ছেলেটার নাম গোলাম রাব্বানী।
আমি ছেলেটাকে চিনি না। আমার চেনার কোন কারণও নেই।
তবে গত কয়েকদিন ধরেই আমার পরিচিত অনেকেই দেখছি তাকে ম্যানশন করে নানান পোস্ট দিচ্ছে, তার প্রশংসা করে অনেকেই অনেক লেখা লিখছে; তাই ভাবলাম ওর ফেসবুক প্রোফাইল থেকে ঘুরে আসা যাক।
ওর প্রোফাইলে গিয়ে দেখি, ছেলেটা অনেক আগে থেকেই আমাকে ফলো করছে ফেসবুকে। এরপর কেন যেন মনে হলো মেসেজ বক্সটা খানিক চেক করি।
চেক করে দেখি ঠিক এক বছর আগে ছেলেটা আমাকে একটা মেসেজ পাঠিয়েছিলো, ওই মেসেজে সে লিখেছে, “আপনার লেখনশৈলী চমৎকার!”
আমি তার মেসেজটা দেখেছিলাম এবং উত্তরে লিখেছিলাম, “ধন্যবাদ এবং শুভ কামনা থাকল।”
গোলাম রাব্বানী নামের এই ছেলেটা সপ্তাহ খানেক আগে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হয়েছে।
আমার মতো মানুষের লেখা ফলো করার তার হয়ত কোন দরকার নেই; এরপরও সে দীর্ঘদিন ধরেই আমার লেখা ফলো করছে। শুধু তাই না, আমার লেখা তার ভালো লাগে, সেটা সে মেসেজ করে জানিয়েছে। অথচ সে কিন্তু আমার বন্ধু তালিকায়ও নেই।
আমি তার প্রোফাইলটা ভালো করে চেক করে দেখে বুঝলাম, সাধারণ সম্পাদক হবার আগে ছেলেটা ছাত্রলীগের শিক্ষা বিষয়ক কোন একটা দায়িত্ব পালন করছিল।
আমি যেহেতু দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কিংবা সার্বিক শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে নিয়মিত লেখালেখি করি, তাই তার হয়ত আমার লেখা চোখে পড়েছে এবং এই কারণে সে হয়ত আমার লেখা ফলোও করে এসেছে।
আমি ধরে নিচ্ছি, সে তার উপর অর্পিত দায়িত্বটা সঠিক ভাবেই পালন করছিল, যার প্রতিদান হিসেবে সে হয়ত এখন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকও হয়েছে। দূর থেকে তো আর একটা মানুষকে খুব একটা চেনা সম্ভব নয় কিংবা আমি কারো কাছে জানতেও চাইনি-ছেলেটা কেমন? তার ফেইসবুক প্রোফাইল দেখে আমার ছেলেটাকে বেশ সাদামাটা মনে হয়েছে।
এছাড়া ছেলেটা আমাকে এক লাইনের যেই মেসেজ বছর খানেক আগে পাঠিয়েছিলো, সে মেসেজটাও আমার কাছে খানিক অন্য রকম মনে হয়েছে।
অন্য কেউ হলে হয়ত লিখত- আপনার লেখা ভালো লাগে কিংবা লেখার হাত ভালো বা ধরন ভালো।
“লেখনশৈলী” শব্দটা এই ছেলে যুক্ত করেছে। এই শব্দটার মাঝে এক ধরনের মাধুর্য আছে। আমরা যারা ল্যাংগুয়েজ ডিসকোর্স সম্পর্কে খানিকটা হলেও জানি, তাদের বোধকরি জানা থাকার কথা, ভাষার ব্যবহারের মাধ্যমেও আসলে অনেক সময় আমরা মানুষের আচার-ব্যবহার নির্ণয় করার চেষ্টা করি।
আমার কাছে ছেলেটাকে বেশ চমৎকার মনে হয়েছে। ধরে নিচ্ছি ছেলেটা বেশ চমৎকার।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে- ও কি এমন চমৎকার থাকতে পারবে?
