জনসন অ্যান্ড জনসন বেবি পাউডারে ক্যান্সারের উপাদান ‘অ্যাসবেস্টস’ থাকায় যুক্তরাষ্ট্র, কানাডার মতো উন্নত দেশগুলোতে নিষিদ্ধ করা স্বত্ত্বেও বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কার মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এখনও এসব পণ্য আমদানী ও বিক্রি চলছে। বাংলাদেশে জনসন অ্যান্ড জনসন বেবি ট্যালকম পাউডারে অ্যাসবেস্টস রয়েছে কিনা তা পরীক্ষা করা দরকার।
শনিবার বিষয়টি নিয়ে অনলাইন প্লাটফর্ম জুম এ মিডিয়া ব্রিফিংয়ের আয়োজন করে এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (এসডো)।
সংগঠনটি বলছে, যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডা জনসন অ্যান্ড জনসন কোম্পানির বেবি পাউডারে ‘অ্যাসবেস্টস’ নামক ক্যান্সারের উপাদান উপস্থিতির কারণে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশে এখনও এ বিষয়ে যথেষ্ট পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই। বাংলাদেশে যথেষ্ট পরীক্ষাগার সুব্যবস্থা নেই। পরীক্ষা করতে বাংলাদেশ প্রতিবেশি দেশের সাহায্য নিচ্ছে যেখানে এইসব পণ্যের পরীক্ষা করা যায়।
দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ভারতে বেবি পাউডার পরীক্ষা করে, এতে ফরমালডিহাইড এর মত ক্যান্সার উৎপাদনকারী বিষাক্ত উপাদান পাওয়া গেছে। ভারতে দু’টি ফ্যাক্টরিকে জনসন অ্যান্ড জনসন এর জন্য কাঁচামাল উৎপাদন স্থগিত করা হয়েছে যখন পর্যন্ত এটা পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ হয় যে, সেসব কাঁচামাল অ্যাসবেস্টস ফরমালডিহাইড মুক্ত। শ্রীলঙ্কাও একই কারণে এসব পণ্য আমদানী স্থগিত করেছে।
বাংলাদেশ এখনও এ বিষয়ে যথেষ্ট ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এমএফ কনজুমার্স বাংলাদেশে জনসন অ্যান্ড জনসন ও অন্যান্য নামকরা পণ্যের অন্যতম আমদানীকারক। ভারত থেকে বাংলাদেশী ফার্মগুলো এসব পণ্য আমদানী করছে। উন্নত বিশ্বের এসব নিষিদ্ধ পণ্য বিক্রির জন্য তারা বেছে নিচ্ছে উন্নয়নশীল এবং তৃতীয় বিশ্বের মত দরিদ্র দেশগুলো।
আলোচনায় বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্স অ্যান্ড টেস্টিং ইন্সিটিউট-বিএসটিআই এর কেমিক্যাল ডিভিশনের সাবেক চেয়ারম্যান এবং এসডো’র টেকনিক্যাল উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আবুল হোসেন জানান যে, “বাসেল কনভেনশনের যে সদস্য দেশগুলি অ্যাসবেস্টসযুক্ত পণ্য আমদানী নিষিদ্ধের দাবী জানায়, তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। যদিও বাংলাদেশের “আমদানী নীতিমালা”র অধীনে যে রাসায়নিক উপাদানের তালিকা রয়েছে, তাতে অ্যাসবেস্টসযুক্ত পণ্য অর্ন্তভূক্ত নেই। বাংলাদেশ সরকার ও কর্তৃপক্ষকে বর্তমান পরিস্থিতিকে গুরুত্বের সাথে দেখা উচিত।”
এসডো বলছে, সাধারণত ট্যালকম পাউডার ব্যবহারে ত্বক ফর্সা ও উজ্জ্বল দেখায় এবং ঘামাচি হলে পাউডার ব্যবহারে আবাম পাওয়া যায়। শিশুদের গায়ের ঘামাচি রোধে এবং দীর্ঘক্ষণ ডায়াপার ব্যবহারে শিশুর ত্বক সুরক্ষিত রাখতে ট্যালকম পাউডারের ব্যবহার অন্যতম। শিশুদের ট্যালকম পাউডারের মধ্যে জনসন অ্যান্ড জনসন বেবি পাউডার সবচেয়ে জনপ্রিয়।
বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্স অ্যান্ড টেস্টিং ইন্সিটিউটের (বিএসটিআই) উপ-পরিচালক জোহরা শিকদার বলেন, “জনসন অ্যান্ড জনসন কোম্পানীর প্রসাধনী’র বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে বিএসটিআইকে তাদের বেবি প্রোডাক্টগুলি পরীক্ষা করা উচিত এবং স্থানীয় কোন ট্যালকম পাউডারের সাথে জনজন অ্যান্ড জনসন বেবি পাউডারের উপাদানের মান তুলনা করে দেখা উচিত। অন্যদিকে, অ্যাসবেস্টস-এর আমদানী ও বিক্রি বন্ধে অ্যাসবেস্টসযুক্ত পণ্য “আমদানী নীতিমালা’য় সংযুক্তি-৩ এর আওতায় আনা উচিত।”
