আগামী ১৯ এপ্রিল নিউ ইয়র্কের প্রাইমারি নির্বাচন নিয়ে রীতিমত আমেরিকান রাজনীতি উত্তপ্ত! গেল সপ্তাহ অবশ্য অধিক আলোচনায় থেকেছে তুলনামূলক ডেমোক্র্যাটই বেশী। দীর্ঘদিন পর রিপাবলিকানদের উত্তেজনা ছাপিয়ে এবার ডেমোক্র্যাট। এর শুরুটা জানা যায়, যখন বার্নি স্যান্ডার্স গত সপ্তাহের শুরুতেই ঘোষণা দিলেন হিলারি ক্লিন্টন প্রেসিডেন্ট হওয়ার অযোগ্য (আনকোয়ালিফাইড)।
ডেমোক্র্যাটরা এতদিন দাবি করে আসছে তারা রিপাবলিকানদের মতো নিম্ন-রুচির নন। তাদের একটা মান আছে। শেষ পর্যন্ত তাদের সেই দাবি থাকলো না। ৭৪ বছরের স্যান্ডার্সকে মনে হলো তিনি আচরণে যথেষ্টই রিপাবলিকানদের মতো।
হিলারি অবশ্য প্রতিক্রিয়া জানাতে স্যান্ডার্সের মতো আক্রমণাত্মক না হয়ে বললেন, জানি না কেন স্যান্ডার্স এমন করে শুরু করলেন।’
যদিও এরআগে একজন স্যান্ডার্স সমর্থক হিলারিকে কর্পোরেট অর্থ গ্রহণের কথা জিজ্ঞাসা করায় তিনি তাৎক্ষনিক রেগে বলেছিলেন, স্যান্ডার্স ক্যাম্পেইনের এইসব মিথ্যা শুনতে শুনতে তিনি এখন ক্লান্ত। সেই থেকে স্যান্ডার্স ক্রুদ্ধ ছিলেন। কিন্তু বলা হচ্ছে এর সঙ্গে একাধিক নানা বিষয় জড়িত। যা পেছনের রহস্য বলে খ্যাত।
কিন্তু এসবের শুরু হয় ওই নিউইয়র্কের প্রচারণা ঘিরেই। আগের একটি প্রাইমারি আর ৭টি ককাসে স্যান্ডার্স জয়ী হয়েছেন। বলা হচ্ছে তার উত্তেজিত ক্যাম্পেইন দলের কারণেই এ জয়।
নিউইয়র্ক নির্বাচন নিয়ে করা জরিপে হিলারি এগিয়ে থাকায় তাদের ওপর স্নায়ু-চাপও রয়েছে। কারণ বার্নির ওইসব জয়গুলো কথিত মোমেন্টাম হিসেবে প্রচুর গণমাধ্যম প্রচারণা পেলেও প্রকৃত অর্থে স্যান্ডার্সের প্রার্থিতা নিশ্চিতে প্রতিনিধি সংখ্যা বিচারে তেমন কার্যকরী নয় তা তারা জানে। ফলে একটা স্নায়ু-চাপ ছিল। অার এই পরিস্থিতিতেই হচ্ছে নিউইয়র্কের নির্বাচন।
যেখানে প্রতিনিধি সংখ্যা স্যান্ডার্সের এতসব বাহারি বিজয়ের চেয়েও অনেক বেশী। এতে আবার হিলারির জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অতএব স্যান্ডার্স তার নির্বাচনই প্রচারণায় হাজির হলেন প্রয়োজনাতিরিক্ত উদ্যম-উদ্দীপনা নিয়ে। নিউইয়র্ক গণমাধ্যমের রাজধানী বলে খ্যাত, স্যান্ডার্স সব গণমাধ্যম ‘জন-সংযোগ’ করবেন এবং যেহেতু হিলারি অফিসিয়ালি এখন নিউইয়র্ক অধিবাসী তাই পরিকল্পনা করলেন তার নিউইয়র্কের শেকড়ও ঢালাও ভাবে বাজারজাত করবেন।
তারই অংশ হিসাবে তিনি ডেইলি নিউজের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বসেন। যেহেতু তিনি ওয়ালস্ট্রিট, ব্যাঙ্ক, কর্পোরেট, ইত্যাদি বিরোধী বলেই জনগণ তার দিকে ছুটছে সেই বিষয়ে তাকে প্রশ্ন করা হয়-“ব্যাংকের বিরুদ্ধে কিভাবে ব্যবস্থা নেয়া হবে?” এই প্রশ্নের উত্তর বার্নি ঠিক মতো দিতে পারেননি, অস্পষ্ট ও ইতস্তত ছিলেন। ডেইলি নিউজ এর পরদিন সেটাকে বড় করে সংবাদ প্রকাশ করলো এই বলে যে তার নিজেরই ধারণা নাই তিনি কিভাবে ওই সমস্যা মোকাবেলা করবেন।
