আমাদের গ্রামে ডিশ সংযোগ ব্যাপকভাবে ছড়াতে শুরু করে ২০০০ সালের দিকে। ১৭ ইঞ্চির রঙিন প্যানাভিশন টিভিতে সবচেয়ে স্বচ্ছ চ্যানেল বলতে, চ্যানেল আই। সকালে তৃতীয় মাত্রা (পুন:প্রচার), সাড়ে ১২টায় তারকাকথন, দুপুর-সন্ধ্যা-রাতে চ্যানেল আই সংবাদ। এত বেশি সংবাদ দেখা হত যে সব রিপোর্টারের নাম, পিটিসি দেওয়ার ঢং মনের মাঝে গেঁথে থাকতো। খুব মনোযোগ দিয়ে দেখতাম মাহবুব মতিন ভাইয়ের রিপোর্ট। সেই মানুষটির সঙ্গে আমার পরিচয় হলো ২০০৫ সালে।
ন্যাশনাল আইডিয়াল কলেজে ভর্তি হওয়ার হওয়ার সুবাদে ২০০৪ সাল থেকে আমার ঢাকায় বসবাস। এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষে উঠতেই সুযোগ এল টিভি রিপোর্টিং বিষয়ক একটি কর্মশালায় অংশগ্রহণের। স্ক্রিপ্ট, পিটিসি, জুম ইন, জুম আউটের সঙ্গে পরিচয় হল তখনই। ধানমন্ডির অরণী বিদ্যালয়ে অডিশন নিলেন মাহবুব মতিন। তার সঙ্গে ছিলেন বাংলাদেশ বেতারের একজন, আর একজন তরুণ নাট্য নির্মাতা। প্রায় ৪০ জনের মধ্যে টিকলাম আমরা ১৪ জন। অপেক্ষমান তালিকা থেকে যোগ হল আরও ৩টি নাম। একদল তরুণ-তরুণী। তাদের মধ্যে কয়েকজন ‘ও’ লেভেলে পড়ে। কয়েকজন এসএসসি পাশ করে এসেছে। কয়েকজন এইচএসসি প্রথম বর্ষের। প্রশিক্ষণার্থীদের মধ্যে আমিই ছিলাম সবার সিনিয়র।
কর্মশালার আয়োজক ছিল চিলড্রেন্স ফিল্ম ক্লাব অব বাংলাদেশ, সিএফবি। যার সভাপতি প্রয়াত মাহবুব মতিন (চ্যানেল আই সংবাদে যুগ্ম বার্তা সম্পাদক )। তিনিই কর্মশালা পরিচালনা করতেন। সপ্তাহে চারদিন ক্লাস হতো। ক্লাস নিয়েছেন আনোয়ার সাদী, শারমিন রিনভী, শিহাব সুমন, শাহনাজ মুন্নীসহ তখনকার তারকা গণমাধ্যমকর্মীরা। ২-৩ দিন ক্লাসে আসতেন মাহবুব মতিন। ‘মতিন ভাইয়া’ বলতে অজ্ঞান আমরা। তার চশমার ফাঁক গলে চাহনি দেখে আমরা পুলকিত হতাম, শিশুসুলভ আচরণ করেই আমাদের দিতেন নিউজের প্রাথমিক জ্ঞান। সহজ, সরল ছিল তার বোঝানোর ধরণ। সাংবাদিকতা নিয়ে মজার মজার গল্প শোনাতেন। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে কীভাবে ছিনতাইকারীর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন সেই গল্প। সন্তানের নাম কী রাখবেন সেটি নিয়েও ক্লাসে আমাদের সঙ্গে আলোচনা করতেন, নাম আহ্বান করতেন। রবীন্দ্র সরোবরে ছোট ছোট টুলের উপর গোল করে বসিয়ে নানরকম গল্প শোনাতেন। কোনোদিন চা, কোনোদিন ফুচকা বা চটপটি খাওয়াতেন।
মাহবুব মতিন ভাই সিএফবির’র অধীনে যত প্রশিক্ষণার্থী আছে সবাইকে দাওয়াত করলেন ১ অক্টোবর চ্যানেল আইয়ের জন্মদিনে যাওয়ার জন্য। চ্যানেল আই কার্যালয় তখন সিদ্ধেশ্বরীতে। আমরা দল বেঁধে ফুলের ডালি সাজিয়ে জন্মদিনের অভিনন্দন জানাতে গেলাম। চ্যানেল আই’র পরিচালক ও বার্তা প্রধান শাইখ সিরাজের হাতে ফুলের ডালি। এমন অসংখ্য ডালিতে সাজানো চ্যানেল আই ভবন। ছোট্ট কার্যালয়ে বিশাল বড় কেক দেখে আমরা খুব অবাক হয়েছিলাম সেদিন। দেশের প্রায় সকল সেলিব্রেটি, সংস্কৃতিকর্মীকে এক ছাদের নিচে দেখেছিলাম।