এসডো বলছে, “ট্যাল্ক”, এক ধরণের প্রাকৃতিক খনিজ, যা থেকে ট্যালকম পাউডার তৈরি করা হয়। বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে ট্যালকম পাউডারে অ্যাসবেস্টস নামের আরেক খনিজ গুড়া পাওয়া যাচ্ছে। অ্যাসবেস্টস নামের খনিজ, ট্যাল্ক খনিজের সাথেই উৎপন্ন হয়। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে গবেষণায় পাওয়া যায় যে, অ্যাসবেস্টস-এ ক্যান্সার উৎপাদনকারী বিষাক্ত উপাদান রয়েছে।
এসডো’র নির্বাহী পরিচালক সিদ্দীকা সুলতানা জানান, “বর্তমান মহামারী পরিস্থিতি বিশ্বকে প্রায় নিশ্চল করে দিয়েছে। কিন্তু এসডো এসব ট্যালকম পাউডার আসলেই বিষাক্ত কি না তা জানতে, এবং ল্যাব পরীক্ষার ব্যাপারে সরকার যাতে যথাযথ পদক্ষেপ নেয় সে চেষ্টা চালিয়ে যাবে।”
এসডো আরও জানায়, জনসন অ্যান্ড জনসন কোম্পানীর পাউডার পরীক্ষায় উচ্চ মাত্রায় অ্যাসবেস্টস এর পাশাপাশি অন্যান্য ক্যান্সার উৎপাদনকারী বিষাক্ত উপাদান পাওয়া যায়। এরপরই যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডায় জনসন অ্যান্ড জনসন কোম্পানীর ট্যালকম পাউডার উৎপাদন বন্ধ করা হয়েছে এবং যে পরিমাণ পণ্য মজুদ আছে তা শেষ না হওয়া পর্যন্ত বিক্রির অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তখন জনসন অ্যান্ড জনসন কোম্পানী বৈশ্বিক বাজারে এসব পণ্য বিক্রির পরিকল্পনা করেছে। এর মাধ্যমে এই দূষণ থেকে শুধুমাত্র উন্নত দেশগুলিই মুক্ত থাকবে কিন্তু উন্নয়নশীল এবং দরিদ্র দেশগুলিতে তারা তাদের ব্যবসা বজায় রেখেছে। এভাবেই সারা বিশ্ব এই দূষণে ঝুঁকির মুখে পড়ে যাচ্ছে।
এনভায়রনমেন্ট এন্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (এসডো) মহাসচিব ড. শাহরিয়ার হোসেন চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ‘‘জনসন অ্যান্ড জনসন বেবি পাউডার ব্যবহারে কি ধরণের স্বাস্থ্য ঝুঁকি দেখা দিচ্ছে, সে সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করাই এই প্রতিবেদনের অন্যতম উদ্দেশ্য। এসব পাউডার ব্যবহার মা ও শিশুস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্বক ক্ষতিকর। ক্রমাগত এসব ট্যালকম পাউডার ব্যবহারে ফুসফুস, ভলপেট ও হৃদপিন্ডের আবরণে টিউমার তৈরি করে যা পরবর্তীতে “মেসোথেলিওমা” নামক মারাত্বক টিউমারে পরিণত হয়, যার পরিণতি ক্যান্সার। দীর্ঘদিন আ্যাসবেস্টস নিঃশ্বাসের সাথে গ্রহণ বা অ্যাসবেস্টসযুক্ত পণ্য ব্যবহারের কারণে মেসোথেলিওমা’র উপসর্গ দেখা দেয়। মানবস্বাস্থ্য বিশেষত শিশুস্বাস্থ্য এতে ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে তাই পরিস্থিতি বিবেচনায় একে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া উচিত। জনসাধারণ এসব বিষাক্ত পণ্য সম্পর্কে জানলে হয়তো এসব পণ্য ব্যবহার করা সম্ভব।’’
‘‘অ্যাসবেস্টস পানি এবং বাতাসের সাথে দূষক হিসেবে এক স্থান থেকে অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ে। যখন খনিজ উস বা ট্যালকম পাউডার থেকে অ্যাসবেস্টস বাতাসে মিশে, সেগুলো পানি ও বায়ুমাধ্যমে জমতে থাকে, পরে এইসব অ্যাসবেস্টস এর এসব ক্ষুদ্র কণা বায়ুকণা ও পানির সাথে ছড়িয়ে পড়ে। বন্যপ্রাণী নিঃশ্বাসের সাথে এবং দূষিত পানি পানের মাধ্যমে অ্যাসবেস্টস গ্রহণ করছে। সামুদ্রিক প্রাণীও একইভাবে অ্যাসবেস্টস দূষণের শিকার হচ্ছে। অ্যাসবেস্টস দীর্ঘসময়ের জন্য পরিবেশে রয়ে যায়, তাই এর প্রভাবও দীর্ঘস্থায়ী হয়।’’
যদিও বাংলাদেশে ভোক্তা সুরক্ষা আইন রয়েছে, যেখানে ক্ষতিকারক পণ্যের বিক্রয় ও বিপণনে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও পণ্য উৎপাদনকারীরা তা মেনে চলে না। তাই এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে সরকার ও যথাযথ কর্তৃপক্ষকে জনসন অ্যান্ড জনসন এর বেবি পণ্য পরীক্ষা করা এবং যদি কোন ক্ষতিকারক উপাদান পাওয়া যায় তার বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে হবে। এই প্রতিবেদন তৈরির সময় এসডো জনসন অ্যান্ড জনসন পণ্যের বার্ষিক আমদানী বিষয়ক কোন তথ্য খুঁজে পাইনি, তাই এই বিষয়ে আরো গবেষণা ও অনুসন্ধানের প্রয়োজন রয়েছে।