এরপর বার্নির ওই বিষয়ে হিলারিকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, বার্নির এইসব বিষয়ে মনে হচ্ছে পর্যাপ্ত ‘হোম-ওয়ার্ক’ করা নেই। যেহেতু বার্নি এবং তার প্রচারণা দল ক্ষিপ্ত ছিলেন তাই তারা এই ঘটনাকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা দিলেন। বললেন বার্নির প্রেসিডেন্ট হওয়ার যোগ্যতা নেই। এটা হিলারি বলেছে। তাই বার্নি আর ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে নয়, সোজা বলে দিলেন যে, হিলারি আনকোয়ালিফাইড।
যদিও তিনি ২৪ ঘণ্টা আগেই তার এই মন্তব্য ফিরিয়ে নিলেন গণমাধ্যমের চাপে। বিশেষ করে আমেরিকার সর্বাধিক লিজেন্ড সাংবাদিক চার্লি রোজের চাপে। চার্লি রোজ ওই দিন তাকে অন্তত এই একই প্রশ্ন একাধিকবার করেন এবং এক পর্যায়ে তা প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হন। পরের প্রতিটি সাক্ষাৎকারে তার ওই মন্তব্য ফিরিয়ে নেয়ার ঘোষণা দিয়ে যেতে থাকেন বার্নি।
তাই ওই আক্রমণাত্মক নীতি যতো না পক্ষে কাজ করছে, তার চেয়ে বেশি গেছে বিপক্ষেই।আসল কারণ হলো তিনি এবং তার দল জানে যে হিলারিকে ঠকিয়ে বেশী প্রতিনিধি পেয়ে তার মনোনয়ন গাণিতিকভাবে এখনো প্রায় অসম্ভব। তিনি যদি এখন থেকে জিততেও থাকেন তাতেও প্রায় অসম্ভব, কেননা সুপার ডেলিগেটদের তাকে ভোট দেয়ার কথা নয়। সেভাবেই দলীয় প্রভাব বিস্তারের ব্যবস্থা দলে করে থাকে। এবং বার্নি ওই অর্থে একজন ডেমোক্র্যাট দলে বহিরাগত। ডেমোক্র্যাট দল সেটা নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য করে না, যেমনটি রিপাবলিকানরা ডোনাল্ডের বিরুদ্ধে করেছে।
যেহেতু বার্নি ক্রমাগত জয়ী হচ্ছে যদিও এখনো তা হিলারির জন্য হুমকি নয়; তাই সে নিয়ে তেমন হৈ চৈ নেই। তারপরও ক্লিনটনের দীর্ঘদিনের উপদেষ্টা, ডেমোক্র্যাট স্ট্র্যাটেজিস্ট জেমস কারভেল হঠাৎ করে মাঠে নামলেন। এম.এস. এনবিসিকে বললেন, এইরকম যে কেউ যদি ব্যাখ্যা করতে পারেন যে ডেমোক্র্যাট পার্টি কেন এমন একজনকে মনোনয়ন দেবে যে ডেমোক্র্যাট নন। পরের দিন হিলারিও এর প্রতিধ্বনি করেছেন, কিন্তু খুব দূর থেকে। বার্নির জন্য সামনে এই সমস্যাটা আসছে। তিনি তা জানেন। ফলে এই সপ্তাহটা তার জন্য ওইভাবে এলোমেলো গেলো।
এছাড়াও তার প্রচারণা এত আবেদন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে তার কারণ ‘ওয়াল স্ট্রিট’ এবং ‘কর্পোরেট ওয়ার্ল্ডকে’ তিরস্কার করে। কিন্তু গত সপ্তাহেই প্রথমবারের মতো একজন কর্পোরেট কর্তা বার্নির অভিযোগের উত্তর দিলেন জি.ই.’র সি.ই.ও. জেফ্রি ইমেল্ট ওয়াশিংটন পোস্টের মাধ্যমে। তিনি বলেছেন, জি.ই. ১২৪ বছরের ইতিহাসে কোন সোশালিস্টরা তাদের টার্গেট করেনি কারণ আমাদের বাণিজ্য সব অর্থে জনস্বার্থেই নিবেদিত টাইপ।
