চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

ছিলেন নদী, হলেন দেবী সরস্বতী

সরস্বতীপূজা বাঙালি হিন্দুদের জনপ্রিয় এক অনুষ্ঠান। সরস্বতী পূজা আবার যত না বড়দের পূজা, তার থেকে অনেক বেশি ছোটদেরই পূজা। মা সরস্বতীকে আমরা বিদ্যার দেবী বলে জানি। সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীদের আশা ভরসা তিনি, কারণ তিনি তুষ্ট থাকলেই শিক্ষার্থীরা ভালোভাবে পড়াশোনা করে পরীক্ষায় ভালো ফল করবে, এটাই বিশ্বাস। তাই বেশিরভাগ স্কুলে, অনেকের নিজেদের বাড়িতেই সবাই ধূমধাম করে সরস্বতী পূজা করে। আজকাল অবশ্য বারোয়ারীভাবেও পাড়ায় পাড়ায় সরস্বতী পূজা হয়ে থাকে।

ইতিহাসে সরস্বতীর দুই পরিচয়-নদী এবং দেবী। সরস্বতী মানে নদী। ঋগ্বেদে সরস্বতী নদী, আবার দেবীও। প্রথমে এই দেবী ছিলেন নদীরূপিণী, আজও যেমন গঙ্গাদেবী। ঋগ্বেদ ভারতে সমাগত আর্যদের আদিগ্রন্থ। আর্যরা এসে প্রথমে উত্তর-পশ্চিম ভারতের যে অঞ্চলে বসতি করেছিলেন, সেটির নাম দিয়েছিলেন তাঁরা ব্রহ্মাবর্ত। দুই নদীর মধ্যবর্তী এই অঞ্চল। নদী দুটির নাম: সরস্বতী এবং দৃষদ্বতী। নদীর তীরে বেদ আবৃত্তি ও গীত হত। তখন লেখার প্রচলন ছিল না, তাই আবৃত্তি এবং গানই বেদচর্চার উপায় ছিল। বেদ মানে বিদ্যা। অথবা বাক। যে নদীর ধারে বেদগান, ক্রমশ সেই নদীর নামে বিদ্যাদেবী আরাধিত হলেন, তাঁর নাম হল সরস্বতী। দৃষদ্বতীও হতে পারত, তা হলে বাগ্দেবীর নামের বানান করা আরও ঝকমারি হত।

সরস্বতীর নানা রকম মূর্তি আছে, যেমন অন্য নানা দেবদেবীরও। তবে সচরাচর তিনি চতুর্ভুজা, এবং তাঁর চার হাতে বই, মালা, বীণা এবং জলপাত্র কোথাও বা পাত্র থাকে না, বীণাটি দু’হাতে ধরা থাকে। বেদ যেহেতু চারটি ঋক, সাম, যজুঃ এবং অথর্ব, তাই সরস্বতীর চারটি হাতকে চার বেদের প্রতীক বলে ধরে নেওয়া হবে, সেটা অস্বাভাবিক নয়। তবে শাস্ত্রমতে চতুর্ভুজের অন্য অর্থ আছে। নানা মুনির নানা মত। একটি মতে, বই হল গদ্যের প্রতীক, মালা কবিতার, বীণা সঙ্গীতের, আর জলপাত্র পবিত্র চিন্তার।

সরস্বতীর বাহন হাঁস। রাজহাঁস। কেন? একটা যুক্তি এই যে, হাঁস জলমেশানো দুধ থেকে দুধটা আলাদা করে পান করতে পারে। অবিদ্যা থেকে বিদ্যাকে ছেঁকে নেওয়াই তো আসল শিক্ষা, তাই সরস্বতী হংসবাহিনী। কিন্তু কখনও আবার তিনি ময়ূরাসীনা। কী তার অর্থ? ময়ূর অহঙ্কারী, নিজের রূপের মোহে নিজেই আবিষ্ট। তাকে বাহন করে সরস্বতী শিক্ষা দেন: বিদ্যা দদাতি বিনয়ম্।