মাহবুব মতিন ভাই তার বেশ কয়েকজন সহকর্মীর সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। তার মধ্যে অন্যতম দুটি নাম আদিত্য শাহিন ও অপু মাহফুজ। উৎসবমুখর একটি বিকেল কাটালাম আমরা সবাই। ১ অক্টোবর তো আমারও জন্মদিন। পাশের আমেরিকান ফাস্ট ফুড থেকে চকলেট কিনে খাইয়েছিলাম সবাইকে। মাহবুব মতিন ভাই সেদিন খুব অবাক হয়েছিলেন। হওয়ারই কথা। কাকতালীয় হলেও ১ অক্টোবর আসলেই তো আমার জন্মদিন। আমেরিকান ফাস্ট ফুডে বসে আড্ডা হল, খাওয়া দাওয়া হল। সন্ধ্যা সাতটার খবরে আমাদের বেশ গুরুত্ব দিয়ে দেখানো হল। আমরা স্বপ্ন দেখতে লাগলাম, কখনও মিডিয়াতে কাজ করবো। স্বপ্ন দেখার শুরুটা যার মাধ্যমে সেই মাহবুব মতিন আমাদের সবাইকে ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে গেছেন ২০০৯ সালের ১০ অক্টোবর।
আজ এত বছর চ্যানেল আইয়ের জন্মদিন উদযাপন করব চ্যানেল আই পরিবারের একজন হয়ে তেজগাঁও কার্যালয়ে। চ্যানেল আই অনলাইনের রিপোর্টার হিসেবে কাজ করার সুযোগ পেয়ে আমিও এখন এই পরিবারের গর্বিত সদস্য। চ্যানেল আই সংবাদের যখনই কাউকে দেখি মাহবুব মতিন ভাইয়ের কথা মনে পড়ে। ভাবি তাদের সঙ্গেই তো কাজ করতেন মাহবুব মতিন ভাই।
উনি মারা যাওয়ার খবরটা পাই গ্রামের বাড়িতে বসে। কর্মশালায় অংশ নেওয়া মাইশা, পিংকি, শবনম, এস্ট্রেলা, দ্বীপ, সাইখদের কান্না দেখেছিলাম চ্যানেল আই সংবাদে। টিভিতে চোখ রেখে সেদিন খুব কেঁদেছিলাম। মৃত্যুর খবরগুলো পত্রিকার পাতা কেটে সংগ্রহে রেখেছি। সংগঠনের কারও সঙ্গেই আর দেখা হয়নি। ২০০৫ সালের সেই কর্মশালার কো-অর্ডিনেটর রিপন রহমান ভাইকে এত বছর পর হঠাৎ আবিষ্কার করলাম চ্যানেল আইয়ের কার্যালয়ে। ২০০৫ সাল থেকেই চ্যানেল আইয়ের অনুষ্ঠান বিভাগের কর্মী তিনি। বটতলা, সিড়িতে বা ডেস্কের সামনে তার সঙ্গে যখন দেখা হয় মনে পড়ে মাহবুব মতিন ভাইকে, সেই সংগঠন আর কর্মশালার সবাইকে।
চ্যানেল আইয়ের ১৯ বছরে পদার্পণের গৌরবের সঙ্গে নিশ্চয়ই জড়িয়ে থাকবেন চ্যানেল আইয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন সংবাদকর্মী মাহবুব মতিন। সৃষ্টিশীল মানুষেরা না থেকেও এভাবেই হয়ত মানুষের মনে বেঁচে থাকেন। এখনও ভাবি, এক যুগ আগে মাহবুব মতিন ভাই চ্যানেল আইয়ের জন্মদিনে না নিয়ে গেলে হয়তো মিডিয়া সম্পর্কে জানাই হতো না।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)