বরাবরই আমাদের অর্থনীতির এক প্রাণশক্তি-প্রবাসীদের পাঠানো কষ্টার্জিত আয়। যে আয়ের পরতে পরতে রয়েছে প্রবাসী শ্রমিকদের অক্লান্ত পরিশ্রম, ত্যাগ আর দেশের প্রতি ভালোবাসা। রক্ত আর ঘাম ঝরিয়ে প্রবাসীরা দেশের জন্যে অতুলনীয় অবদান রেখে চলেছে। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা যে লক্ষ লক্ষ প্রবাসীরা রয়েছে তাদের পাঠানো রেমিট্যান্স আমাদের অর্থনীতিকে এক শক্তপোক্ত স্থানে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। এ কারণেই অর্থনৈতিক সংকটের অনেক ঝড়-ঝাপটা আমাদেরকে ফেলে দিতে পারেনি। অর্থনীতিবিদ আর বিষয় বিশেষজ্ঞরা মনে করেন প্রবাসী আয় বরাবরই বাংলাদেশের অর্থনীতির এক চালিকা শক্তি।
দেশের অর্থনীতি যখন অস্থিতিশীল অবস্থায় পতিত হয়, বিশেষজ্ঞরা যখন বলেন আমাদের অর্থনীতিতে সুসংবাদ বলে কিছু নেই, অর্থনীতির সর্বত্রই নাজুক অবস্থা বিরাজমান-তখন প্রবাসীরাই যেনো অর্থনীতির শেষ নিরপত্তা প্রহরী হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকে। গতকয়েক বছর ধরেই আমরা দেখছি বিদেশী বিনিয়োগ নিয়ে অর্থমন্ত্রী মহোদয়কে সময়ে অসময়ে অসন্তোষ প্রকাশ করতে। অর্থাৎ প্রত্যাশামতো বিনিয়োগ দেশে হয়নি বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। আবার রপ্তানি থেকে আয়ও মন ভরাতে পারেনি আমাদের। কিন্তু সেই বিবেচনায় অর্থনৈতিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে প্রবাসী আয়ের উর্ধ্বগতি নীতি-নির্ধারক থেকে শুরু করে সর্বমহলেরই সবসময় আস্থা ও আনন্দের এক উপলক্ষ্য বললে ভুল হবে না।
এই খাতে যে আমাদের অনেক সাফল্য, অনেক অর্জন তা বলাই বাহুল্য। প্রবাসী রেমিট্যান্স দেশে না এলে আমাদের অর্থনীতি অনেক ক্ষেত্রেই বিবিধ বাধার সম্মুখীন হতো। এই খাতের সাফল্য অর্জনের ধারার সর্বশেষ নতুন সংবাদটি হলো- ফের সৌদি শ্রমবাজার বাংলাদেশীদের জন্যে উন্মুক্ত হওয়া। গত কয়েকবছর ধরে বাংলাদেশ থেকে সবধরনের শ্রমিক নিয়োগে যে নিষেধাজ্ঞা ছিল সম্প্রতি সৌদিআরব সেটা তুলে নিয়েছে। ১১ আগস্ট সৌদিআরবে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গোলাম মসিহ এই সুখবরটি প্রকাশ করেন। টানা সাত বছর ধরে এই শ্রমবাজারটি বন্ধ ছিল।
নিঃসন্দেহে বর্তমান সরকারের এটি একটি বড় কূটনৈতিক সাফল্য। সৌদিআরর আমাদের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার, সবচেয়ে বেশি শ্রমিক এই দেশে কাজ করে। এখন পর্যন্ত এই দেশে ১৩ লক্ষেরও বেশি মানুষ বিভিন্ন ধরনের পেশার সাথে জড়িত রয়েছে। সৌদিআরব আবার শ্রমবাজার উন্মুক্ত করায় জনশক্তি খাতে সত্যিই নতুন প্রাণচাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে। আশা করা হচ্ছে অচিরেই আবার আগের মতো বাংলাদেশের শ্রমিকরা সেদেশ কাজ করার সুযোগ পাবে। সৌদি আরবের আগে জনশক্তি খাতে নতুন প্রাণের সঞ্চার করেছিল মালয়েশিয়ার সাথে বাংলাদেশী শ্রমিক নেওয়ার ক্ষেত্রে নতুন করে চুক্তির সংবাদটি।
