রাজনীতিতে সরকারি দলের কাজের বিরোধিতা করা স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু সরকারের বিরোধিতা করতে গিয়ে দেশ ও জাতির বিরোধিতা কাম্য নয়। আর যে প্রচারমাধ্যমে এই বিরোধিতার কাজটি চলে, সেই গণমাধ্যমকে সমর্থন করা কিংবা তার পক্ষে প্রশস্তি গাওয়া মোটেও দেশ ও জাতির স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট হতে পারে না।
প্রসঙ্গটা আসে আলজাজিরায় প্রচারিত একটি সংবাদ প্রচারকে কেন্দ্র করে। শিরোনামের সঙ্গে বিষয়ের অসঙ্গতিপূর্ণ এই অনুষ্ঠানের কারণেই শুধু নয়, এই গণমাধ্যমটির অতীতের কার্যক্রমের কারণেও বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী কারো পক্ষে চ্যানেলটিকে স্বাগত জানাতে পারে না।
এই চ্যানেলটি সরাসরি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ইতিহাসে আঘাত করে আসছে বহু বছর ধরে। অভিযোগ আছে বাংলাদেশের জন্মশত্রু জামায়াতে ইসলামীকে অন্ধভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করছে তারা।
শুধু বাংলাদেশের জামায়াতের মতো উগ্র ধর্মব্যবহারকারী রাজনৈতিক দলকেই নয়, তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে জমিয়াতুল মুসলেমিন, লস্করে তৈয়বা এবং তুরস্কের একে পার্টিকেও পৃষ্ঠপোষকতা করার। তারা কাজ করছে মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুড এবং ইখওয়ানুল মুসলেমিনের মুখপত্র হিসেবে।
তাদের উদ্দেশ্য মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোতে অস্থিতিশীলতা তৈরি করে উগ্র ধর্মীয় গোষ্ঠীকে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করা। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশে তাদের কর্মকাণ্ডগুলোর দিকে তাকালে দেখা যাবে কিভাবে তারা বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিনষ্টে তৎপর।
বাংলাদেশের জন্মশত্রু জামায়াতে ইসলামি, মুসলিম লীগ ও অন্যান্যের পক্ষাবলম্বন করে তারা প্রচার কার্য চালায়।
এমনকি ত্রিশ লাখ বাঙালি নিধনকারী ও একাত্তরে মানবতা বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে বিচার কার্যকে তারা বিতর্কিত করার চেষ্টা করে মিথ্যা প্রতিবেদন প্রকাশের মাধ্যমে। এমন একটি প্রতিবেদন করে ২০১০ সালের ১০ আগস্ট। একাত্তরের মানবতা বিরোধী অপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া সম্পর্কে তারা বলে It is the first time in the country’s history that evidence of war crimes will be brought before a judge, but there are accusations that the government is using trials to round up the opposition.
প্রতিবেদনটির মূল বিষয় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে সরকার এই বিচারের আয়োজন করেছে। অথচ একাত্তরের মানবতা বিরোধী শক্তি বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রের বিরোধী, বাঙালি জাতির বিরোধী। এই শক্তি একাত্তরে ত্রিশ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে। এমনকি তাদেরই আরেকটি প্রতিবেদনে উল্লেখিত ৪/৫ হাজার মানুষকে হত্যার এই ভ্রান্ত পরিসংখ্যানকেও যদি মেনে নেয়া হয় তাহলেও বলতে হবে, তারা এই গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত। তাহলে তাদের দাবি অনুযায়ী বিরোধী দলকে দমনের জন্য এমন উদ্ভট দাবি ধুপে টিকে কি?