ছেলেটা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হবার পর আমার চেনা পরিচিত মন্ত্রী, এমপি, আমলা, সাংবাদিকসহ আরও অনেকেই ওকে নানান প্রশংসা করে ফেসবুকে কতো কিছু যে লিখে চলেছে, তার নেই ঠিক।
যারা তাকে এখন এতো সব প্রশংসা করছে, এরাই একটা সময় তাকে ব্যবহার করে নানান কাজ বা ফায়দা হাসিল করার চেষ্টা করবে।
নানান ব্যবসায়ি এবং রাজনীতিবিদরা হয়ত অর্থের বিনিময়ে ছাত্রলীগ এবং এই ছেলেটাকে দিয়ে নানান সব অনৈতিক কাজও করিয়ে নিতে পারে।
চারপাশে এতোসব প্রলোভন উপেক্ষা করে এই ছেলেটার পক্ষে কি আদৌ সাদামাটা থাকা সম্ভব হবে?
শিক্ষা বিষয়ক দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সে যেমন আমার মতো মানুষের লেখাও পড়তো, এখন কি তার আদৌ সেই সময় হবে?
কিংবা সময়ও যদি হয়, আমার কোন সমালোচনামূলক কিংবা দিক নির্দেশনামূলক লেখা পড়ে, তার কি মনে হবে- আমি তার কিংবা তার দলের বিরোধী?
সে কি পারবে চারপাশের এতসব টেম্পটেশন উপেক্ষা করে খুব স্বাভাবিক আর সাদামাটা জীবন যাপন করে, সাধারণ মানুষের কাতারে থাকতে?
আমাকে দুইদিন আগেই এক ছেলে মেসেজ করে লিখেছে -স্যার, আপনাকে তো জানতাম আওয়ামী ঘরনার মানুষ। আপনি যে এতো সব সমালোচনা করছেন, এর মানে কি?
এই ছেলেটার বয়েস কতো হবে?
২২-২৩ হবে হয়ত।
অর্থাৎ এই ছেলে বড়ই হয়েছে এমন একটা মানসিকতা নিয়ে, যেই সিস্টেম তাকে শিখিয়েছে, আপনি যদি একটা দল করেন বা একটা রাজনৈতিক দলের আদর্শে বিশ্বাস করেন, তাহলে কোন ভাবেই সেই দলের সমালোচনা করতে পারবেন না এবং অন্য কোন দলের মানুষজনের সঙ্গে মিশতেও পারবেন না!
আর যদি সমালোচনা করে বসেন- তাহলে আপনি আসলে তাদের শত্রু! কিংবা অন্য কোন দলের মানুষজনের সঙ্গে মেলামেশা করলেও আপনি শত্রু!
আমি এই ছেলেকে দোষ দিব না, কারন তার আগের প্রজন্মের মানুষজন তাকে এমনটাই শিখিয়েছে কিংবা সে তার আশপাশের পরিস্থিতি আজীবন এমনটাই দেখেছে।
বছরের পর বছর আমাদের ছেলেপেলেরা এটাই জেনে এসেছে- আপনি আওয়ামী লীগ করলে, আওয়ামী লীগের সমালোচনা করতে পারবেন না কিংবা বিএনপি বা অন্য যে কোন দল করলে সেই দলের বা দলের কোন কাজের সমালোচনা করতে পারবেন না। আর সেই সঙ্গে অন্য দলের লোকজনদের সঙ্গে ব্যক্তি জীবনে মিশতেও পারবেন না!
তারা এটাই দেখে অভ্যস্ত। কিন্তু এটা মোটেই কোন সুস্থ-স্বাভাবিক প্র্যাকটিস না।
এতে করে যেটা হয়, আমরা সব সময় একটা সাইড দেখি। মুদ্রার অন্য দিকটা আর আমরা দেখতে পারি না। আমরা তখন ভাবি সবাই তো আমার মতোই ভাবছে। আসলে কিন্তু তা নয়।
যেহেতু আপনার আশপাশে আপনি কেবল আপনার মতো, আপনার দলীয় মানুষজনদেরই রাখছেন এবং তারা যেহেতু দলের সিদ্ধান্তের বাইরে কখনোই কোন কথা বলে না; তাই আমরা হয়ত মনে করে বসছি- দেশের সবাই তো আমার মতোই ভাবছে!
