বলিউডের ছবি ‘পা’ অথবা হলিউডের ‘কিউরিয়াস কেস অব বেঞ্জামিন বাটন’ যারা দেখেছেন, তারা জানেন, চলচ্চিত্রগুলোর কেন্দ্রীয় চরিত্র ছিল এক শিশু, যার জন্মই হয়েছে বৃদ্ধ অবস্থায়। যখন বয়স আট-দশ বছর, তাকে দেখতে মনে হয়েছে বয়সের ভারে নুয়ে পড়া এক বৃদ্ধ।
এবার চলচ্চিত্রে নয়, বাস্তবেই দেখা মিলল অকালে বুড়িয়ে যাওয়া এমনই এক শিশুর, যার জন্ম বাংলাদেশেই।
দক্ষিণাঞ্চলের মাগুরার অধিবাসী ৪ বছরের শিশু বায়েজিদ হোসেনের মুখটা সারাক্ষণ ফুলে থাকে। তার চোখ গর্তে ঢোকা, ঝুলে থাকা চামড়া, অস্থিসন্ধিতে ব্যথা, প্রস্রাবে সমস্যা। এমনকি এখনই তার দাঁতের গোড়া দুর্বল হয়ে গেছে। কিছু দাঁত নড়বড়ে, কিছু ভাঙ্গা।
প্রোজেরিয়া নামের বিরল এক রোগে শিশুটির এই দশা বলে ধারণা ডাক্তারদের। এই রোগে মানবদেহের বয়স স্বাভাবিকের চেয়ে ৮ গুণ দ্রুত বাড়ে। এই রোগটি থেকে প্রেরণা নিয়েই বলিউড-হলিউডের অরো আর বেঞ্জামিন বাটন চরিত্রের আবির্ভাব।
তবে এতকিছু বোঝে না বায়েজিদের প্রতিবেশীরা। বড়রা সবসময় তার থেকে দূরে দূরে থাকে। আর অন্য বাচ্চারা কাছে ঘেঁষতে ভয় পায়। অথচ বায়েজিদের বাইরেরটাই শুধু এমন। তার মানসিক দক্ষতা ও বুদ্ধিমত্তা সমবয়সী বাচ্চাদের চেয়েও বেশ উন্নত।
প্রোজেরিয়ায় আক্রান্ত রোগীরা সাধারণত ১৩ বয়সের মধ্যেই হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকে মারা যায়। এই রোগ ছাড়াও বায়েজিদের কিউটিস লাক্সা নামের আরেকটি বিরল রোগ আছে। এই রোগে আক্রান্তের ত্বক ঝুলে ভাঁজ ভাঁজ হয়ে থাকে।
বায়েজিদের মা তৃপ্তি খাতুন ব্যথাতুর কণ্ঠে বলেন, সন্তানের বুদ্ধি তাকে মুগ্ধ করে। কিন্তু ছেলের চেহারা দেখে তার মন ভেঙ্গে যায়। তিনি জানান, বায়েজিদ তিন বছর বয়সে হাঁটা শিখলেও তিন মাস বয়সেই তার দু’পাটিতেই সবগুলো দাঁত ছিল।
বায়েজিদ তৃপ্তি খাতুনের প্রথম সন্তান। ২০১২ সালে একটি সরকারি হাসপাতালে তার জন্ম হয়। জন্মের পর বায়েজিদকে দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে পুরো পরিবার। তার শরীরে কোনো চামড়া ছিল না। ছিল শুধু হাড়-মাংস। ডাক্তাররাও তাকে দেখে বুঝতে পারছিলেন না সমস্যাটা কী।
এর কয়েকদিন পরই ছেলেকে নিয়ে তৃপ্তি আর তার স্বামী লাভলু হোসেন বাড়ি ফিরে এলে পুরো গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে তাদের ঘরে এক অস্বাভাবিক শিশুর জন্ম হয়েছে। তখন থেকেই বায়েজিদকে দেখতে তাদের বাড়ির বাইরে লোকজনের ভীড় জমে যায়। সময়ের সাথে সাথে তাদের ভীড়ও কমে যায়। তবে স্থানীয় পর্যায়ে কারও কাছ থেকে কোনো রকম সহায়তাই তারা পাননি বলে জানান।
দিনমজুর লাভলুর মাসিক আয় ৫ হাজার টাকা। কিন্তু গত চার বছরে বায়েজিদের চিকিৎসায় ৪ লাখেরও বেশি অর্থ চলে গেছে। এখনো কোনো ডাক্তার তাদের কোনো সুখবর শোনাতে পারেননি বায়েজিদের ব্যাপারে। শুধু ডাক্তার না, পীর-ফকির, ওঝা, মাজার – যে যখন যার কথা বলেছে ছেলেকে সুস্থ করতে সেখানেই ছুটে গেছেন তৃপ্তি আর লাভলু। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। বরং অবস্থা দিন দিন আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে।
বায়েজিদ ১৫ বছর বয়সের বেশি হয়তো বাঁচতে পারবে না – এমনটাই আশঙ্কা করছেন মাগুরা কেন্দ্রীয় হাসপাতালের কনসালটেন্ট দেবাশীষ বিশ্বাস। তবুও আরও ভালো চিকিৎসার আশায় তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল বা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।