অন্ধকারের ঘনঘটা নেমে আসা বাংলাদেশ ফুটবলে আশারপ্রদীপ হয়ে জ্বলছে মেয়েদের বয়সভিত্তিক দল। লাল-সবুজের মেয়েরা সাফল্য যাত্রার ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছে শেষ হতে যাওয়া বছরে, ছিল উত্থান-পতনও; সঙ্গে ছেলেদের দল প্রত্যয়ী প্রত্যাবর্তনে জানান দিয়েছে, দেশের ফুটবল এগিয়ে নিতে তারাও ঘাম ঝরাতে কার্পণ্য করছে না!
আশা-প্রত্যয়ের এমন সেতুবন্ধনে একরাত পরেই আসছে নতুন বছরটা হয়ত আরও সাফল্যের পথ দেখাবে, নব আশার সম্ভাবনার গান শোনাবে। তার আগে দেখে নেয়া যাক কেমন ছিল ২০১৮ সালে বাংলাদেশ ফুটবলের চালচিত্র।
আন্তর্জাতিক উঠানে বাংলাদেশের ফেরা: লাওসকে ধন্যবাদটা দিতেই হয়! দেড় বছরের নির্বাসন কাটিয়ে এশিয়ান এই দলটির বিপক্ষেই প্রীতি ম্যাচ দিয়ে এবছর আন্তর্জাতিক ফুটবলে ফেরে বাংলাদেশ। শুরুটাও ছিল দারুণ। ২ গোলে পিছিয়ে থেকেও লাওসের বিপক্ষে ২-২ গোলে ড্র নিয়ে ফেরে জাতীয় ফুটবল দল।
মেয়েদের হংকং জয়: ২০১৮ সালে বাংলাদেশের ফুটবলকে প্রথম শিরোপা এনে দিয়েছে অনূর্ধ্ব-১৫ মেয়েরা। হংকংয়ে চার জাতির জকি সিজিআই যুব ফুটবল টুর্নামেন্টে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশের কিশোরীরা। শিরোপার পথে মালয়েশিয়াকে ১০-১ গোলে, ইরানকে ৮-০ ও হংকংকে ৬-০ গোলে উড়িয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় লাল-সবুজের মেয়েরা।
সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ শিরোপা হাতছাড়া: আসরের চ্যাম্পিয়ন ও হট-ফেভারিট হয়েই ভুটানে শিরোপা উদ্ধার করতে গিয়েছিল বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৫ মেয়েদের ফুটবল দল। পাকিস্তান, নেপাল ও ভুটানের বিপক্ষে হেসেখেলে জয়ী হয়ে ফাইনালে ভারতের কাছে স্বপ্নভঙ্গ হয় কিশোরীদের।
এএফসি-১৬ দ্বিতীয় পর্বের টিকিট পাওয়া: সাফের ব্যর্থতা ভুলে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ বাছাইপর্বের টিকিট পেতে কোমর বেঁধে নেমে পড়েছিল বাংলার বাঘিনীরা। তার ফলাফল মিলেছে হাতেনাতেই। লেবানন, আরব আমিরাত এবং ভিয়েতনামের মেয়েদের হারিয়ে প্রথমবারের মতো এই টুর্নামেন্টের দ্বিতীয়পর্বের টিকিট কাটে লাল-সবুজের কিশোরীরা।
১৫’র কষ্ট ভুলিয়ে দেয় সাফ-১৮: কয়েক মাস আগেই ভুটানে ফাইনালে হারের জ্বালা জ্বালিয়ে যাচ্ছিল মেয়েদের। সেই হারের যন্ত্রণা ভুলতে দুয়ারে হাজির সাফ অনূর্ধ্ব-১৮ নারী চ্যাম্পিয়নশিপ। প্রতিপক্ষকে টুর্নামেন্টে একেবারে উড়িয়ে দিয়েছে বাংলার বাঘিনীরা। নেপাল, পাকিস্তানকে গ্রুপপর্বে নাকানিচুবানি খাওয়ানোর পর স্বাগতিক ভুটানের জালে ৫ গোল জড়িয়ে মেলে ফাইনালের টিকিট। গ্রুপের প্রতিপক্ষ নেপালকে আরেকবার হারিয়ে প্রথমবারের মতো সাফের সেরা হয় বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৮ নারী ফুটবল দল।