জিটুজিপ্লাস প্রক্রিয়ায় শ্রমিক মালয়েশিয়ায় পাঠানোর ক্ষেত্রে দুটি দেশ অনেক এগিয়ে গেলেও কিছু জটিলতার কারণে শেষপর্যন্ত মালয়েশিয়ার বাজারটি এখনও ওপেন হয়নি। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী ৬.৭ মিলিয়ন মানুষ বিশ্বের প্রায় ১৪০ টি দেশে কাজ করছে। সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশী কাজ করছে সৌদিআরব, আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, কাতার, কুয়েত ওমান, বাহরাইন, লেবানন, দক্ষিণ আফ্রিকা, দক্ষিণ কোরিয়াসহ বিভিন্ন দেশে। এর বাইরে আরো অনেক দেশ রয়েছে যেখানে বাংলাদেশের যুবশক্তি শ্রমবিক্রি করছে।
মূলত ৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের শ্রমিকদের গমন মৃদু হারে শুরু হয়। কিন্তু সত্তর দশকের শেষের দিকে এই প্রবণতা আরো বাড়তে থাকে। আশির দশকে রীতিমতো জনশক্তি খাতে বিপ্লব হয়। হাজার হাজার বাঙালি তরুণ দেশ ছেড়ে বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমায়। এবং এ সব তরুণরা দ্রুতই তাদের ভাগ্য বদলাতেও সক্ষম হয়। সে সময় দেখা যায়, মাত্র একবছর ধরে যারা বিভিন্ন দেশে শ্রম বিক্রি করছে তার এবং পরিবারে অর্থনৈতিক এবং সামাজিক জীবনে এক দারুণ পরিবর্তন সূচিত হয়েছে।
আশির দশকে দেখা গেছে গ্রামেগঞ্জে যে নতুন বাড়িঘর উঠছে তার বেশিরভাগই প্রবাসে যারা কর্মরত রয়েছে তাদের। নতুন টিনের ঘর, দালানবাড়ি দেখলেই সে সময় মানুষকে বলতে দেখেছি ওটা ‘ডলারওয়ালা’দের বাড়ি। সেই ধারাবাহিকতা এখনও চলমান। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন এই খাতের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব অনেক। এই খাত দ্রতই মানুষের জীবনাচার বদলে দিতে সক্ষম। আয় বাড়ার সাথে সাথে মানুষের বাসস্থান, শিক্ষা, স্যানিটেশন ব্যবস্থারও আমূল রূপান্তর ঘটতে থাকে।
জনশক্তি খাত আমাদের জিডিপিতেও বড় ধরনের ভূমিকা রাখছে। সরকারের কাছেও এই খাত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গত কয়েকবছরের বাজেটেও তাই আমরা দেখেছি এই খাত ঘিরে কিছু সুনির্দ্দিষ্ট প্রস্তাবনা এবং বরাদ্দ দিতে। এর আগেও বাজেট বক্তৃতায় মাননীয় অর্থমন্ত্রী এই খাত নিয়ে অনেক অর্জন ও সাফল্যের কথা বলার পাশাপাশি কিছু স্বপ্নের কথাও তুলে ধরেছেন। ‘প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক’-এর সফল কার্যক্রমের পাশাপাশি ‘অভিবাসন ঋণ’ এবং ‘পুনর্বাসন ঋণ’ সুবিধার প্রচলনও শুরু হয়েছে।
তবে অনেকদিন ধরেই বর্তমান শ্রমবাজারের বাইরে নতুন নতুন শ্রমবাজারে প্রবেশের কথা বলা হলেও তার অগ্রগতি খুব একটা নেই। আগের প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রীর আমলে পোলান্ড, পাপুয়া নিউগিনি, আলজেরিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, অ্যাঙ্গোলা এবং কঙ্গোতে জনশক্তি রপ্তানি করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেভাবে সফলতা আসেনি।
বিশ্ব অর্থনীতি যেভাবে বদলে যাচ্ছে এবং দেশে যে হারে বেকারত্ব বাড়ছে তাতে করে বিশ্ব শ্রম বাজারের আমাদের আরো জায়গা করে নেওয়া ও শ্রমিক পাঠানোর বিকল্প নেই। বাংলাদেশের অন্যতম সমস্যা বেকারত্ব। এটি নতুন কোনো সমস্যা নয়, সমস্যাটি পুরনো এবং বহুল আলোচিত। স্বাধীনতার পয়তাল্লিশ বছর পেরিয়ে গেলেও বেকারত্বের কষাঘাত থেকে বের হতে পারেনি তরুণ ও যুব সমাজের বৃহদাংশ।
