শুরু করেছেন। এনসিএল, বিসিএল, বিপিএল- সবখানেই হেসেছে তার ব্যাট। সামনে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ, মৌসুমের শেষ আসরেও ধারাবাহিকতার ছাপ রাখতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ শামসুর। জাতীয় দলে ফেরার স্বপ্নকে মনের ভেতর লালন করেই হাঁটতে চান সামনের পথ।
ক্রিকেট ক্যারিয়ারে নতুন দিগন্তের সন্ধান পাওয়া ৩০ বছর বয়সী শামসুরকে দলে টেনেছে গাজী গ্রুপ ক্রিকেটার্স। একসময় বাংলাদেশ দলের হয়ে খেলা এ ব্যাটসম্যান মঙ্গলবার চ্যানেল আই অনলাইনকে শোনালেন অক্লান্ত পরিশ্রমের গল্প ও ভবিষ্যৎ ভাবনার কথা। সেইসঙ্গে বিসিবির প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন, জাতীয় দল থেকে বাদ পড়া সম্ভাবনাময় ক্রিকেটারদের অনুশীলনের মধ্যে রাখতে। যাতে কোনো না কোনো সময় প্রয়োজনে তারা দেশের জন্য সার্ভিস দিতে পারেন।
দারুণ ফর্মে আছেন। প্রিমিয়ার লিগ দিয়ে ক্রিকেট মৌসুম শেষ হবে। শেষ আসর নিয়ে লক্ষ্য কী?
মৌসুম শুরু হয়েছিল এনসিএল দিয়ে, সেখানে ভালো ক্রিকেট খেলেছি। শীর্ষ ছয়ে ছিলাম। বিসিএলে সব ম্যাচ খেলার সুযোগ হয়নি। তিনটা ম্যাচ খেলেছিলাম, তাতে আমি চতুর্থ সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। দুঃখের বিষয় ১৫০ রানের ইনিংস খেলার পরের ম্যাচে আমাকে দলে নেয়া হয়নি বা সুযোগ দেয়া হয়নি খেলার। কেনো বাদ পড়েছিলাম তার ব্যাখ্যা আজও পাইনি! তারপর বিপিএল খেললাম, ভালো গিয়েছে। সামনে প্রিমিয়ার লিগ। আসলে এখন নতুন করে নিজেকে সেট করার চেষ্টা করছি। যেটা চলে গেছে সেটা তো চলেই গেছে। ধারাবাহিকতা ছিল শেষ তিনটা ফরম্যাটে, চেষ্টা করবো সেভাবেই আগানোর। যতটুকুই ভালো খেলবো, দলের যাতে উপকারে আসে।
ধারাবাহিকভাবে রান করায় আপনার উপর প্রত্যাশা বাড়ছে। নিজের উপর নিজের প্রত্যাশাও নিশ্চয় বেড়েছে। জাতীয় দলে ফেরার স্বপ্নটা কি উঁকি দিচ্ছে না?
জাতীয় দলে খেলার আশা তো অবশ্যই আছে। জানি না আবার বাংলাদেশ দলে, বাংলাদেশের জার্সি পরে খেলতে পারব কিনা। খেলার জন্য যতটুকু প্রস্তুতি দরকার, সবদিক থেকে চেষ্টা করছি নিজেকে সেভাবে তৈরি করার। একজন পেশাদার ক্রিকেটারের অবশ্যই উচিত, যে ফরম্যাটেই খেলুক না কেনো যাতে সেটি উপভোগ করে। যখন যেটা খেলবে ওই ফরম্যাটের উপরই পুরো মনোযোগ দেয়। জাতীয় দলে সবাই খেলতে পারবে না, সবার সুযোগ হবে না, তবে যেখানেই খেলুক না কেনো, খেলাটাকে যদি উপভোগ করে আর পারফর্ম করে, কোনো না কোনো সময়ে সুযোগটা চলে আসবে। সেটার জন্য প্রতিটা দিন নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে। সেজন্য চেষ্টা করছি। অবশ্যই আশাবাদী। যদি নাও আসে, যে ফরম্যাটে যেখানেই খেলি না কেনো, ভালভাবে শুরু এবং শেষ যেন করতে পারি।
বিপিএলে আপনার ব্যাটিং দেখে মনে হয়েছে নতুন করে জেগে উঠেছেন। ভালো করার পেছনে বিশেষ কিছু কী আছে?