সরস্বতী এক সময়ে শুধু বিদ্যার দেবী রূপেই পরিচিত ছিলেন না, তিনি ছিলেন জীবনদায়িনী নদীরূপে পরিচিত;  সঙ্গে ছিলেন অন্নদায়িনী, এমনকি শত্রুবিনাশিনী রূপেও পরিচিত ! সমাজ বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সরস্বতী হয়ে উঠলেন হিন্দু ধর্মের জ্ঞানদায়িনী দেবী।

মানুষ যখন দ্বিপদ প্রাণী হিসেবে প্রথম যাত্রা শুরু করে, তখন ধর্ম বা দেবদেবী কিছুই ছিল না। ইতিহাস বই-এর ভাষায় এ হল প্রস্তর যুগের কথা। তখন ছিল নিজেকে টিঁকিয়ে রাখার যুগ। তারপর মানুষ যত স্থিত হয়েছে, নিজেরাই খাদ্য, বস্ত্র তৈরি করে জীবন কিছুটা সহজ করতে পেরেছে, তাদের চারপাশ দেখার অবকাশ হল, তারা দেখল, প্রাত্যহিক জীবনে অনেক প্রাকৃতিক সহায়তা তারা পেয়ে থাকে। কখনও শ্রদ্ধায়, কখনও বা ভয়ে তারা নানা প্রাকৃতিক শক্তিকে মর্যাদা দিল। প্রকৃতির বিভিন্ন অংশ- জল, বায়ু, মাটি, আলো থেকে শুরু করে গাছ, ফুল, পশু, পাখিদের বিভিন্ন শক্তির প্রতীক রূপে আরাধনা করতে শুরু করল। ধীরে ধীরে সময়ের পথচলার সঙ্গে সঙ্গে এই সমস্ত আরাধ্য শক্তিগুলি চেহারা, চরিত্র এবং বৈশিষ্ট বদল হতে থাকে। এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে পরিচিত এবং উপাসিত হতে হতে বদলে যেতে থাকে তাঁদের চেহারা, বাহন, আসন এবং ক্ষমতা। সভ্যতার বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ধর্মের এবং দেবদেবীদের ধারণার বিবর্তনও কিন্তু কম আকর্ষণীয় নয়!

হরপ্পা সভ্যতার পরবর্তী যুগে দীর্ঘ মরুভূমির পথ পেরিয়ে মানুষের যে দলটি পাঞ্জাবের বিস্তীর্ণ নদীবহুল অঞ্চলে এসে উপস্থিত হয়েছিল, তারা নিজেদের আর্য নামে অভিহিত করেছিল। নদী তাদের জীবনে সর্বরকম সহায়তা করে এতটাই স্বস্তি দিয়েছিল যে তারা আন্তরিকভাবেই এই নদীরূপা শক্তিকে বন্দনা করেছিল। এভাবেই বৈদিক সভ্যতার পত্তন হয়, শুরু হয় ঋষিদের মননসমৃদ্ধ বৈদিক ধর্মচিন্তার, যার ফসল হল ঋক্, সাম যজুঃ ও অথর্ব নামক বেদ।

যে কোন কাজেই শক্তি বা তেজের প্রয়োজন বা প্রয়োগ অবধার্য। খোলা চোখেই দেখা যায় সূর্য হল এই পৃথিবীর পক্ষে এক অফুরন্ত তেজের আধার। তাই স্বাভাবিকভাবেই সূর্য হিন্দুদের প্রথম দেবতা। কিন্তু শুধু বাবাতে তো আর মন ভরে না, মাকেও চাই। আসলে মায়ের আদরই তো আমরা প্রাণ ভরে উপভোগ করি। তাই একজন মাতৃরূপা দেবীরও আবশ্যক হল। যে বিশাল জলধারা মাতৃস্নেহে আর্য জাতিকে জীবনের সব ক্ষেত্রে লালন করেছিল, তিনিই তো হতে পারেন তাদের প্রথম দেবী। এই দেবীর নাম হল সরস্বতী, কারণ সরস্ শব্দের অর্থ জল।