যতো দিন যাচ্ছে ট্রাম্প ততো নিজের সম্ভাবনা সম্পর্কে সন্দিহান হচ্ছেন। কেননা রিপাবলিকান দলীয় প্রাতিষ্ঠানিক বিরোধিতা তার জন্য মোকাবেলা করা কষ্টকর হচ্ছে। তিনি আগে জানতেন না যে দল কিভাবে কাজ করে। এখন দেখতে পাচ্ছেন তিনি অনেক ক্ষত্রে ভোট বেশি পেয়েও প্রতিনিধি সংখ্যা কম পাচ্ছেন। এর প্রধান কারণ দলীয় নীতি অনুযায়ী অনেক ক্ষেত্রে সাধারণ ভোটারদের ভোটে যতো প্রতিনিধি নির্বাচিত হবে তার চেয়ে বেশী প্রতিনিধি একজন প্রার্থী পাবে তার দলীয় সদস্যদের ভোটে। ফলে সাধারণ ভোটারদের ভোটের চেয়ে দলের হাতে ক্ষমতা থাকে তাদের মতো করে প্রতিনিধি নির্বাচনের। যার অধিকাংশই ডোনাল্ডের নয়।
যেমন সামনে আসছে পেনসিলভেনিয়াতে নির্বাচনে রিপাবলিকান দলের রয়েছে মোট ৬১ প্রতিনিধি। এবং সেখানে জরিপে দেখা যায় ডোনাল্ড ট্রাম্প এগিয়ে রয়েছেন। কিন্তু তিনি জিতলেও তার ভাগে পরবে মাত্র ১৭ জন প্রতিনিধি কেননা দলীয় আইনানুযায়ী বাকী ৫৪ জন হবে ‘আনবাউন্ড’ অর্থাৎ তার মুক্ত থাকবে। ফলে এর অর্থ ডোনাল্ডের জন্য আর থাকবে না। কারণ তারা সবাই দলের লোক, দলীয় নিয়মে নির্বাচিত প্রতিনিধি হয়ে আসেন এবং মূল কনভেনশনে এদের ভোট যায় দলের পরামর্শের লোকটির দিকে। সেই অর্থে অন্তত ডোনাল্ড এদের ভোট পাবেন না।
এই অবস্থাটি সম্মুখীন হওয়ার জন্য ডোনাল্ডের অপরিসীম ব্যর্থ থাকায় গত সপ্তাহে তার নির্বাচনী ক্যাম্পেইন নতুন করে এনেছেন প্রখ্যাত রিপাবলিকান স্ট্র্যাটেজিস্ট পল ম্যানাফোর্টকে। যার পুর্বাভিজ্ঞতা রয়েছে প্রেসিডেন্ট ফোর্ড থেকে, রেগান, বুশ ও সাবেক প্রেসিডেন্ট প্রার্থী বব ডোলের নির্বাচনী উপদেষ্টা হিসাবে কাজ করবার। বলা হয়ে থাকে পল ম্যানাফোর্টকে কেবল ওই রিপাবলিকান দলীয় ব্যবস্থাটা দেখবার জন্যই নেয়া হয়েছে।
রিপাবলিকান কনভেনশনে রয়েছে সম্পূর্ণ তৃতীয় পক্ষের প্রস্তাবনা। অর্থাৎ এখনো পর্যন্ত যে তিন জন আছেন- ডোনাল্ড ট্রাম্প, টেড ক্রুজ এবং জন কেসিক এদের কাউকেই মনোনয়ন না দিয়ে একবারে বাইরে থেকে আসা প্রার্থীকেও দেয়া হতে পারে। সে তালিকায় আছেন বর্তমান স্পিকার পল রায়ান। এক রাজনৈতিক বিশ্লেষণ জরিপে তার সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে অর্ধেকের বেশী। সেখানেই আবার ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং টেড ক্রুজ একাত্ম। তারা চাইবেন যারা ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন তাদের ভেতর থেকে একজন হোক।
এই সপ্তাহান্তের সবচেয়ে উত্তপ্ত বিষয় ছিল, বোস্টন গ্লোব পত্রিকার কাল্পনিক প্রথম পাতা। যেখানে ডোনাল্ড প্রেসিডেন্ট হলে এইদিনে কি শুরু হবে তার একটি নমুনা, পত্রিকাটির জন্য কী ধরনের সংবাদ তাদের পরিবেশন করতে হবে! ডোনাল্ডের সপ্তাহের শুরুর দিনটা গেছে বোস্টন গ্লোবকে গালাগালি করে এবং আরো গালাগালি তাকে দিতে হয়েছে রিপাবলিকান পার্টির প্রতিনিধি নির্বাচনের পদ্ধতিকে, কেননা তিনি ক্রমাগত সেই নিয়মে হেরে যাচ্ছেন দলীয় প্রাতিষ্ঠানিকতার কাছে।