মাঝখানের সময়টায় বিপিএলে যে দল আমাকে নিয়েছে, তারা তেমন সুযোগ দেয়নি। আগের ২ বছরে মাত্র পাঁচটা ম্যাচ খেলেছি। সে হিসেবে বলব, যেরকম সুযোগ পাওয়ার কথা সেটি পাইনি। কিন্তু এবার, সবচেয়ে বড় জিনিস যেটা, তামিম আমাকে যে সুযোগটা করে দিয়েছে বিপিএল খেলার জন্য, সবসময়ই মনে ছিল যিনি সুযোগ করে দিল তার নামের যাতে সুবিচার করতে পারি, তার কথার যাতে সুবিচার করতে পারি, সেদিকেই ফোকাস ছিল।
আর শেষ দুই বছর যেরকম কষ্ট করেছি ভালো ক্রিকেট খেলার জন্য এবং নিজেকে ফিট করার জন্য, আমি ভাগ্যবানও, ভাগ্য আমাকে সহায়তা করেছে নানা সময়ে। তাছাড়া এবারের বিপিএলে আমি জানতাম দলে আমার ভূমিকা কী হবে। আগে থেকেই জানতাম ব্যাটিংঅর্ডার সাফল হবে। পরিশ্রমের কথা যদি বলি, জাতীয় লিগে দলীয় প্র্যাকটিসের পরও বাড়তি প্র্যাকটিস করেছি। বিসিএলেও তাই। যেখানেই সুযোগ পেয়েছি, ব্যাটিং অর্ডার ওঠা-নামা করবে মাথায় রেখে যেটা পারি সেটাই চেষ্টা করেছি। বাড়তি কিছু করতে যাইনি, যা আমি পারি না। যে কারণে ভালো গিয়েছে। এখন লক্ষ্য ধারাবাহিকতা যেন ধরে রাখতে পারি।
ক্রিকেট ক্যারিয়ার এখন নতুন দিগন্তে, এমনটা মনে করেন কিনা?
হ্যাঁ। সবাই ভালো বলছে, ভালো খেলছি বলে। সবাই বলছে শুভ অনেক কষ্ট করেছে, এটাই পাওয়া। এরচেয়ে বেশি আর কী পাবো! কষ্টটা আরও করতে চাই, পরিশ্রমের পরিমাণ আরও বাড়িয়ে দেব। এতেই যাতে খুশি না হয়ে যাই। অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। যখন ছোট ছিলাম অল্পতেই খুশি হয়ে যেতাম, ওই জিনিসটা এখন আর নেই। প্রতিদিনই চাই নিজেকে আরও ভালভাবে আরও নতুন করে ভালো কিছু করার, কিছু জায়গায় উন্নতি করার। সে হিসেবে নিজেকে তৈরি করছি। ভালো লাগছে। সবাই যেন বলতে পারে, শুভ তার নামের প্রতি সুবিচার করছে।
গত দুই বছর যে পরিমাণ কষ্ট করেছি তাতে সামনে আরও ভালো খেলতে পারব। সবাই ঈদের ছুটিতে গিয়েছে, আমি যাইনি। ঈদের পরদিনই একা এসে মিরপুরে প্র্যাকটিস করেছি। সবাই শুক্রবার ছুটি কাটায়, আমি সপ্তাহে সাতদিনই অনুশীলন করেছি। গত ২ বছরে আমি একমাত্র খেলোয়াড় যে প্রতিদিন অনুশীলনে এসেছে। যেটা চলে গেছে সেটা চলেই গেছে। আমার যেটা লক্ষ্য এখন, আমার একটা নাম আছে, নামের যাতে সুবিচার করেতে পারি। আজ কী শিখলাম সেটা মনে রাখা, কাল ভালো কী শিখতে পারি সেদিকে ফোকাস রাখা, এভাবেই চলছি এখন।
শুনেছি তামিম ইকবালের মাধ্যমে আপনি দল পেয়েছেন। আপনার পরিশ্রমের খবর তামিম কীভাবে পেল?