শুধু জলযুক্ত বলেই দেবীর নাম সরস্বতী তা নয়, বৈদিক যুগের প্রথমে পুণ্যসলিলা সরস্বতী প্রধান এবং সর্বাপেক্ষা প্রয়োজনীয় নদী হিসেবেও গণ্য ছিল। নদী হিসেবে গঙ্গা বা যমুনার প্রাধান্য তখনও স্বীকৃত হয়নি। সরস্বতীর উৎপত্তিস্থল হিমালয় অন্তর্গত সিমুর পর্বতে। চলার পথে তীরে তীরে প্রসিদ্ধ তীর্থক্ষেত্রের সমাহার। এর তীরে অনুষ্ঠিত যজ্ঞের নাম সারস্বত যজ্ঞ, নদীর জলে পিতৃতর্পণ বিহিত ছিল।

তবে নদীরূপা ছাড়াও ঋক্ বেদে সরস্বতীর আরেকটা পরিচয় স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। সরস্ শব্দের আদি অর্থ জ্যোতি। সূর্যরশ্মির তিনটি রূপ- ইরা, ভারতী ও সরস্বতীর একত্রিত রূপ হল সরস্বতী। ইনি ত্রিলোকের সর্বত্রব্যাপী সূর্যতেজের স্ত্রীশক্তি। ইনি স্বর্গ-মর্ত্যকে দীপ্তি দ্বারা ব্যাপ্ত করে বিরাজমান। বেদে জ্যোতিরূপা সরস্বতীর উদ্দেশ্যে অনেক শ্লোক উৎসর্গ করা হয়েছে।

দেবী সরস্বতী বৈদিক যুগে আরও অনেক গুণের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি ‘বাজিনীবতী’ অর্থাৎ অন্নদায়িনী। সূর্যকরের সাহায্যে জল মেঘরূপে বৃষ্টি হয়ে পৃথিবীতে ঝরে পড়ে। পৃথিবী শস্যশালিনী হয়। এভাবেই দেবী সরস্বতী কৃষি ও পশুবৃদ্ধির সহায়ক হয়ে অন্নদাত্রী হয়ে ওঠেন। ঋষিদের বারবার প্রার্থনা, সরস্বতী যেন তাঁদের ধন দান করেন। নদী সরস্বতীর জলে সিক্ত উর্বর মাটিতে আর্যদের কৃষিভিত্তিক সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল; নদীর জল তাঁদের বাণিজ্যিক সম্পদেও বৈভবশালী করেছিল। তাই দেবী হলেন ধনদাত্রী। পরবর্তী কালেও সরস্বতীর এই গুণের কথা মুছে যায়নি। তন্ত্রশাস্ত্রে দেবীর ধ্যানমন্ত্রে তাঁর কাছে ঐশ্বর্য প্রার্থনা করা হয়েছে।

তিনি ‘দানবদলনী’। যে ভৌগলিক সীমানার মধ্যে আর্যসভ্যতার বিকাশ, সেখানে নদী সরস্বতী প্রাকৃতিকভাবেই প্রহরীরূপে বিরাজিত ছিলেন। তাই আত্মরক্ষার জন্য আর্যরা সরস্বতীর কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করেছিলেন। পৌরাণিক যুগেও দেবীর এই শত্রুদলনী রূপটি বর্তমান ছিল। মার্কণ্ডেয় পুরাণের অন্তর্গত শ্রীশ্রীচণ্ডীতে বলা হয়েছে ‘সরস্বতীমনুভজে শুম্ভাদিদৈত্যার্দিনীম্।’

