‘জন্মের আগেই মৃত্যুকে করেছি আলিঙ্গন… জীবনের বীভৎস রূপ দেখে আমি জন্মের আগেই আমি ক্রন্দনকে গিলে ফেলেছি। আমার প্রথম শয্যাই আমার শেষ শয্যা। মাতৃগর্ভই আমার প্রথম কফিন..কবর..চিতা।’
গুলশানের হলি আর্টিজানে নিহত ইতালিয় নাগরিকের গর্ভের সন্তান মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর স্মরণে জলদ গম্ভীর কণ্ঠে কবি তারিক সুজাতের লেখা পঙক্তি উচ্চারিত হয়। পর্দা সরে যায় মঞ্চের। দেখা মেলে কত্থকের। অভিনেতা-আবৃত্তি শিল্পী জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় উচ্চারণ করছেন সে কবিতা। সূচনাতে বোধে নাড়া দিয়ে যায় বর্বরতার কাব্যিক উপস্থাপন।
শেষ ফাগুনের ছায়ানট মিলনায়তনে সন্ধ্যায় গান-কবিতার ইশতেহার বেজে ওঠে। প্রথমে করুন বাঁশি। তারপর গীটার-কিবোর্ড-তবলা- অক্টোপ্যাড-হারমোনিয়াম-মন্দিরার যন্ত্রানুসঙ্গ। ‘সবারে করি আহবান’ গেয়ে ওঠেন ১৮ শিল্পী। মঞ্চের সবার পরনে লালের দ্রোহী আভাস। তেমনি থাকে ফাগুনের বাসন্তী স্পর্শ। দ্রোহ-প্রেমের সচেতন সম্মিলন যেন। আর মঞ্চের পেছনের পর্দায় আবছায়ায় ঢাকা বনরাজি ছাড়িয়ে বিশাল জোছনাময় চাঁদের বুকে শান্তির কপোতের নৈর্ব্যক্তিক উড়ান বহুমাত্রিক বিমূর্ত রূপকের জন্ম দেয়।
কখনও একক কণ্ঠে গীত হয় ভুপেন হাজারিকার ‘বিস্তীর্ণ দুপারে অসংখ্য মানুষের হাহাকার শুনেও ও গঙ্গা তুমি বইছ কেন?’ কিংবা গীত হয় ‘সকাতরে ঐ কাঁদিছে মলয়ও শোন শোন পিতা’। অথবা সমবেত কণ্ঠে ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তরও পারাবার হে/ লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে যাত্রীরা হুশিয়ার/ হিন্দু-না ওই মুসলিম ওরা জিজ্ঞাসে কোন জন/ কাণ্ডারি বল মরিছে মানুষ সন্তান মোর মার’ নজরুলের গানে অজান্তেই যূথবদ্ধ হয় পুরো মিলনায়তন। আবার কখনও প্রবল ক্ষোভে উচ্চারিত হয় ক্ষণজন্মা অকাল প্রয়াত দ্রোহী কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ‘ইশতেহার’। কাল বিনাশী নিষ্ঠুর সত্য পঙক্তিমালা। কখনও পুরুষ কণ্ঠে, ‘আমরা ভূমিতে কর্ষণ করে শস্য জন্মাতে শিখেছি/ আমাদের নারীরা জমিনে শস্য ফলায়/ আমাদের পুঁজি ও ক্ষমতা অবরুদ্ধ করল আমাদের।’ অথবা উচ্চারিত হয় নারী কণ্ঠে সময়ের সঙ্কটের রূপ পঙক্তিতে পঙক্তিতে, ‘একটার পর একটা খাঁচা নির্মাণ করেছি আমরা/ আজ আমরা একা হয়ে গেছি..প্রত্যেকে একা হয়ে গেছি।’
গান-কবিতার যুগলবন্দীতে ছিলেন তানভীরা আশরাফ শ্যামা, মজুমদার বিপ্লব, শেফতা আলম অদিতি, এনাক্ষী সাহা রায়, নাহিদা রেজওয়ান, রুবা মজুমদার, যীশুরাম সুশীল প্রমুখ।
এর আগে প্রদীপ প্রজ্বলনের মাধ্যমে শুরু হয় ‘বন্দী প্রাণ মন হোক উধাও’। সংস্কৃতি সংগঠন জলতরঙ্গ এর চার বছর পূর্তি অনুষ্ঠান। ফুল এবং উত্তরীয়তে সূচনা করেন নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গীত পরিচালক সুজেয় শ্যাম। সংগঠনের সভাপতি মাসুদা খান ইতি এবং সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন তপন উদ্বোধনী পর্ব পরিচালনা করেন।
অনুষ্ঠানের উদ্বোধনে রামেন্দু মজুমদার বলেন, ‘কথা যত কম হয়-এ ধরণের অনুষ্ঠান তত আনন্দময় হয়ে ওঠে। তাদের অনুষ্ঠান তাদের সুরুচির পরিচায়ক। যা আজকের সময়ে বেশ বিরল। তাদের নিষ্ঠা পূর্ণ সংস্কৃতি অনুশীলন রুচির উন্নয়ন ঘটাবে বলে আমি বিশ্বাস করি। সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে সকল অন্ধকার দূরে যাবে বলে আশা করি।’
সঙ্গীত এবং কাব্য সাহিত্য নিয়ে কাজ করে চলেছে জলতরঙ্গ। পুরনো দিনের গান কবিতা নিয়ে শ্রোতার আসর আয়োজন এবং প্রকাশনা করছে তারা নিয়মিত ভাবে।
টানা দু’ঘণ্টার অনুষ্ঠানের মাঝে একবার বিদ্যুৎ চলে গেলেও থামেনি জলতরঙ্গ। বরং তাদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়েছে পুরো মিলনায়তন। জীবনের ইশতেহারের জলতরঙ্গ রুখবে এমন সাধ্য কি সময়ের আছে? ছিলনা কোনদিন।