মিরপুরে একা একা অনুশীলন করতাম, তামিম-মুশফিক দেখত। তামিম বলল, যদি সুযোগ হয় চেষ্টা করবো আপনাকে দলে নেয়ার। দলে আসার পর তামিম বলল, ব্যাটিং অর্ডারে একটা জায়গাই খালি আছে সেটা ৫-৬ নম্বরে। নিজেকে ওভাবেই তৈরি করেন, পুরনো বলে অনুশীলনের ব্যাপারটা। ম্যাচ খেলতে নামার পর এসব যেন নতুন মনে না হয়। সে হিসেবগুলো কাজে দিয়েছে। আপনার দায়িত্বটা কী ম্যাচে সেটি জানলে অনেক সহজ হয়ে যায় ব্যাটিং করা। আমার ক্ষেত্রে যেটা হয়েছে আগে থেকেই জানতাম আমার রোলটা কী।
সুনাম ধরে রাখাও তো চ্যালেঞ্জের। আপনাকে ঘিরে প্রত্যাশা বাড়ছে বলেই হয়ত প্লেয়ার্স ড্রাফটে গাজী গ্রুপ শুরুর দিকেই আপনাকে দলে নিয়েছে…
প্রিমিয়ার লিগে সবসময় আমার একটা রোল থাকে। গত আট-দশ বছর ধরে এক থেকে দশের মধ্যে থাকি। সুপার লিগে খেললে টপ ফাইভে থাকি। যে টিমেই খেলি না কেনো, আমার রোলটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ থাকে। আমার প্রতি প্রত্যাশা থাকে অনেক। প্রতিপক্ষ টিমও আমাকে চিন্তা করে। এসব উপভোগ করি। যেখানেই খেলি আমার রানটা যাতে দলের উপকারে আসে, যাতে দল এগিয়ে যায়, এই চিন্তাটা মাথায় থাকে সবসময়। কীভাবে আরও ভালো করা যায় সেটা নিয়ে চিন্তা করছি। সামনের খেলার জন্য আরও ভালভাবে যেন তৈরি করতে পারি। তাহলে হয়ত আমাকে নিয়ে চিন্তা-ভাবনা আসবে যে, এখানে যেহেতু অবদান রাখতে পারছি দেশের জন্যও হয়ত কিছু দিতে পারব, এ বিশ্বাস আসবে।
কুমিল্লার অধিনায়ক বিপিএলে আপনার ব্যাটিং দেখে বলেছেন, কোয়ালিটি ক্রিকেটার রান করলে দেখতে ভালো লাগে। কোচ মোহাম্মদ সালাউদ্দিন বলেছেন, শুভ আরেকটু সিরিয়াস হলে জাতীয় দলেও ফিরতে পারেন। আপনাকে ফ্রি-স্ট্রোক খেলতে জানা ব্যাটসম্যান বলেছেন। এসব মন্তব্য আপনাকে কতটা উজ্জীবিত করছে?