এশিয়া কাপে বাংলাদেশের ইতিহাস: অ্যান্ড্রু অর্ড চলে যাওয়ার পর বাংলাদেশ জাতীয় দলের হাল ধরেন তারই স্বদেশি জেমি ডে। প্রথম অ্যাসাইনমেন্টেই বাংলাদেশের ফুটবলে ইতিহাস গড়েন এ ব্রিটিশ কোচ। বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-২৩ দলকে তোলেন এশিয়া কাপের নকআউট পর্বে। উজবেকিস্তানের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে হারলেও স্বাগতিক থাইল্যান্ডের বিপক্ষে ১-১ গোলে ড্রয়ের পর শক্তিশালী কাতারকে ১-০তে হারিয়ে দ্বিতীয় পর্বের টিকিট কাটে লাল-সবুজের তরুণরা।
উল্টোচিত্র মেয়েদের অনূর্ধ্ব-১৯ দলে: এএফসি-১৬ নারী দল দ্বিতীয়পর্বে গেলেও প্রথম রাউন্ড থেকেই বাদ পড়েছে অনূর্ধ্ব-১৯ দল। কঠিন দুই প্রতিপক্ষ সাউথ কোরিয়া ও চাইনিজ তাইপের কাছে হেরে উজবেকিস্তানের বিপক্ষে জিতেও পরের রাউন্ডে ওঠা হয়নি অনূর্ধ্ব-১৯ কিশোরীদের।
ঘরের মাঠে সাফ আয়োজন: নির্বাসন থেকে ফিরে এটাই ছিল বাংলাদেশের প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট। সেটিও ঘরের মাঠে। উত্তেজনার পারদটা তাই ক্রমেই চড়ছিল। ভুটান ও পাকিস্তানকে হারিয়ে ঠিক পথেই ছিল জেমি ডের দল। কিন্তু তৃতীয় ম্যাচে ঘটে বিপত্তি। নেপালের বিপক্ষে ২-০ গোলের হেরে উল্টে যায় হিসাব-নিকাশ। সেমিতে যাওয়ার বদলে গ্রুপপর্বেই বাদ পড়ে স্বাগতিকরা। অন্যগ্রুপে কোনো ম্যাচ না জিতে পরের রাউন্ডে যাওয়া মালদ্বীপ পাশার দান উল্টে হয়ে যায় আসরের চ্যাম্পিয়ন।
সফল বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ: সাফের পর বাংলাদেশের দুয়ারে হাজির হয় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক গোল্ডকাপ। শিরোপা না জিতলেও এই আসরে উন্নতি চোখে পড়েছে লাল-সবুজদের। সিলেটে প্রথম ম্যাচে লাওসকে ২-০ গোলে হারিয়ে সেমির পথও পরিষ্কার হয় জেমি ডের দলের। কিন্তু শেষচারে ফিলিপিন্সের কাছে ১-০ গোলের হারে এ আসর থেকেও খালি হাতে ফিরতে হয়।
বড়দের কষ্ট ভোলায় ছোটরা: বড়রা সাফে ব্যর্থ হলেও ছোটরা ঠিকই করেছে বাজিমাত। নেপালে আয়োজিত সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ চ্যাম্পিয়নশিপের গ্রুপপর্বে মালদ্বীপকে ৯-০ ও স্বাগতিক নেপালকে ২-১ গোলে হারিয়ে সেমি নিশ্চিত করে কিশোররা। সেখানে ভারতের কিশোরদের বিপক্ষে টাইব্রেকে ৪-৩ গোলের জয়ে নিশ্চিত হয় ফাইনাল। শিরোপার মঞ্চে পাকিস্তানের বিপক্ষে ৫-৪ গোলের টাইব্রেকে জিতে ট্রফি ওঠে বাংলাদেশের কিশোরদের হাতে।
ঝলমলে ঘরোয়া লিগ: আন্তর্জাতিক ফুটবলে বাংলাদেশের প্রত্যাবর্তনের ঢেউটা যেন এসে লেগেছে ঘরোয়া ফুটবলেও! আধিক্য কমিয়ে উন্নত মানের বিদেশি খেলোয়াড়দের দিকে ঝুঁকেছে ক্লাবগুলো। প্রথমবারের মতো শীর্ষ লিগে খেলতে এসে দুহাত ভরে টাকা ঢেলেছে নবাগত বসুন্ধরা কিংস। ক্লাবটির হাত ধরেই বাংলাদেশে খেলতে এসেছেন কোস্টারিকার হয়ে বিশ্বকাপ খেলা ফুটবলার ড্যানিয়েল কলিন্দ্রেস। একই ক্লাবে খেলছেন ব্রাজিলিয়ান মার্কোস ভিনিসিয়াসও। প্রথমবারের মতো এশিয়ান কোটা যুক্ত হওয়ায় বাংলাদেশে এসে খেলছেন জাপান, উজবেকিস্তানের ফুটবলাররাও। ঘরোয়া মৌসুমে বছরের শেষ ট্রফি স্বাধীনতা কাপ জিতে বসুন্ধরা এনেছে সাফল্যও।