এই যে আমাদের দেশের এতো সব সমস্যা এর একটা মূল কারন হচ্ছে এই ধরনের মেরুকরণ।
একজন মানুষের পক্ষে একটা দলের সকল সিদ্ধান্ত কোন ভাবেই মেনে নেয়া সম্ভব না। এটা আসলে কখনোই হবার নয়। আর যদি সে মেনে নেয়, তাহলে বুঝতে হবে সে তার মতের বিপরীতেই মেনে নিচ্ছে।
পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে চর্চাটা এমন না। ইংল্যান্ডের সংসদে এই তো কয়দিন আগে সরকার দলীয় অনেক সাংসদ সরকারের একটা সিদ্ধান্তের জন্য সংসদে দাঁড়িয়ে নানান সমালোচনা করেছেন। এমনকি কয়েকজন ক্ষোভে সংসদ থেকে খানিক সময়ের জন্য বেরও হয়ে গিয়েছে।
এর মানে কি তারা সরকার বিরোধী?
মোটেই না। তারা বরং সরকারের ভালো চায় কিংবা তারা তাদের মতামত জানাচ্ছে। তারা বলতে চাইছে সরকার যদি এই সদ্ধান্ত নেয় সেটা হিতে বিপরীত হতে পারে। সাধারণ মানুষ একে খারাপ চোখে দেখতে পারে।
জগতের যেই সব দেশগুলো উন্নত এবং সভ্য, সেখানে মানুষজন তাদের মতামত জানাতে পারে, এমনকি নিজ দল কিংবা দলীয় প্রধান থেকে শুরু করে দলের অনেক সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে বেড়ায়।
এবং রাজনীতির বাইরে কিংবা আদর্শিক রাজনীতির বাইরে ব্যক্তি জীবনে তারা অন্য দলের মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে, পার্টি করে, সামার ভ্যাকেশন কাটাতে যায়।
কিন্তু যখন তাদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির কথা জিজ্ঞেস করবেন- তখন দেখা যাবে আদর্শিক জায়গা সম্পূর্ণ ভিন্ন।
আমি জানি বাংলাদেশের মতো একটা দেশে এমন সংস্কৃতি চালু করা একদিনেই সম্ভব নয়। নানান ব্যাপার আছে। তবে আস্তে আস্তে করে এমন সংস্কৃতি তো আমাদের চালু করতে হবে।
একটা মানবিক সমাজ এবং রাষ্ট্রের জন্য ধীর পায়ে হলেও কাউকে না কাউকে এগিয়ে আসতে হবে। ছোট ছোট স্টেপগুলোই হয়ত একটা সময় আমাদের একটা জায়গায় পৌঁছে দিবে।
গোলাম রাব্বানী, তুমি তো এখন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। অনেক বড় পদ। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের সব চাইতে বড় দুটো পদের একটি তোমার। আমি জানি না, তুমি আমার এই লেখা পড়বে কিনা কিংবা এখন আর তোমার আমার লেখা পড়ার সময় আদৌ আছে কিনা।
তোমার কাছে খুব জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে- ধরে নাও আমরা সবাই জানছি এবং দেখছি দেশের পরীক্ষাগুলোতে নকল হচ্ছে; আর তোমার সংগঠনের প্রেসিডেন্ট সেই মুহূর্তে যদি জাতীয় টেলিভিশনে গিয়ে বলে বসে- “দেশে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কিংবা কোন পরীক্ষায় নকল হয় না!”
তাহলে তুমি কি তোমার সংগঠনের প্রেসিডেন্টের হয়ে দেশের মানুষের কাছে ক্ষমা চেয়ে বলতে পারবে- সে একটা ভুল বক্তব্য দিয়েছে, আমি তার হয়ে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। পারবে বলতে?
না হয় তুমিই শুরু করলে নতুন করে এমন সংস্কৃতি।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)