সরস্বতীকে নানা রূপে কল্পনা করা হয়েছে। কখনও শত্রুদলনী, কখনও চিকিৎসকও বটে। এই কারণে তাঁকে সূর্য, ইন্দ্র, মরুৎ ও দেবচিকিৎসক অশ্বিনীকুমা্রদের স্ত্রী হিসেবেও উপস্থাপিত করা হয়েছে। পরবর্তী কালে তিনি ব্রহ্মা ও বিষ্ণুর স্ত্রী বলে পরিচিত হয়েছেন। ব্রহ্মা, পুরাণানুসারে বেদকে ধারণ করেছিলেন। জ্ঞানের উৎস এই বেদ, তাই ব্রহ্মার সঙ্গে যুক্ত হলেন সরস্বতী বা সাবিত্রী। ত্রিদেব ধারণাতে বিষ্ণু ছিলেন প্রধান দেবতা, তাই প্রধান দেবীকে তাঁর সঙ্গে জুড়ে দেওয়াটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া বলেই ধরা হয়েছে।

দেবী সরস্বতীকে আমরা সবচেয়ে বেশি জানি বিদ্যার দেবী বলে। পরবর্তী বৈদিক যুগে সরস্বতী অন্য পরিচয় মুছে কেবলমাত্র বাগদেবী হিসেবে স্বীকৃতা হলেন। শ্রীরমেশচন্দ্র দত্ত মনে করেন, প্রথমে নদী দেবী বলে পূজিতা হলেন। পরে নদীর তীরে বিবিধ জ্ঞানযজ্ঞ ক্রমান্বয়ে অনুষ্ঠিত হতে হতে এই নদীই বিদ্যাদেবী হলেন।

অবশ্য সূর্যের কিরণস্বরূপা জ্যোতির্ময়ী সরস্বতী যে নদী সরস্বতী হয়ে গেলেন, তার জন্য একটা সুন্দর গল্প ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে পাওয়া যায়। বিষ্ণুর তিন স্ত্রী – লক্ষ্মী, সরস্বতী ও গঙ্গা। কে স্বামীর বেশি প্রিয়, সেই নিয়ে তিনজনের মধ্যে লেগে গেল ঝগড়া। শেষ পর্যন্ত গঙ্গা সরস্বতীকে শাপ দিলেন, “যাও, পৃথিবীতে গিয়ে নদী হয়ে জন্ম নাও”। দেবী সরস্বতী নদী হয়ে নেমে এলেন আমাদের এই ধরায়।

বৌদ্ধধর্মেও পরে যখন বুদ্ধ ছাড়াও অন্যান্য দেব-দেবীর আমদানি হল, দেখা গেল সরস্বতী সেখানে বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গিয়েছেন। অবশ্য তখন তাঁর নাম হল বজ্রতারা ও জাঙ্গুলীতারা। এছাড়াও ছিলেন সরস্বতীর আদলে কল্পিত বিদ্যার অধিষ্ঠাতা মঞ্জুশ্রী।

জৈনধর্মেও সরস্বতী বেশ জনপ্রিয়। তিনি হলেন শ্রুত দেবতা – কেবল বা জ্ঞানের দেবী। কার্তিকী শুক্লাপঞ্চমীতে জৈনরা ধূমধাম করে এঁর পূজা করে থাকেন।

আমাদের বিদ্যা-শিক্ষার ঘরে যতই অন্ধকার থাকুক না কেন, আসুন আমরা তবুও উচ্চারণ করি সরস্বতী পূজার চিরন্তন মন্ত্র: ওঁ জয় জয় দেবী চরাচর সারে, কুচযুগ শোভিত মুক্তাহারে।/ বীণারঞ্জিত পুস্তক হস্তে, ভগবতী ভারতী দেবী, নমোহস্ততে।। নমো ভদ্রকালৌই নমোনিত্যং সরস্বতৈ নমো নমঃ। বেদ-বেদাঙ্গ-বেদান্ত বিদ্যাস্থানেভ্য এব চ।। এষ সচন্দন পুষ্প-বিলম্ব পত্রাঞ্জলি সরস্বতৈ নমঃ।। মহাভাসে বিদ্যেকমলোলোচনে। বিশালাক্ষি বিদ্যাং দেহি নমোস্তুতে।। বিশালাক্ষি বিদ্যার দেবি নমোস্তুতে।।…

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)