স্বভাবতই তরুণ সমাজের বড় অংশের মেধা এবং শক্তির অপচয় হয়েছে বললে ভুল হবে না। কর্মসংস্থানের অভাবে তরুণরা বিপদগামীও হচ্ছে বেশিমাত্রায়। দেশের যে মোট জনসংখ্যা তার তিনভাগের এক ভাগ হলো তরুণ সমাজ-যাদের গড় বয়স ধরা হয় ১৮ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। কিন্তু এই তরুণ সমাজের জন্যে দেশের অভ্যন্তরে চাকরির সুযোগ প্রত্যাশামতো খুব একটা প্রসারিত নয়। এ কারণেই বেকার তরুণদের দীর্ঘশ্বাস শোনা যায় সর্বত্র। প্রতিবছর আমাদের দেশের সরকারি চাকরিতে যে সংখ্যক তরুণ ঢোকার সুযোগ পাই তার সংখ্যা নগণ্যই। পরিসংখ্যনে দেখা যাচ্ছে প্রতিবছর অন্তত ২৬ থেকে ৩০ লক্ষ তরুণ শ্রমবাজারে ঢুকতে পারছে না। ফলে ব্যাপক সংখ্যক তরুণ কার্যত বেকারই থেকে যাচ্ছে। বেকার, হতাশ তরুণদের একটি অংশ জঙ্গিবাদসহ বিভিন্ন ধরনের সামাজিক অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ছে।
দেশে যখন জঙ্গিবাদ তীব্র সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে তখন সৌদি শ্রমবাজার আমাদের জন্যে উন্মুক্ত হওয়া নিঃসন্দেহে বড় এক কূটনৈতিক সাফল্য। অনেকেই এখন সৌদিআরবে যাওয়ার জন্যে প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। তবে এখানেই থেমে থাকলে হবে না। আরও যে সব দেশ আমাদের শ্রমিক নেওয়া বন্ধ রেখেছে সেসব দেশের সাথেও লাগাতার আলোচনা চালিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। সর্বোচ্চ তৎপরতা চালিয়ে খোলার উদ্যোগ নিতে হবে বন্ধ হয়ে যাওয়া সব শ্রমবাজার। একই সাথে নতুন শ্রমবাজারেও আমাদের প্রবেশ করতে হবে। মালয়েশিয়া এবং আরব আমিরাতেও অনেকদিন ধরে শ্রমিক যাওয়া বন্ধ রয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যের কাতার, ওমানে একেবারেই ধীর গতিতে কিছু কিছু শ্রমিক যাচ্ছে। এর আগে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে শ্রমিক পাঠানোর কথা ঢাক- ডোল পিটিয়ে বলা হলেও তার বাস্তব চিত্র দেখা যায়নি। শ্রমবাজারে ঢুকতে না পারার যে নেতিবাচক ফল তার হাতেনাতে প্রমাণ কিন্তু আমরা পেয়েছি। মালয়েশিয়া, সৌদি আরবের শ্রমবাজার যখন সম্পূর্ণরূপে বন্ধ ছিল তখন শত শত হাজার হাজার তরুণ প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে বিভিন্ন অবৈধ পথ ধরে কীভাবে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ডে যাওয়ার জন্যে সমুদ্র পথকে বেছে নেয়- সেটি আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। এ কারণেই আমাদেরকে অবশ্যই নতুন নতুন শ্রমবাজারে প্রবেশের জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং বায়রার মধ্যে সুসমন্বয়ও থাকতে হবে। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয় এরকম অনেক খাত নিয়ে যখন ঢের তর্ক-বিতর্ক, তখন কেবলই স্বপ্ন দেখায় জনশক্তি খাত। যে খাত থেকে প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে উপকৃত হচ্ছে দেশের সাড়ে তিন কোটি মানুষ। জনশক্তি খাতে আরও নজর দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)