সালাউদ্দিন স্যার যে কথাটা বলেছে বা ইমরুল-তামিম আগে যা বলেছে, থ্যাঙ্কস ফর দেম। যে বিশ্বাস রেখেছে চেষ্টা করেছি সেটা যাতে না ভাঙে। আমি রান করাতে টিমের ভালো হয়েছে। পেরেরা-আফ্রিদির মতো হার্ডহিটাররা কিন্তু শেষ ৬ ম্যাচের মধ্যে ২ ম্যাচে ব্যাটিং পেয়েছে। বাকি ৪ ম্যাচ নামাই লাগেনি। আমি ভাগ্যবান আমার কাজটা করতে পেরেছি। কখনও হাল ছাড়ি না।
বিশ্বাস করি এখন যে ফিটনেস আছে সেটা ধরে রাখতে পারলে আরও সাত-আট বছর খেলার মতো সক্ষমতা আমার থাকবে। তবে আমাদের মতো ক্রিকেটারদের সুযোগও দিতে হবে। আমাকে একা একা অনুশীলন করতে হয়। মিরপুরে অপেক্ষা করতে হয় কখন জাতীয় দল বা এইচপি দল প্র্যাকটিস শেষ করবে। ক্রিকেট বোর্ড যদি জাতীয় দলের বাইরে চলে যাওয়া আমাদের মতো ক্রিকেটারদের সুযোগ করে দেয় বা একাডেমি বা ‘এ’ টিমে ফেরায়, যাদের মাঝে সত্যিকার অর্থেই সম্ভাবনা আছে। তাহলে তারা আবার নতুন করে শুরু করতে পারবে।
এখন অনুশীলন কেবল নিজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। যে অভিজ্ঞতা ১৫-১৬ বছর ধরে অর্জন করেছি সেটা নিয়েই চলছি। বিসিবি যদি সুযোগ করে দেয় টপ লেভেলের কোচদের অধীনে কাজ করার, তাহলে এখন যা করছি তারচেয়ে আরও বেটার করতে পারব। আশা করি সে সুযোগ করে দিলে আমাদের যেমন ভালো হবে, প্রকৃতপক্ষে দেশেরই লাভ হবে। হঠাৎ যদি বাংলাদেশ দলে কোনো শুন্যতা তৈরি হয়, তখন ডাক আসবে সে আশা নিয়ে নিজেকে তৈরি করতে পারব। জাতীয় দলে ঢোকা অসম্ভব কিছু না। নিজেকে সেভাবে তৈরি করতে হবে, আমি ওই জায়গায় খেলার জন্য যথার্থ কিনা সেটাও চিন্তা করতে হবে। যেটি বলছিলাম, বিসিবির টিম বা কোচদের অধীনে কাজ করার যদি সুযোগ আসে আমার পারফরম্যান্স অনেক ভালো জায়গায় নিয়ে যেতে পারব বলে মনে করি।
এভাবে সামনে হাঁটা কতটা কঠিন?
পেশাদার ক্রিকেটারদের জন্য অনেক চ্যালেঞ্জিং। আমরা যারা ঢাকার স্থানীয় ছেলে তাদের অনুশীলনের একটাই জায়গা, মিরপুর। বাংলাদেশ টিম দেশের বাইরে আছে, একাডেমি বা ‘এ’ টিমের প্রোগ্রাম নেই বলে হয়ত এখন অনুশীলন করতে পারছি। এখন যেটা করতে পারছি দুমাস পর করতে পারব না, বসে থাকতে হবে। ওরা যাওয়ার পর বাকিসময় নিজেকে তৈরি করতে হবে। বিসিবি যদি এরকম সিস্টেম করে দেয়, যারা ভবিষ্যতে আরও কিছু বাংলাদেশ দলকে দিতে পারবে, এমন যাদের মনে হবে তাদের বিসিবির কোনো টিমের সঙ্গে যদি প্র্যাকটিস করার সুযোগ দেয় তাহলে আদতে দেশেরই লাভ হবে।
সেটি ছাড়া পর্যাপ্ত অনুশীলনের সুযোগ কোথাও নেই। এনসিএল, বিসিএল, বিপিএল, প্রিমিয়ার লিগ, ঘরোয়া ক্রিকেটের সব আসরই হুট করে শুরু হয়। দলের সঙ্গে তিন-চারদিন অনুশীলন করে ম্যাচে নেমে যেতে হয়। দলে আমার রোলটা কী হবে সেটি বোঝার সময়ও পাওয়া যায় না। যদি পর্যাপ্ত সময় থাকত ঘরোয়া লিগ শুরুর আগে কোচদের অধীনে লম্বা সময়ে কাজ করে মাঠে নামার, তাহলে একটা পথ খোলা থাকত। লিগ আরও প্রতিদ্বন্দিতাপূর্ণ হত। খেলার মান আরও ভালো হত। অনুশীলনের ঘাটতিটাও থাকত না।