ধর্মান্ধ গোষ্ঠী কর্তৃক আয়োজিত ২০১৩ সালের ৫ই মে ঢাকার শাপলা চত্বরের সমাবেশে শত শত মানুষকে আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী হত্যা করেছে বলে সংবাদ প্রচার করে বাংলাদেশে ধর্মভীরু মানুষকে উস্কে দেওয়ার চেষ্টা করে এই প্রতিষ্ঠানটি। প্রায় ৮ বছরেও কেউ প্রমাণ করতে পারেনি সেই সমাবেশে কোনো প্রাণহাণীর ঘটনা ঘটেছে। এমনকি আয়োজক হেফাজতে ইসলামী আজ পর্যন্ত কোনো তালিকাই প্রকাশ করতে পারেনি।
বরং একটি গোষ্ঠী প্রচারিত তালিকায় মৃত বলে আখ্যায়িত এক ব্যক্তিকে মাদ্রাসায় ক্লাস করতে দেখা গেছে। ওই প্রতিষ্ঠানটি হাস্যকরভাবে কবরস্থানে একজন বাকপ্রতিবন্ধীকে ব্যবহার করে সংবাদে বলে এখানে অসংখ্য মানুষকে সমাহিত করা হয়েছে শাপলা চত্বরে নিহতদের। যা আবার পরবর্তীকালে মিথ্যা হিসেবে প্রমাণিত হয়।
আল জাজিরা নামের কাতারভিত্তিক এই সংবাদ মাধ্যমটি বাংলাদেশে অস্থিতিশীলতা তৈরির উদ্দেশে রোহিঙ্গা ইস্যু, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন ও কোটা আন্দোলন ইত্যাদি নিয়েও বিভ্রান্তিকর সংবাদ প্রচার করে উত্তেজনা সৃষ্টির চেষ্টা করে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্নতর হওয়ায় তাদের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়।
তাদের আদর্শ ‘ হুকুম দখলই ইসলাম’। সেই আদর্শ বাস্তবায়নে তারা শুধু মুসলিম অধ্যুষিত দেশই নয় বিশ্বের অন্যান্য দেশকেও টার্গেট করছে। ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে হামলার ঘটনাসূত্রে ওসামা বিন লাদেনের সাক্ষাৎকার প্রচার করে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে প্রতিষ্ঠানটি। আলকায়েদার মতো জঙ্গি গোষ্ঠীকে পৃষ্ঠপোষকতা করার জন্য তারা ইরাকের হারিস আল দারি, ওয়াগদি ঘোনেম, আইএস এর আবু মুসা আল জারকাবিসহ শীর্ষ জঙ্গিদের সংবাদ, তাদের বক্তব্য ও আলোচনা প্রচার করেছে। আল কায়েদার সদর দফতর খোলার অনুমতির জন্য মধ্যস্ততাকারী হিসেবে আলজাজিরা কাতার সরকারের সঙ্গে মধ্যস্ততাকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে বলেও সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
আল জাজিরার অন্যতম মালিক আল করিম আল সানি ১ মিলিয়ন ডলার আল কায়েদার ব্যাংক হিসেবে সহায়তা প্রদান করেছেন এমন সংবাদও আমরা পড়েছি। আন্তর্জাতিকভাবে কুখ্যাত জঙ্গিদের প্রচার সুবিধা প্রদানকারী এই প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ থেকেও এমন ব্যক্তিদের বেছে নিয়েছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশে প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, আল জাজিরা যে তথ্যচিত্রটি প্রচার করে বাংলাদেশে বিতর্কের সূচনা করেছে, তার অন্যতম ব্যক্তি হলেন জুল কারনাইন সায়ের খান বা সামি। এই সামি সম্পর্কে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়- তাকে বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে জড়িত থাকার কারণে বাংলাদেশের সেনানিবাসে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিলো। একসময় সে পাহাড়ী উগ্র জনগোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছিলো। বাবা একজন সেনা কর্মকর্তা তার ছেলের মাদকাসক্ত হওয়া, প্রতারণাসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে জড়িত হওয়ায় ত্যাজ্যপুত্র করেছিলেন।
ভ্রান্তপথে যাওয়া এই সামি মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কিত করার কাজে যুক্ত হয় একসময়। গতবছর সে জাতির পিতা ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে কটুক্তি করায় সাইবার ক্রাইম ইউনিটের নজরে আসে। ‘উই আর বাংলাদেশি’ নামে পেইজ মাধ্যমে সে রাষ্ট্র বিরোধী কাজে লিপ্ত রয়েছে বলে গোয়েন্দা সংস্থার বরাত দিয়ে সংবাদ প্রকাশ হয়েছে। এই অভিযোগে গতবছর তার বিরুদ্ধে আদালতে মামলাও হয়েছে।
চিহ্নিত অপরাধী ও বাংলাদেশ বিরোধী এই সামিকে ব্যবহার করে আল জাজিরা কোন উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে চায় তা সহজেই অনুমেয়।
সাম্প্রতিক বিতর্কিত প্রতিবেদনে সংশ্লিষ্ট সব চরিত্রই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী। বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে বার্গম্যানের অপতৎপরতা সম্পর্কেও সাধারণ মানুষ অবহিত । মোট কথা আল জাজিরা সাংবাদিকতার সব রীতিনীতি উপেক্ষা করে শুধু তাদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য বানোয়াট সংবাদ পরিবেশন করে চলেছে।
সরকারের হাতে এত প্রমাণাদি থাকার পরও মিশর, সৌদি আরব, ইরানের মতো বাংলাদেশেও আলজাজিরাকে নিষিদ্ধ করছে না কেন তা ভাবনার বিষয়।আর এমন একটি মিথ্যাচারী কেন্দ্রকে যারা সমর্থন করেন তাদের বিষয়ে অবশ্যই ভাবতে হবে।
তারা সরকার বিরোধিতার নামে দেশবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ নেয়ায় তাদের দেশ ও জাতির প্রতি মমত্ববোধই প্রশ্নের মুখে পড়ে। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন আসে তারা কি জঙ্গিপনাকেই রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চায়?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)